বইপত্রে কিংবা আবহাওয়া সংবাদে কিংবা রেডিও বা টেলিভিশনে অনেক সময় বলা হয়- “আজকে ডিসেম্বরের একুশ তারিখ, অর্থাৎ আজকে থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শীতকালের শুরু”। অর্থাৎ ডিসেম্বরের ২১ তারিখ হচ্ছে শীতকালের প্রথম দিন (অনেক সময় তারিখটি ২২ হয়ে থাকে, এই তারিখ বছরে বছরে পরিবর্তন হতে পারে)। ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞান বা ভূগোল বইতে আমাদেরকে যে এই বিষয় সম্পর্কে পড়ানো হয় সেটা কতটুকু নির্ভরযোগ্য? কারণ দেখা যায়, অনেক বছরে ডিসেম্বরের শুরুর দিকেও বেশ ভালো শীত পড়ে যায়। কিছু কিছু অঞ্চলে লেপ, কম্বল ইত্যাদি মুড়ি দিয়ে মানুষ ঘুমোতে যায়। তাহলে কি ২১ বা ২২ তারিখের আগের সময়ে যে শীত পড়ে সেটা শীতকালের ভেতরে পড়বে না? তাহলে সেই দুই-তিন সপ্তাহ কোন ঋতুর মধ্যে পড়বে?
এরকমটি যে আসলেই হয় সেটা প্রতি বছর এই সময়টাতে একটু লক্ষ্য করলেই আমরা বুঝতে পারবো। কিন্তু কেন এমন হয়? আমাদের কি তাহলে ভুল পড়ানো হয়, নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে এর মধ্যে?
সত্যি বলতে কি, আমাদেরকে মোটেও ভুল পড়ানো হয় না। কথাটি ঠিকই আছে। কিন্তু সেখানে একটি তথ্য সাধারণত দেয়া থাকে না যেটা দেয়া উচিত। উত্তর গোলার্ধে ডিসেম্বরের ২১ তারিখ হচ্ছে আসলে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল বা জ্যোতির্বিদ্যা অনুযায়ী প্রথম দিন, ঠিক যেমনটি জুনের একুশ তারিখ হচ্ছে জ্যোতির্বিদ্যা অনুযায়ী উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল শুরু হওয়ার প্রথম দিন।
আমরা জানি যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে। এই চারদিকে ঘুরবার সময় পৃথিবী কিন্তু নিজ অক্ষের সাথে ২৩.৫ ডিগ্রি কোনে হেলে থাকে। পৃথিবীর এই হেলে থাকার কারণে পৃথিবী থেকে যখন আমরা সূর্যকে দেখি তখন দেখা যায় যে ডিসেম্বর মাসের এই একুশ তারিখে দক্ষিণ অক্ষাংশের ২৩.৫ ডিগ্রির একদম সরাসরি উপরের দিকে এটা অবস্থান করে। ঠিক একই রকম ঘটে জুনের একুশ তারিখেও, যখন সূর্য উত্তর অক্ষাংশের ২৩.৫ ডিগ্রির সরাসরি উপরের দিকে অবস্থান করে। সে কারণে এই দিনগুলোকে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল বা জ্যোতির্বিদ্যা নির্ভর দিন-তারিখ হিসেবে গণ্য করা হয়। ঠিক একই ব্যাপার ঘটে মার্চ মাসের বিশ তারিখে এবং সেপ্টেম্বর মাসের ২২ তারিখেও। মার্চ মাসের ২০ তারিখ হচ্ছে বসন্তকাল শুরুর প্রথম দিন। এই দিনেই সূর্য বিষুবরেখা অতিক্রম করে উত্তর দিকে যেতে থাকে। আবার সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখও শরৎকালের প্রথম দিন, যখন সূর্য বিষুবরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ দিকে যেতে থাকে।
পৃথিবীর মাঝামাঝি অক্ষাংশগুলোতে সবচেয়ে গরম পড়ে গ্রীষ্মকালে এবং সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা পড়ে শীতকালে। এই অঞ্চলে এই দুটি ঋতুর প্রভাব একটু বেশিই দেখা যায়। এই অঞ্চলের পুরো একটি বছরকে যদি চারভাগে ভাগ করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে গরম মাসগুলো হচ্ছে জুন, জুলাই এবং আগস্ট। সবচেয়ে শীতকালের সময় হবে ডিসেম্বর, জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি। বাকি যে ছয় মাস আছে সেখানে থাকবে শরৎকাল, যেটা সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বর মাস জুড়ে থাকবে। এই মাসগুলো হচ্ছে গ্রীষ্মকাল থেকে শীতকালে যাওয়ার ক্রান্তিকাল।
আবার বসন্তকাল হবে মার্চ, এপ্রিল এবং মে। এই তিন মাস হচ্ছে শীতকাল থেকে গ্রীষ্মকালে যাওয়ার ক্রান্তিকালের সময়। সময়ের উপর ভিত্তি করে উপরে যে ঋতু পরিবর্তন এবং এই পরিবর্তনের কার্যক্রিয়া ব্যাখ্যা করা হলো, এই সময়কে বলা হয়ে থাকে আবহাওয়ার ভিত্তিতে ঋতু পরিবর্তন সময়। আমাদের জন্য এই পরিবর্তন বোঝা সোজা, কারণ বছরের হিসেবে ঋতু পরিবর্তনের সাথেই আমাদের দেশের সবাই পরিচিত। আমাদের দেশে আবার ঋতুকে ছয়ভাগে ভাগ করা হয়েছে। গ্রীষ্মের পরে এখানে বর্ষাকাল আসে, আবার শরৎকালের পর হেমন্তকাল ধরা হয়। তাই আমাদের দেশে ছয় ঋতু দুই মাস করে ধরা হয়ে থাকে।
তাই প্রথমেই যে বলা হয়েছিলো ডিসেম্বরের ২১ তারিখে শীতের শুরু সেটা আসলে অসম্পূর্ণ তথ্য। আমাদেরকে বলতে হবে যে, জ্যোতির্বিদ্যা অনুযায়ী ডিসেম্বরের এই দিনটিতে শীতকাল শুরু হয়। কিন্তু আবহাওয়ার ভিত্তিতে শীতকাল আরও আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে। আবহাওয়ার নিয়মানুসারে সেটা ডিসেম্বর মাসেই শুরু হয়ে যায়। তাই ঋতু পরিবর্তন হিসাবের জন্য বার্ষিক পরিবর্তনের যে ছবি আমাদের বইগুলোতে দেয়া থাকে এবং আমাদেরকে যা শেখানো হয় সেখানে এই তথ্যটি সংযোজন করে দিলে পুরো বিষয়টিকে সম্পূর্ণ তথ্য হিসেবে বিবেচনা করা যাবে।
উপরের আলোচনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, পৃথিবীর বার্ষিক গতি দুভাবে হিসাব করার ফলে এবং একটির ধারণা আরেকটির সাথে গুলিয়ে গিয়ে একটি বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। কারণ অনেক সময় ছোট ছোট বাচ্চারা, যারা সবচেয়ে বড় দিন, সবচেয়ে ছোট দিন ইত্যাদি নিয়ে প্রথম পড়াশোনা শুরু করে তখন নানারকম প্রশ্ন তাদের মাথায় আসে। বড়দের কাছে এগুলো নিয়ে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যায় যে, শীতকালে রাত বড় হয় আর দিন হয় ছোট, আবার গ্রীষ্মকালে ঠিক তার উল্টোটি দেখা যায়। ডিসেম্বরের ২১ তারিখে রাত সবচেয়ে বেশি বড় হচ্ছে। আবার বিভিন জায়গায় লেখা থাকে যে, এই দিন থেকে শীতকাল শুরু অথচ প্রতি বছর দেখা যায় শীতকাল আরও আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই এই বিষয়গুলো বাচ্চাদের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে এবং এই সদুত্তর না পেয়ে অনেক সময় বাচ্চাদের প্রশ্ন করে জেনে নেয়ার অভ্যাসটিও শেষ হয়ে যায়। তাই এই বিষয়টিকে পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করার প্রয়োজন ছিল।
সত্যি কথা বলতে কি, সারা বিশ্ব এখন আবহাওয়াভিত্তিক ঋতু অনুসরণ করে। ১৯৫০ সালের দিকেও কিন্তু আবহাওয়া ভিত্তিক ঋতুর কথা কেউ জানতো না। এটা শুরু হয়েছে পঞ্চাশের দশকের কিছুদিন পর থেকে। National Climatic Data Center (NCDC) এর বক্তব্য অনুযায়ী আবহাওয়াবিদ এবং জলবায়ুবিদদের জন্য জ্যোতির্বিদ্যাভিত্তিক দিনকাল থেকে মাস ভিত্তিক দিনকাল বেশি উপযোগী। কারণ জ্যোতির্বিদ্যাভিত্তিক যে সময় গণনা করা হয় সেটা মাসের মাঝামাঝি কোনো দিন থেকে শুরু হচ্ছে। কিন্তু আবহাওয়ার ক্ষেত্রে সেটা মাসের প্রথমেই গণনা করা শুরু হচ্ছে। তাই যেকোনো গাণিতিক হিসাবের জন্য এবং আবহাওয়াভিত্তিক বাৎসরিক পরিসংখ্যান তৈরির জন্য আবহাওয়াভিত্তিক ঋতু পরিবর্তন দিয়ে হিসাব করলে সাধারণ মানুষেরও বুঝতে সুবিধা হয়। ভাঙা মাস থেকে গণনা শুরু করলে বিষয়টি অনেক সময় জটিলতা তৈরি হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র
[১] Ahrens, C.D. Essential of Meteorology: An Invitation to the Atmosphere, Third Edition
[২] Turbuck, E and Lutgens, F. The Atmoshphere- An Introduction to Meteorology, 12th Edition
ফিচার ইমেজ সোর্স: KRMG.com