শুরুর দিকে মানুষ ছিলো অনেক অসহায়। তারা বাস করতো বনে জঙ্গলে। বিভিন্ন পশুপাখি শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ করতো। আস্তে আস্তে মানুষ বিভিন্ন প্রযুক্তি আবিষ্কার করলো। তৈরি করলো নানা জিনিস। ফলে মানুষের জীবন হলো আরো সহজ, আরো নিরাপদ। আদিম যুগের সেইসব আবিষ্কার থেকে আধুনিক যুগের নিত্যনতুন প্রযুক্তি, সবই মানব সভ্যতাকে দিয়েছে অন্য এক রূপ। মানুষ এমন কিছু জিনিস আবিষ্কার করেছে যেগুলো না থাকলে আজকের পৃথিবী আমরা যেমনটা দেখছি তেমনটা হয়তো হতো না। চলুন জেনে নেই ঠিক এমনই ৮টি আবিষ্কার সম্পর্কে যেগুলো বদলে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে।
১) লাঙল
আধুনিক যুগের নিত্য নতুন নানা আবিষ্কারের কাছে লাঙল বা হাল আবিষ্কার অনেকের কাছেই কিছুটা তুচ্ছ মনে হতে পারে। কিন্তু এই লাঙলের আবিষ্কার না হলে বর্তমান পৃথিবীর অনেক কিছুই হয়তো আমরা আজকে দেখতাম না। লাঙল হলো জমি চাষের অন্যতম প্রাচীন একটি যন্ত্র। জমিতে বীজ বপন কিংবা চারা লাগানোর জন্য মাটিকে প্রস্তুত করতে এটি ব্যবহৃত হয়।
ঠিক কবে কিংবা কোথায় এই লাঙল আবিষ্কার হয়েছিলো তা সঠিক জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় এটি এককভাবে কেউ আবিষ্কার করেনি, বরং অনেকের ক্রমাগত উন্নয়ন সাধনের ফলে তা বর্তমানের রূপ পেয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগেও লাঙল ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। লাঙল বা হাল আবিষ্কারের আগে মানুষ সাধারণত পশুপাখি শিকার করতো কিংবা বিভিন্ন গাছপালা থেকে ফলমূল সংগ্রহ করে খেতো। মানুষ যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াতো খাদ্যের সন্ধানে। কিন্তু জমি চাষ করতে শেখার পর মানুষের জীবনে স্থায়িত্ব এলো। তারা নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস করে জমি চাষের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন করতে লাগলো। তবে শুধু খালি হাতে জমি চাষ করা ছিলো অনেক কষ্টসাধ্য ও সময়ের ব্যাপার। লাঙল আবিষ্কারের ফলে মানুষের এই কষ্ট দূর হলো।
লাঙল আবিষ্কারের ফলে মানুষ দ্রুত ও ব্যাপক পরিমাণে ফসল ফলাতে লাগলো। ফলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফসল বিক্রির প্রচলন শুরু হলো। আর এর থেকেই মানুষ সংখ্যা, হিসাব ইত্যাদি শিখলো। শুরু করলো ব্যবসা। আর বিপুল পরিমাণ মানুষ যখন এসবে লিপ্ত হলো তখন গড়ে উঠলো বিভিন্ন শহর। এক লাঙল আবিষ্কারের মাধ্যমেই গড়ে উঠলো মানব সভ্যতা।
২) চাকা
লাঙলের পর যে আবিষ্কারটি মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো চাকার আবিষ্কার। এটিও এতটাই পুরানো এক আবিষ্কার যে ঠিক কবে এই চাকার আবিষ্কার হয়েছিলো তা কেউ জানে না। তবে সবচেয়ে পুরানো চাকাটি পাওয়া গিয়েছিলো স্লোভেনিয়াতে খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ অব্দে।
চাকা এমনই এক জিনিস যা আবিষ্কার না হলে মানব সভ্যতা হয়তো থেমে থাকতো। পেত না কোনো গতি। চাকা আবিষ্কারের ফলে যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা হলো আরো সুবিধাজনক ও দ্রুত। ঘোড়ায় টানা গাড়ির সাথে চাকা যুক্ত করার ফলে মানুষ পেলো অন্যতম দ্রুত এক পরিবহন ব্যবস্থা।
শুধু পরিবহন ক্ষেত্রে নয়, চাকা আবিষ্কারের মাধ্যমে আরো দশ হাজারের বেশি প্রযুক্তির সূচনা হলো। বিভিন্ন পাওয়ার মিল, ফ্যাক্টরি, বিভিন্ন গিয়ার ও যন্ত্রাংশ ইত্যাদি সবই চাকার আকারে তৈরি করা হয়। বহু আধুনিক প্রযুক্তি আজ চাকার উপর নির্ভরশীল। বাস, ট্রেন, উড়োজাহাজ, পাওয়ার প্লাট, ইলেকট্রিক মোটর, জেট ইঞ্জিন ইত্যাদি চাকা ছাড়া কল্পনা করা অসম্ভব।
৩) ছাপাখানা
জোহান গুটেনবার্গ ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম ছাপাখানা আবিষ্কার করেন। এর আগেও মানুষ কাগজ ও ব্লক প্রিন্টিং পদ্ধতি জানতো। তবে ছাপাখানার মাধ্যমে বইয়ের মুদ্রণ প্রথম চালু করেন গুটেনবার্গ।
গুটেনবার্গ ব্লক প্রিন্টিং ও স্প্রিং প্রেসের সমন্বয় ঘটান। এছাড়াও তিনি ধাতব প্রিন্টিং ব্লক চালু করেন যা আগের কাঠের তৈরি অক্ষরের ব্লকগুলোর থেকে ছিলো অনেক বেশি নিখুঁত ও টেকসই। তিনি মুদ্রণের কালি ও কাগজ তৈরিতেও আনেন অনন্য পরিবর্তন যা পরবর্তীতে মুদ্রণ ব্যবস্থায় আনে বিপ্লব।
ছাপাখানা আবিষ্কারের ফলে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণ ও তা মানুষের মাঝে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলো। ছাপাখানা আবিষ্কারের আগে যেসব বই মুদ্রিত হতো তা ছিলো অনেক দামী। শুধুমাত্র ধনীরাই এ ধরণের বই কিনে পড়তে পারতো। কিন্তু ছাপাখানা আবিষ্কারের মাধ্যমে মুদ্রিত বইয়ের দাম কমে গেলো। বই মানুষের কাছে হলো সহজলভ্য। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষ অগ্রগতি লাভ করলো। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের পর্যাপ্ত শিক্ষা লাভ করতে পারলো এই ছাপাখানার মাধ্যমে। তাই ছাপাখানা আবিষ্কার না হলে হয়তো পৃথিবীর অনেক অংশেই পৌঁছাত না শিক্ষার আলো।
৪) যোগাযোগ মাধ্যম
যোগাযোগ মাধ্যমের মূল আবিষ্কারগুলো হলো টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, রেডিও ও টেলিভিশন। ১৮৩৬ সালে স্যামুয়েল মোর্সের টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের পর থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসে অনন্য পরিবর্তন। এরপর টেলিফোন আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষ অন্য একজন মানুষের প্রকৃত কণ্ঠস্বর বহুদূরে বসেও শুনতে সক্ষম হয়। ফলে কমে যায় মানুষের মধ্যবর্তী দূরত্ব।
বিশ শতকের শুরুতে গুগলিয়েলমো মার্কোনি ও নিকোলা টেসলা বৈদ্যুতিক তরঙ্গের মাধ্যমে তারবিহীন সংকেত প্রেরণের প্রচলন করেন। আবিষ্কার হয় রেডিও। এরপর শব্দের সাথে সাথে ছবিও তরঙ্গের আকারে প্রেরণ করতে সক্ষম হয় মানুষ। এর মাধ্যমে আবিষ্কার হয় টেলিভিশন। আর এ আবিষ্কারের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট বার্তা লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে একযোগে সম্প্রচার করা সম্ভব হয়ে উঠে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার এমন উন্নয়নের ফলে পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তের মানুষের কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়। যেখানে আগে এক দেশ হতে অন্যদেশে খবর পাঠাতে লাগতো কয়েক সপ্তাহ সেখানে এসব প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে এখন পৃথিবী অন্য প্রান্তে কী ঘটছে তা আমরা এখন সরাসরি নিজ বাসায় বসে দেখতে পাই।
৫) স্টিম ইঞ্জিন
স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের আগে কলকারখানার বেশিরভাগ পণ্যই হাতে তৈরি হতো। এছাড়া পানি চালিত কিংবা পশু টানা যন্ত্রগুলোই ছিলো শক্তির প্রধান উৎস। ১৭১২ সালে থমাস নিউকোমেন সর্বপ্রথম বাষ্পকে কাজে লাগিয়ে পানির পাম্পের ইঞ্জিন তৈরি করেন। এরপর ১৭৬৯ সালে জেমস ওয়াট নিউকোমেনের এই ইঞ্জিনের কিছু পরিবর্তন আনেন। তিনি ইঞ্জিনে পানি থেকে বাষ্প প্রস্তুতকারী যন্ত্র সংযুক্ত করেন। ফলে ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতা আরো বেড়ে যায় আর ইঞ্জিনটি হয় আরো ব্যবহারযোগ্য। তার তৈরি এই ইঞ্জিন ঘূর্ণন শক্তি উৎপন্ন করতে পারতো।
জেমস ওয়াটের এই ইঞ্জিন আবিষ্কারের ফলে মানুষ ইঞ্জিন চালিত গাড়ি তৈরি করতে সক্ষম হলো। সেই সাথে তৈরি হলো ইঞ্জিন চালিত রেলগাড়ি। ফলে দ্রুতগতিতে এক স্থান হতে অন্য স্থানে যেতে সক্ষম হলো মানুষ। রেলগাড়ি কিংবা মোটরগাড়িতে ব্যবহার ছাড়াও স্টিম ইঞ্জিন ব্যবহৃত হতে লাগলো বিভিন্ন কলকারখানায়। কলকারখানা উৎপাদনের পরিমাণ গেলো বেড়ে। মানব সভ্যতা পেলো অনন্য এক গতি। এই স্টিম ইঞ্জিনের ব্যবহার বর্তমান এই আধুনিক যুগেও বিদ্যমান রয়েছে। এখনো বহু পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য স্টিম চালিত টার্বাইন ব্যবহার করা হয়।
৬) বৈদ্যুতিক বাতি
টমাস আলভা এডিসনকে আমরা বৈদ্যুতিক বাতির জনক হিসেবে জানলেও ১৮৭০ সালের দিকে প্রায় এক ডজন লোক এটির আবিষ্কার নিয়ে কাজ করছিলেন। এডিসন এই বিদ্যুতিক বাতির অনেক উন্নয়ন সাধন করেন। ঠিক এই সময়ই ব্রিটেনে জোসেফ সোয়ান নামের একজন এই একই জিনিস নিয়ে কাজ করছিলেন। পরবর্তীতে এডিসন ও সোয়ান দুজনে মিলে ‘এডিসোয়ান’ নামে বৈদ্যুতিক বাতি তৈরির একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
বৈদ্যুতিক বাতিতে একটি ফিলামেন্ট বা সরু তারের মধ্যদিয়ে বিদ্যুৎ চালনা করা হয়। ফলে ফিলামেন্টটি থেকে আলো ও তাপ নির্গত হয়। ফিলামেন্টটি যাতে দ্রুত জ্বলে না যায় তাই এটিকে উচ্চ রোধ বিশিষ্ট পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয় এবং একটি বায়ুহীন বাল্বের মধ্যে রাখা হয়।
বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের ফলে ঘরে বাইরে, অফিসে সব খানে সহজে আলোর ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। এর আগে গ্যাস ল্যাম্পের মতো অন্যান্য আলোর উৎস থাকলেও বিদ্যুৎ বাতির মতো সহজে তা সবখানে ব্যবহার করা যেত না। বৈদ্যুতিক বাতিই পৃথিবীর বহু অংশে পৌছে দিয়েছে আলো।
৭) কম্পিউটার
কম্পিউটার বলতে আমরা আজকাল ডেক্সটপ কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপ বুঝি। কিন্তু কম্পিউটার হচ্ছে এমন এক যন্ত্র যাতে কোনো তথ্য বা উপাত্ত প্রবেশ করালে সেই তথ্যকে নিপুণভাবে ব্যবহার নতুন তথ্য বা ফলাফল পাওয়া যায়। কম্পিউটার মানে গণনাযন্ত্র। চার্লস ব্যাবেজকে কম্পিউটারের জনক বলা হলেও বহু মানুষের হাত ধরে কম্পিউটার আজকের অবস্থায় এসেছে। আঠার শতকের দিকে বহু মেকানিকাল কম্পিউটার থাকলেও ইলেক্ট্রনিক কম্পিউটার এসেছে বিশ শতকের দিকে।
কী করা যায় না এই কম্পিউটার দিয়ে! কঠিন কঠিন গাণিতিক সমস্যা মুহূর্তের মধ্যেই সমাধান করে দিতে পারে কম্পিউটার। গান শোনা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ভিডিও দেখা প্রভৃতি আমাদের প্রতিদিনের সাধারণ কাজের পাশাপাশি আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হয় এই কম্পিউটার। মহাকাশ গবেষণা, সামরিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় কম্পিউটারই একমাত্র ভরসা। কম্পিউটার আবিষ্কার না হলে মানব সভ্যতা অনেক বেশি পিছিয়ে থাকতো। মানব সভ্যতার বিশাল একটি অংশ এখন কম্পিউটারের উপর নির্ভরশীল।
৮) ইন্টারনেট
যে আবিষ্কারটি গোটা বিশ্বকে সবচেয়ে বেশি বদলে দিয়েছে সেটি হলো ইন্টারনেট। ইন্টারনেট হলো গোটা পৃথিবী জুড়ে এমন এক নেটওয়ার্ক যা যুক্ত করেছে প্রতিটি মানুষকে। যার মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো তথ্য যে কেউ যখন খুশি তখন পেতে পারে। কোথায় নেই ইন্টারনেটের ছোঁয়া! ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিনোদন সব ক্ষেত্রেই ভূমিকা রেখেছে ইন্টারনেট।
১৯৬০ সালে DARPA (Defense Advanced Research Projects Agency) নামের আমেরিকান সামরিক বাহিনীর একটি অংশ ARPANET নামের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যাতে সামরিক কাজের জন্য ব্যবহৃত সকল কম্পিউটার যুক্ত ছিলো। এরপর ১৯৭০ সালের দিকে চালু হলো বিভিন্ন নেটওয়ার্ক। কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা তৈরি করলেন এমন এক নেটওয়ার্ক যাতে এক নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকা এক কম্পিউটারকে অন্য নেটওয়ার্কে যুক্ত কম্পিটারের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। এটাই ছিলো ইন্টারনেটের প্রাথমিক অবস্থা। এর পরবর্তী দশ বছরে ইন্টারনেটের বহু উন্নতি সাধিত হয়। ফলে ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে।
ইন্টারনেট এমনই শক্তিশালী একটি আবিষ্কার যার ফল আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে শুরু করেছি। মানব সভ্যতা বর্তমানে পুরোপুরি ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ডিজিটাল পৃথিবী সৃষ্টির পেছেনে মূল ভূমিকা ইন্টারনেটের। ইন্টারনেট গোটা পৃথিবীকে পরিণত করেছে ছোট্ট একটি গ্রামে, যেখানে মুহূর্তের মধ্যেই এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের সকল খবরাখবর নেওয়া যায়। বিভিন্ন তথ্য অনেক সহজলভ্য হয়েছে এই ইন্টারনেটের মাধ্যমেই। এখন আমাদের একদিনও চলে না এই ইন্টারনেট ছাড়া। আমাদের জীবনধারাকে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে এটি। সামনের দিনগুলোতেও ইন্টারনেট আমাদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে এমনটাই আশা করেন ভবিষ্যতবিদরা।