আবিষ্কারের জন্য অনুশোচনায় ভোগা আবিষ্কারকেরা

মানুষ নিত্যনতুন সমস্যার সমাধানের জন্য প্রতিনিয়তই নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করে চলছে। ছোটখাট আবিষ্কার থেকে বড় বড় আবিষ্কারগুলোও মানুষের জীবনযাত্রা করে তুলছে আরো সহজ। ক্ষুদ্র সেফটি পিনও আজকাল জীবনযাত্রার অপরিহার্য অংশ। আবিষ্কারকদেরও তাই স্মরণ করা হয় শ্রদ্ধাভরে।

তবে কিছু কিছু আবিষ্কারক নিজেদের আবিষ্কার নিয়ে ভুগেছেন হতাশায়। তাদের মতে, সেগুলো আবিষ্কার করাই ছিলো তাদের ভুল কাজ। আজ আমরা জানবো এমন সব আবিষ্কারের কথা, যেগুলোর জন্য পরবর্তীতে অনুতাপ করে গেছেন তারা।

ইথান জুকারম্যান – পপ আপ

এমআইটি’র অধ্যাপক ইথান জুকারম্যান তরুণ বয়সেই কোডিংয়ের উপর দক্ষ ছিলেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সেই ট্রাইপড ডট কম নামে এক ইন্টারনেট স্টার্ট আপের সাথে কাজ শুরু করেন তিনি।

১৯৯৬ সালে জুকারম্যানকে নতুনভাবে সাইটে বিজ্ঞাপন দেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর তখনই তিনি তৈরি করে বসেন পপ আপ অ্যাডস। পপ আপ এর আভিধানিক অর্থ হছে আকস্মিক বা হঠাৎ দৃশ্যমান। পপ আপ অ্যাডগুলো যেকোনো মূহুর্তে আপনার ব্রাউজকৃত সাইটে অনুমতি ছাড়া চলে আসবে। আর তাতে করেই মানুষের বিরক্তির উদ্রেক হয়। বেশিরভাগ মানুষই পপ আপ অ্যাডে নিজেদের বিরক্তির কথা জানান। সেই পরিপেক্ষিতে অপেরা মিনি সর্বপ্রথম পপ আপ অ্যাড ব্লক করার অপশন চালু করে। পরবর্তীতে মজিলা ফায়ারফক্স ও অন্যান্য ব্রাউজারগুলোতেও পপ আপ অ্যাড ব্লক করার সুবিধা যুক্ত করা হয়।

অবশ্য ইথান জুকারম্যান পরবর্তীতে নিজেই পপ আপ অ্যাড আবিষ্কারের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার কোডিংয়ের উদ্দেশ্য ছিলো ভিন্ন। কিন্তু শেষপর্যন্ত এভাবে ব্যাপারটা শেষ হওয়াও তিনি সবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

মানুষের বিরক্তির উদ্রেক করা পপ আপ অ্যাডস; Image Source: The Times

ওয়েলি কনরন – ল্যাব্রাডুডল

অস্ট্রেলিয়ার রয়্যাল গাইড ডগ অ্যাসোসিয়েশন কুকুর ছানার বেড়ে তোলার জন্য এক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন ওয়েলি কনরন। ১৯৮০ সালে কনরনকে একজন অন্ধ মহিলাকে গাইড করানোর জন্য একটি নন শেডিং কুকুরছানার নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কনরন একটি গোল্ডেন ল্যাব্রাডরের সাথে একটি পোডল কুকুর ছানার সংকরায়নে ল্যাব্রাডুডল নামে নতুন এক প্রজাতির কুকুর ছানার আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে ল্যাব্রাডুডল নামে নতুন এই প্রজাতির এই কুকুর হয়ে ওঠে সবচেয়ে আকাঙ্খিত কুকুর ছানা। আপনি হয়তো ভাবছেন, এতে কনরন অনেক খুশি হয়েছিলেন। আদতে মোটেও তা নয়।

তার দেখাদেখি অন্য অনেকেই নতুন প্রজাতির কুকুর ছানা আবিষ্কারের নেশায় সব ধরনের প্রজাতির সংকরায়ণ শুরু করে। গোল্ডেনডুডল থেকে শুরু করে রোডলস, শিফুস ও আরো নানা জাতের হাইব্রিড কুকুরের উৎপত্তি হয়। যার ফলে নতুন প্রজাতির কুকুরগুলো বেশিরভাগই বিভিন্ন দৈহিক সমস্যা নিয়ে জন্মাতে শুরু করে।

এই প্রসঙ্গে পরে কনরন বলেছেন, তিনি একটি প্যান্ডোরার বক্স খুলেছেন। আর শত শত মানুষ টাকার লোভে নানা প্রজাতির কুকুর ছানা সংকরায়ন শুরু করে। অথচ কেউই অক্ষম কুকুর জন্মানোর হারের দিকে কর্ণপাত করলো না। নিজের আবিষ্কার নিয়ে বাকি সময় ধরে অনুতাপই করে গেছেন কনরন।

সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ল্যাব্রাডুডল কুকুর ছানা; Image Source: Wagberg

আনা জারভিস – মাদার্স ডে

উনিশ শতকের দিকে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে বসবাসরত আনা জারভিস নামে এক ভদ্রমহিলা ‘মাদার্স ডে ওয়ার্কস ক্লাব’ নামে একটি সংঘ গড়ে তোলেন। সংঘটির দায়িত্ব ছিলো সন্তানদের কীভাবে দেখভাল করতে হবে তা শিখিয়ে দেওয়া। পরবর্তীতে এই সংঘটির দ্বারাই সূচিত হয় মাদার্স ডে পালন করার প্রথা।

১৯০৫ সালে আনা জারভিসের মায়ের মৃত্যুর পর তিনি এই প্রস্তাব উত্থাপিত করেন। ১৯০৮ সালের ১০ মে আনা বিশেষভাবে তার মাকে স্মরণ করার জন্যে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার চার্চে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। ১০ মে-কে সরকারিভাবে মাদার্স ডে হিসেবে পালন করার জন্য ছুটিরও আবেদন করেন তিনি। ১৯১৪ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মাদার্স ডের জন্য সরকারি ছুটির ঘোষণা করেন।

সারাজীবন ক্যালেন্ডারে মাদার্স ডে-কে স্থান দেওয়ার জন্য লড়ে যাওয়া আনা জারভিস কিছুদিন পরই বেঁকে বসেন। তিনি চেয়েছিলেন মাদার্স ডে পালিত হবে পরিবার সহ ঘরোয়াভাবে। কিন্তু ক্রমেই পুরো দিনটি হয়ে ওঠে বাণিজ্যিক। সবাই ফুল কিংবা উইশকার্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তিনি লোকজনকে এসব কিনতে নিষেধ করেন। কিন্তু সময়ের সাথে ব্যাপারটা হয়ে ওঠে আরো বাণিজ্যিক। ১৯২০ সালে তাই আবার সোচ্চার হয়ে ওঠেন জারভিস। এবার ঠিক উল্টো কারণে। আমেরিকান ক্যালেন্ডার থেকে মাদার্স ডে বাদ দেওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করেন তিনি। অবশেষে তার মৃত্যুর পর ১৯৪৮ সালে ছুটির দিনটি উঠিয়ে নেওয়া হলেও মাদার্স ডে এখনো বিশ্বজুড়ে আড়ম্বরের সাথেই পালিত হয়।

পুরো বিশ্বজুড়ে বেশ আড়ম্বরের সাথেই পালিত হয় মা দিবস; Image Source: India .com

মিখাইল কালাশনিকভ – একে ৪৭

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারণাস্ত্রের দিক দিয়ে জার্মানদের থেকে বেশ পিছিয়ে ছিলো রাশিয়ানরা। মিখাইল কালাশনিকভ নামে এক লোক, যিনি কি না ট্যাংক ইউনিটে কাজ করতেন, এক নতুন উদ্ভাবনী ক্ষমতা নিয়ে আবির্ভূত হন। ইতিমধ্যেই ট্যাংকের উন্নতি সাধন করে নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতার জানান দেন মিখাইল।

নাৎসি বাহিনীর সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য মিখাইল তৈরি করেন নতুন এক ধরনের মারণাস্ত্র। স্বয়ংক্রিয় সেই অস্ত্রটি টেকসই এবং হালকা হওয়ায় ক্রমেই তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একে ৪৭ নামের এই অস্ত্রটি হয়ে ওঠে সন্ত্রাসীদের প্রধান হাতিয়ার।

পরবর্তীতে নিজের এই আবিষ্কারের জন্য অনুতাপে ভোগেন মিখাইল। দ্যা গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিখাইল কালাশনিকভ বলেন, তিনি এমন যন্ত্র আবিষ্কারে খুশি হতেন যা লোকজন যুদ্ধে ব্যবহার করার পর প্রয়োজনে চাষাবাদেও ব্যবহার করতে পারতো।

নিজের আবিষ্কার হাতে কালাশনিকভ; Image Source: Business Insider

স্কট ফ্যালমান – ইমোটিকন

আজকাল অনলাইন চ্যাটিংয়ে ইমোটিকন হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় একটি বিষয়। মানুষ এখন শব্দের চেয়ে সুন্দর একটি ইমোজি ব্যবহারকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। আর এই বহুল ব্যবহৃত ইমোজির উদ্ভাবক স্কট ফ্যালমান। তবে হঠাৎ করে প্রচুর জনপ্রিয়তা পাওয়া এই ইমোটিকন আবিষ্কার করে মোটেই খুশি নন এই ভদ্রলোক।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, নিজেকে তার মাঝে মাঝে ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো মনে হয়। কিছু জায়গায় কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু মানুষ ইমোজি ব্যবহারে বেশিই আসক্ত হয়ে পড়েছে। যার জন্য নিজের আবিষ্কার নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নন ফ্যালমান।

ইমোটিকনের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে; Image Source: Wall Street Journal

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন – পারমাণবিক বোম

পারমাণবিক বোমের সরাসরি আবিষ্কারক না হলেও স্বনামধন্য বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের বিখ্যাত সুত্র E = mc^2 এর উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে ভয়াবহ এটি। নিজের আবিষ্কারে প্রথমে খুশিই ছিলেন আইনস্টাইন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা তাকে মর্মাহত করে। বিশেষ করে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমটির বিস্ফোরণ পৃথিবীর অন্যান্য মানুষের মতো আইনস্টাইনকেও হতভম্ব করে দেয়।

নিজের এই আবিষ্কার নিয়ে পরবর্তীতে অনুতাপও করেন বিংশ শতাব্দীর এই শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। ১৯৪৭ সালে নিউজউইককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পারমাণবিক বোমের এই ভয়াবহতা আগে টের পেলে কখনোই এমন কিছু আবিষ্কার করতেন না তিনি।

হিরোশিমাতে পারমাণবিক বোমা হামলার ভয়াবহতা; Image Source: Getty Image

This article is about the invention for which scientists regreted later. Necessary references are hyperlinked in the article. 

Feature Image : Getty Image

Related Articles

Exit mobile version