শুরুর আগে
রেগে গেলে, কথার টানে ‘অপদার্থ কোথাকার!’ বলে বকা দেওয়ার রীতি আমাদের ভাষায় আছে। বাস্তবে, বিজ্ঞানের ভাষায় ‘অপদার্থ’ বলে কিছু না থাকলেও ‘প্রতিপদার্থ’ বলে একটা জিনিসের অস্তিত্ব কিন্তু আছে!
এরা মূলত সাধারণ পদার্থের উল্টো জিনিস। সাধারণ পদার্থের পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটন। প্রতিপদার্থের ক্ষেত্রে পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে ঋণাত্মকভাবে চার্জিত প্রতিপ্রোটন। আবার, সাধারণ পদার্থে যেখানে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ঋণাত্মক ইলেকট্রন ঘুরপাক খায়, সেখানে প্রতিপদার্থের পরমাণুতে থাকে ধনাত্মক পজিট্রন!
সাধারণ পদার্থের উল্টো কোনো পদার্থ যে থাকতে পারে- একটা সময় পর্যন্ত কেউই এটা কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু ১৯২৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক একটি সমীকরণ প্রকাশ করেন। তাঁর নামে এই সমীকরণকে বলা হয় ডিরাক সমীকরণ। সেই সমীকরণ থেকেই জানা যায়, প্রতিপদার্থ বলতে একটা কিছুর অস্তিত্ব আছে।
এই লেখার আলোচ্য বিষয় আসলে প্রতিপদার্থ না। এ নিয়ে বিস্তারিত জানতে প্রতিপদার্থের পাঁচকাহন লেখাটা পড়া যেতে পারে।
প্রতিপদার্থের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, পদার্থ ও প্রতিপদার্থের মধ্যে সংঘর্ষ হলে এরা একে অন্যকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলে। ফলে, বেরিয়ে আসে প্রচুর শক্তি। এখান থেকে বিজ্ঞানীরা একটা সমস্যা নিয়ে চিন্তা করলেন।
আমরা যদি কোনোদিন বহিঃজাগতিক প্রাণ বা এলিয়েনের সন্ধান পাই, তারা পদার্থ দিয়ে গঠিত, নাকি প্রতিপদার্থ দিয়ে গঠিত- সেটা আমরা বুঝব কীভাবে?
১
ধরুন, আপনি অনেক দূরের কোনো গ্যালাক্সির একটি গ্রহের উপর মহাকাশযান নিয়ে চক্কর দিচ্ছেন। বুঝতে পারছেন না, জিনিসটা পদার্থ নাকি প্রতিপদার্থ দিয়ে তৈরি। মানে, নামবেন নাকি নামবেন না, সেটা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না। গ্রহের বাসিন্দা এলিয়েনরা আবার বেশ বন্ধুভাবাপন্ন। ওদের সঙ্গে আপনার এর মাঝেই রেডিওতে যোগাযোগ হয়েছে। এই গ্রহের প্রাণীরা বেশ বুদ্ধিমান। ওরা আপনার কথা বুঝছে। আর, বিজ্ঞানে যথেষ্ট অগ্রগামী হওয়ায় পদার্থ এবং প্রতিপদার্থ নিয়েও ওদের ভালো জানাশোনা আছে।
স্বাভাবিকভাবেই ওরা জোর দিয়ে বলবে, ওরা পদার্থ দিয়ে তৈরি। আসলে, নিজেরা যা দিয়ে তৈরি, সেটাকে ‘প্রতি’-পদার্থ বলবে কে? এখন, ওরা পদার্থ বলতে যা বোঝাচ্ছে, আমরাও যে সেটাই বোঝাচ্ছি- এটা নিশ্চিত হওয়ার উপায় কী? ওদের আর আমাদের অভিধান যে এক্ষেত্রে একরকম, সেটা বুঝব কীভাবে? ওরা আর আমরা একই ধরনের জিনিস দিয়ে তৈরি, নাকি ওরা প্রতি-এলিয়েন; কোন প্রশ্নটা করলে এ ব্যাপারে আমরা শতভাগ নিশ্চিত হতে পারব?
পদার্থ আর প্রতিপদার্থ যদি একদম প্রতিসম ও বিপরীত হতো, তাহলে এই সমস্যা কোনোভাবেই সমাধান করা যেত না। অবশ্য ওরকম হলেও একটা উপায় আছে। জীবন বাজি ধরে কাছাকাছি গিয়ে দেখতে হবে। কিংবা মানবহীন, স্বয়ংক্রিয় কোনো ছোট্ট যান পাঠিয়ে দেখতে হবে, ওটা বায়ুমণ্ডলে গিয়ে আঘাত করলে কী ঘটে। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যাবে, ওটা বায়ুমণ্ডল নাকি প্রতি-বায়ুমণ্ডল। তবে কী, যত বন্ধুভাবাপন্নই হোক, পদার্থ দিয়ে ওদের প্রতি-বায়ুমণ্ডল ধ্বংস করার চেষ্টা করলে, ওরা সেটাকে ভালো ভাবে নেবে বলে মনে হয় না। ব্যাপারটা তাই একটু বেশিই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়!
তাহলে উপায়?
একটা উপায় আছে! সেটা বোঝার জন্য আমাদের আগে K-মেসন বা কেওন কণা সম্পর্কে একটু জেনে নিতে হবে।
২
মহাবিশ্বে মূলত দুই ধরনের কণা আছে। পদার্থ ও শক্তির কণা। পদার্থের কণাদেরকে বলে ফার্মিওন। আর শক্তির কণাদেরকে বলে বোসন। পদার্থ ও শক্তির কণাদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, পদার্থের কণাদের ভর আছে। যেমন, ইলেকট্রন-প্রোটন-নিউট্রন ইত্যাদি। বোসন কণাদের কোনো ভর নেই। আলোর কণা ‘ফোটন’ তাই বোসন শ্রেণীর কণা। আমাদের আলোচনা এরকমই একটি বোসনকে নিয়ে।
বোসনের শত শত প্রকারের মধ্যে কেবল একটির মধ্যে পদার্থ এবং প্রতিপদার্থের সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। এই কণাটির নাম (বৈদ্যুতিকভাবে) নিরপেক্ষ কেওন (K0)।
K0 এবং এর প্রতিকণা যে বিশেষ কিছু, সেটা প্রথম বোঝা যায় ১৯৬৪ সালে। সে সময় পর্যন্ত সবাই ভাবত, পদার্থ আর প্রতিপদার্থের আচরণ একইরকম। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে বছর ব্রুকহ্যাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে করা এক এক্সপেরিমেন্ট থেকে জানা গেল, এটা সত্যি নয়। জিম ক্রোনিন এবং ভ্যাল ফিচ যখন এই আবিষ্কারের জন নোবেল পুরষ্কার পেলেন, সুইডিশ এক পত্রিকা তাদের শিরোনামে লিখে দিল, ‘প্রকৃতির নীতি ভুল!’-এটা আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে। আসলে, প্রকৃতির নীতি ভুল না। আমাদের ভাবনার চেয়ে এরা অনেক বেশি সূক্ষ্ম।
আসলে কী হচ্ছে, এটা এখন আমরা আগের চেয়ে ভালো বুঝি। এমনকি, K0 এবং এর প্রতিকণার মধ্যে যে অপ্রতিসমতা পাওয়া যায়, সেটা দেখানোর একাধিক উপায়ও আমরা খুঁজে পেয়েছি। এরকম একটি উপায় নিয়ে এখানে আমরা কথা বলব।
আসলে, K-মেসন কণা যখন ক্ষয়ে যায়, তখন একটি পাই-মেসন বা পায়ন কণা তৈরি হয়-এটা ধনাত্মক বা ঋণাত্মকভাবে চার্জিত হতে পারে। সেই সঙ্গে তৈরি হয় একটি ইলেকট্রন বা পজিট্রন। এখন, পদার্থ আর প্রতিপদার্থ যদি পুরোপুরি প্রতিসম ও বিপরীত হতো, তাহলে এই দুভাবে ক্ষয় হওয়ার হারও হতো সমান সমান। কিন্তু বাস্তবে এদের মাঝে সামান্য পার্থক্য দেখা যায়।
নিরপেক্ষ K এবং প্রতি-K প্রকৃতিতে এমনভাবে একসঙ্গে থাকে যে, এরা অনেক সময় খুব দ্রুত ধ্বংস হয়ে যায়। আর বাকি সময় এরা অনেকটা দীর্ঘজীবী হয়। সম্ভাবনা দুটো আসলে বেশ স্বতন্ত্র ধরনের। আলাদাভাবে এদেরকে বলে ক্ষণজীবী এবং দীর্ঘজীবী K-কণা। এরা প্রত্যেকেই পদার্থ এবং প্রতিপদার্থের মধ্যকার অপ্রতিসাম্য দেখায়। কিন্তু দীর্ঘজীবীদের মধ্যেই মূলত এই প্রভাবটা প্রকটভাবে দেখা যায়। এরা ক্ষয়ে যাওয়ার সময় পজিট্রন উৎপাদনের হার, ইলেকট্রন উৎপাদনের হারের চেয়ে সামান্য বেশি হয়। প্রতি দুই হাজার নমুনায় গড়ে ১,০০৩টি পজিট্রন ও ৯৯৭টি ইলেকট্রন উৎপন্ন হয়। যাক, এতক্ষণে এলিয়েনদের সঙ্গে আলোচনার কিছু একটা পাওয়া গেল, নাকি?
৩
এখন, প্রথম কাজ হলো, K-কে চিহ্নিত করা। নাম দিয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ, এলিয়েনদের একে অন্য কোনো নামে ডাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষ-এলিয়েন নির্বিশেষে সবাই একমত হবে, এমন একটা জিনিস দিয়ে একে চহ্নিত করা যাবে: এর ভর।
এর ভর প্রোটন বা প্রতিপ্রোটনের ভরের অর্ধেকের চেয়ে সামান্য বেশি। আর কোনো কণার এরকম ভর নেই, কাজেই একে আর কারো সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনাও নেই। তাই এলিয়েনদের বলতে হবে, ওদের সরল পরমাণুর কেন্দ্র ‘নিউক্লিয়াস’-এ যে ভারী কণাটা আছে, আমরা তার অর্ধেকের চেয়ে সামান্য ভারী এক ধরনের কণা খুঁজছি। এখন, ওদের সরল পরমাণু হাইড্রোজেন হোক আর প্রতি-হাইজড্রোজেন, তার কেন্দ্রে প্রোটন থাকুক বা প্রতিপ্রোটন-কোনো সমস্যা নেই। এটুকু দিয়েই K-কে নিশিচভাবে চিহ্নিত করা যাবে।
এখন আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, এই K-কণাটি আসলে K0-মানে, বৈদ্যুতিকভাবে নিরপেক্ষ। কারণ, প্রকৃতিতে K-প্লাস ও K-মাইনাস নামে ধনাত্মক ও ঋণাত্মকভাবে চার্জিত আরো দুটো কণা আছে। আমরা যে এলিয়েনদের সঙ্গে বৈদ্যুতিকভাবে নিরপেক্ষ K-কণাটি নিয়েই কথা বলছি, সেটা নিশ্চিত না হয়ে সামনে আগানো যাবে না। তাই ওদেরকে বলতে হবে, যে বৈশিষ্ট্যটি পরমাণুকে একসঙ্গে ধরে রাখে, আমরা তাকে চার্জ বা আধান বলি। আর, আমরা যে K-কণা খুঁজটি, ওটার কোনো আধান নেই। এখন, এলিয়েনরা K0 কণাটা খুঁজে পেলে বুঝবে, এটার ক্ষণজীবী এবং দীর্ঘজীবী-দুটো রূপ আছে। ওদেরকে বলতে হবে, আমরা আসলে পরেরটা খুঁজছি।
এতক্ষণে আমরা মূল পর্বে চলে এসেছি। আমাদের পদার্থ দিয়ে গঠিত জগতে যখন দীর্ঘজীবী K0 ক্ষয়ে গিয়ে পায়ন, ইলেকট্রন ও পজিট্রন তৈরি করে, তখন সে পজিট্রন তৈরি করে সামান্য বেশি। তাই, এলিয়েনদেরকে প্রশ্ন করতে হবে, ‘K-কণাটা ক্ষয়ে যাওয়ার সময় যে হালকা কণাটা বেশি তৈরি হচ্ছে, সেটা কি তোমাদের পরমাণুতে পাওয়া যায়, নাকি যায় না?’ এখন, এলিয়েনের উত্তর যদি হ্যাঁ-বোধক হয়, তার মানে, ওটা পজিট্রন: আমাদের বন্ধু এলিয়েনরা প্রতিপদার্থ দিয়ে তৈরি। সেক্ষেত্রে ওদের দিকে তাকালেও, ওদেরকে ভুলেও ছোঁয়া যাবে না।
আর, ওদের উত্তর যদি না-বোধক হয়, তার মানে ওটা ইলেকট্রন। সেক্ষেত্রে আমরা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারব, ওরাও পদার্থ দিয়েই তৈরি। এবং ওদের গ্রহে নামাটা আমাদের জন্য নিরাপদ।
হ্যাঁ, এবারে আপনি চাইলে বন্ধু-এলিয়েনের সঙ্গে চাইলে হাত মেলাতে পারেন। সমস্যা নেই!
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘বিজ্ঞান’ বিভাগে এখন থেকে লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/