নেটফ্লিক্স কিংবা টিভিতে মুভি-সিরিজ দেখার সময় এমন দৃশ্যের অবতারণা আমরা হরহামেশাই দেখতে পাই- বরফে ঢাকা পাহাড়, আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো নেমে আসছে তুষার। এমন দৃশ্যে কার না চোখ জুড়াবে! প্রকৃতিপ্রেমিক কারো কারো হয়তো একটু তুষারস্নাত হতেও ইচ্ছে করে। কিন্তু নাতিশীতোষ্ণ আমাদের এই দেশে সেই ইচ্ছের প্রতিফলন যে হওয়ার নয়! তাই অনেক সময় প্রশ্ন জাগে, প্রকৃতির এই বিশেষ ঘটনার পেছনের কারণটা কী? শুধুই কি শীতপ্রধান দেশগুলোতেই তুষারপাত হয়? কী কী বিষয় কাজ করে তুষারপাতের পেছনে? আর তুষারকণাই বা কেমন হয়? আজকের এই লেখায় জেনে নেওয়া যাবে এর খুঁটিনাটি।
অনেকেরই ধারণা, শীতপ্রধান দেশগুলোর নিম্ন তাপমাত্রাই বোধহয় দায়ী তুষারপাতের জন্য। তাদের জন্য বলে রাখা ভাল, এন্টার্কটিকায় তুষারপাতের হার কিন্তু অনেক কম। হয় না বললেই চলে। যদিও এন্টার্কটিকার তাপমাত্রা পৃথিবীর অন্যান্য অনেক জায়গার চেয়েই খুব কম। তাহলে?
তুষারপাত সাধারণত বেশি ঘটতে দেখা যায় এমন সব জায়গায় যাদের- ১. সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে উচ্চতা বেশি, এবং ২. বিষুবীয় অঞ্চল থেকে দূরত্ব বেশি।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কোনো জায়গার উচ্চতা যত বেশি, সেখানে নিয়মিত তুষারপাত হবার সম্ভাবনা তত বেশি। তাই সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে তুষারপাত বেশি ঘটতে দেখা যায়। একইভাবে, বিষুবীয় অঞ্চল থেকে দূরত্ব যত বেশি, তুষারপাতের সম্ভাবনাও তত বেশি।
বায়ুমণ্ডলে তুষারের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও, এর ছোট একটি অংশ পাহাড়ে তুষার হিসেবে পাওয়া যায়। অবশিষ্টাংশ বৃষ্টি হিসেবে পৃথিবীতে এসে পড়ে। এর কারণ তাপমাত্রা। জলীয়বাষ্পের মেঘ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চলে গেলে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে, ফলে তা গলে যায় আর পানিতে পরিণত হয়। পাহাড়ের তাপমাত্রা সাধারণত সমতল অঞ্চলের চেয়ে অনেক কম থাকে, এজন্যই সমতল অঞ্চলে তুষারপাত খুব কম ঘটতে দেখা যায়।
তুষারপাত হবার পেছনে দুটো মূল বিষয় কাজ করে- ১. অতিপৃক্ত বায়ুমণ্ডল, এবং ২. নিম্ন তাপমাত্রা।
কোনো স্থান কতটা সম্পৃক্ত তা নির্ভর করে বাতাসে বিদ্যমান জলীয়বাষ্পের পরিমাণের উপর। কোনো সময়ে একটি স্থানের বায়ুমণ্ডল যে পরিমাণ জলীয়বাষ্প ধারণ করতে পারে, ঠিক সেই পরিমাণ জলীয়বাষ্প সেখানে উপস্থিত থাকলে সেই স্থানের বায়ুকে স্যাচুরেটেড বা সম্পৃক্ত বলা হয়। কিন্তু জলীয়বাষ্প যদি পরিমাণের চেয়ে অধিক থাকে তবে সেই বায়ুকে সুপারস্যাচুরেটেড বা অতিপৃক্ত বলা হয়। আর বায়ুর জলীয়বাষ্প ধারণক্ষমতা নির্ভর করে সেই স্থানের তাপমাত্রার উপর। কোনো স্থানের তাপমাত্রা যত বেশি হয় সেই স্থানের জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতা তত বেশি হয়; আর তাপমাত্রা যত কম হয় জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতাও তত কম হয়।
এন্টার্কটিকার প্রসঙ্গে আসা যাক। এন্টার্কটিকার তাপমাত্রা অনেক কম থাকায় সেখানের বায়ুমন্ডলে তুষারপাত ঘটার জন্য পর্যাপ্ত জলীয়বাষ্প থাকে না। কারণ সেখানে পানির বাষ্পীভবন হার অনেক কম। তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে, কোথায় তুষারপাত সবচেয়ে বেশি হতে পারে? উত্তরটা হলো যেখানে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি। তবে তাকে দ্বিতীয় শর্তও পূরণ করতে হবে। সেই স্থানের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে থাকতে হবে। এ তাপমাত্রা যে ০° সেলসিয়াসের নিচে হতে হবে এমনটা নয়। মোটামুটি ২° সেলসিয়াসের নিচে হলেই তা উপযুক্ত। এ তাপমাত্রায় তুষার গলে পানিতে পরিণত হতে পারে না।
যেসব জায়গায় পানির কোনো উৎস আছে, সেসব জায়গার বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ অন্যান্য স্থানের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকে। এবার যদি এমন হয় যে সেই স্থানের তাপমাত্রাও ২°সেলসিয়াসের নিচে, তাহলেই সোনায় সোহাগা। তুষারপাতের জন্য তা উপযুক্ত। এজন্যই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা কম হওয়ার পরেও অনেক হ্রদ কিংবা নদীর তীরে তুষারপাত দেখা যায়। একে লেক-ইফেক্ট স্নো বলা হয়।
নদী-নালা, খাল-বিল, সমুদ্র এবং অন্যান্য যত পানির উৎস আছে তা থেকে সূর্যের তাপের কারণে প্রতিনিয়ত পানি বাষ্পীভূত হচ্ছে, যা আমাদের কাছে জলীয়বাষ্প নামে পরিচিত। এই জলীয়বাষ্প বাতাসের চেয়ে হালকা, তাই পানি বাষ্পীভূত হওয়ার পর তা বায়ুমণ্ডলের তুলনামূলক উপরের দিকে উঠে আসে। কিন্তু বায়ুমণ্ডলের যত উপরের দিকে ওঠা যায়, তাপমাত্রা তত কমতে থাকে, সাথে বায়ুচাপও কমতে থাকে। এজন্য যত উপরের দিকে যাওয়া যায়, বায়ুর জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতাও তত কমতে থাকে। এটা প্রায় সব জায়গার সাধারণ ঘটনা।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অধিক উচ্চ স্থানগুলোর তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবেই কম থাকে, যে কারণে জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতাও কম থাকে। ফলে সেই স্থানগুলোর বায়ুকে সুপারস্যাচুরেটেড হতে হলে অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে পানির তুলনামূলক কম বাষ্পীভবন হলেই হয়। বাষ্পীভূত হওয়ার পর অতিরিক্ত জলীয়বাষ্প বাতাসে ভাসতে থাকে। তাপমাত্রা অনেক কম থাকায় আর বায়ুমণ্ডলের উপরের দিকে চাপও কম থাকায় সেই জলীয়বাষ্প সেমি-সলিড হয়ে যায়। এই সেমি-সলিড জলীয়বাষ্প এরপর বাতাসে বিদ্যমান ধুলিকণার সংস্পর্শে আসলে জমে যায় আর হেক্সাগোনাল (ষড়ভুজাকার) আইস ক্রিস্টাল গঠন করে। আইস ক্রিস্টাল হেক্সাগোনাল হওয়ার কারণ পানির অণুর ডাইপোল বৈশিষ্ট্য এবং পারস্পরিক হাইড্রোজেন বন্ধন।
পানির একটি অণুর গঠন লক্ষ্য করলে আমরা দেখি, এটি দেখতে ইংরেজি বর্ণ V-এর মতো। প্রতিটি অণুতে একটি করে অক্সিজেন এবং দুটি করে হাইড্রোজেন পরমাণু থাকে। H-O-H বন্ধন কোণের মান প্রায় ১০৪.৫°। অক্সিজেন পরমাণু হাইড্রোজেনের তুলনায় অধিক তড়িৎ ঋণাত্মক মৌল হওয়ায় সমযোজী বন্ধনের শেয়ারকৃত ইলেকট্রন অক্সিজেন পরমাণুর দিকে বেশি আকৃষ্ট থাকে। ফলে অক্সিজেনে আংশিক ঋণাত্মক ও হাইড্রোজেনে আংশিক ধনাত্মক প্রান্ত বা পোল তৈরি হয়। এটাই পানির ডাইপোল বৈশিষ্ট্য। পানির একটি অণুর প্রতিটি আংশিক ধনাত্মক হাইড্রোজেন অন্য অণুর আংশিক ঋণাত্মক অক্সিজেনের সাথে হাইড্রোজেন বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত হয়।
এভাবে চেইনের মাধ্যমে পানির অণুগুলো সংঘবদ্ধ হয়। আর এর ফলে তাদের ইন্টারমলিকুলার স্পেস হ্রাস পায়। এজন্যই পানি তরল অবস্থাপ্রাপ্ত হয়। এরপর পানিকে ফ্রিজ বা কেলাসিত করা হলে অণুগুলো অধিকতর সুস্থিতির জন্য ষড়ভুজাকার বিন্যাস লাভ করে। আইস ক্রিস্টালগুলো একবার ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই বিষয়টা বোধগম্য হয়ে যাবে। ভালো করে খেয়াল করলে আরেকটা বিষয়ও দেখতে পাওয়া যায়, আইস ক্রিস্টালের ষড়ভুজাকার গঠনের মাঝে অনেকটা ফাঁকা স্থান রয়েছে। পানির অণুতে ইন্টারমলিকুলার স্পেস অনেক কম থাকে, কিন্তু আইস ক্রিস্টালের ক্ষেত্রে অনেক ফাঁকা স্থান থাকে। এ কারণেই পানিকে বরফে পরিণত করা হলে তার আয়তন বৃদ্ধি পায়। এটা একরকম ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য।
আইস ক্রিস্টাল এরপর নিচের দিকে পড়তে থাকে। এসময় ক্রিস্টালের সাথে বাতাসে ভাসমান অন্যান্য জলীয়বাষ্পের সংস্পর্শ হয়, তখন জলীয়বাষ্পগুলো ক্রিস্টালের ছ’প্রান্তে যুক্ত হয়ে ফ্রিজ হতে থাকে। ফলে আইস ক্রিস্টালের ছ’প্রান্তে পাখির পালকের মতো ব্রাঞ্চ বা স্পাইক তৈরি হতে থাকে। প্রতি প্রান্তের বায়ুচাপ একই থাকায় প্রতিটি শাখাই একই রকম হয়, যা ক্রিস্টালকে প্রতিসম গঠন দান করে। একে বলা হয় স্নোফ্লেক বা তুষারকণা। একটু মিষ্টি করে বললে ‘হিমরত্ন’। এরকমই অগণিত হিমরত্ন মাটিতে এসে পড়ে, আমাদের কাছে যা স্নোফল বা তুষারপাত হিসেবে পরিচিত।
মজার বিষয় হচ্ছে, দুটো তুষারকণা বা স্নোফ্লেক দেখতে কখনো একই রকম হয় না। খুব বিচিত্রই বলা যায়। দুটো তুষারকণাকে হুবহু একইরকম হতে হলে দুটোরই তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুচাপ হুবহু একইরকম হতে হবে, যা অসম্ভব। কারণ প্রতিটি তুষারকণার গতিপথ ভিন্ন, প্রত্যেকে আলাদা আলাদা পথে ভূমিতে এসে পড়ে। এজন্য প্রতিটি তুষারকণাই অনন্য আকৃতি লাভ করে।
এ বিষয়টি প্রথম নজরে আসে উইলসন বেন্টলি (১৮৬৫-৩১) নামক একজন তুষারপ্রেমীর, যিনি ক্যামেরার সঙ্গে একটি মাইক্রোস্কোপ সংযুক্ত করে সর্বপ্রথম তুষারকণার ছবি তোলেন। তার সংগ্রহে ৫,০০০ এর মতো বিভিন্ন আকৃতির তুষারকণার ছবি ছিল।
খালি চোখে দেখে তা বোঝার উপায় অবশ্য নেই। কিন্তু কখনো যদি তুষারপাত সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়, তাহলে চট করে কিছু তুষার নিয়ে মাইক্রোস্কোপে রেখে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। আমার বিশ্বাস আপনি বিস্মিত হতে বাধ্য।