১৯৮১ সালে আমেরিকান লেখক ডিন কুন্তয ‘আইজ অব ডার্কনেস’ নামে একটি থ্রিলার উপন্যাস লেখেন। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বইয়ের গল্পে বলা হয়েছে একটি ভাইরাস মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ে, যার দ্বারা আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুর হার শতভাগ!
ভাইরাসটি তৈরি করা হয় চীনের উহান শহরের বাইরে একটি পরীক্ষাগারে। নাম দেয়া হয় উহান-৪০০! কারণ, মহামারি ভাইরাসটি ছিল চারশতম স্ট্রেইন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইয়ের ভাইরাস সম্পর্কিত তথ্যের পৃষ্ঠাগুলো শেয়ার দেয়া হচ্ছে। ত্রিশ বছর আগের বইয়ের কাহিনীর সাথে বর্তমানে মহামারি করোনাভাইরাসের মিল পাওয়ায় অনেকে মনে করছেন এটি উহান শহরের পরীক্ষাগারে চীনাদের তৈরি একটি জীবাণু অস্ত্র!
বাস্তবে বইয়ের সাথে করোনাভাইরাসের এতটুকুই মিল। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুর হার শতভাগ নয়। উহান-৪০০ খুব দ্রুত সংক্রমিত করে। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণের লক্ষণ প্রকাশ করে ১-১৪ দিন পর, যাকে বলা হয় ইনকিউবেশন পিরিয়ড।
বইয়ের ঘটনা না হয় কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু করোনাভাইরাসও কি জীবাণু অস্ত্র নয়? কন্সপিরেসি থিওরিস্টরা বলছেন, চীন বিশ্বজুড়ে নিজের একক আধিপত্য সৃষ্টি করতে ইচ্ছাকৃতভাবে এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে। ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটারে বেশ ভালোভাবেই ছড়িয়ে পড়েছে এই কন্সপিরেসি থিওরি। বাংলাদেশেও শিক্ষিত জনগণের একটা বড় অংশ এটা বিশ্বাস করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গেলেই বোঝা যায়।
শুধু সাধারণ মানুষই নয়, রাজনীতিবিদরাও আছেন এই দলে। এক্ষেত্রে চীন এবং আমেরিকা একে অপরকে দোষারোপ করছে। অন্যদিকে ইরানও বলছে এই ভাইরাস আমেরিকার তৈরি জৈবাস্ত্র!
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর টম কটন জানুয়ারির ৩১ তারিখে টুইটারে একটি পোস্ট দেন। এতে লেখেন,
আমরা এখনও জানি না করোনাভাইরাস কোথা থেকে এসেছে। এটা কোনো বাজার, খামার কিংবা খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে আসতে পারে। আমি শুধু এটা মনে করিয়ে দিতে চাই, উহান শহরে চীনের একমাত্র বায়োসেফটি লেভেল-৪ (পরীক্ষাগারে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা স্তর) এর পরীক্ষাগারটি অবস্থিত। এখানে সবচেয়ে ভয়ংকর সংক্রামক ভাইরাসগুলো নিয়ে কাজ করা হয়, যার মধ্যে করোনাভাইরাসও আছে।
অর্থাৎ তিনি পরোক্ষভাবে বলছেন, করোনাভাইরাস চীনের উহান শহরের পরীক্ষাগারে তৈরিকৃত মানবসৃষ্ট ভাইরাস। রিপাবলিকান অন্যান্য নেতারাও এমন ধারণা পোষণ করেন। তাদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও আছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ রিপাবলিকান নেতারা ভাইরাসটিকে ক্রমাগত ‘চাইনিজ ভাইরাস’ বলে যাচ্ছেন। ট্রাম্প অবশ্য বলছেন এটা চীনারা মার্কিন সেনাবাহিনীর ওপর দোষ চাপানোর প্রতিবাদে এটা করছেন। হ্যাঁ চীনারাও বসে নেই। তারাও নিজেদের মতো কন্সপিরেসি থিওরি প্রচার করছে।
চীনাদের দাবি, চীনে অনুষ্ঠিত গত বছর বিশ্ব মিলিটারি ক্রীড়া প্রতি্যোগিতায় এসে মার্কিন সেনারা এই ভাইরাস ছড়িয়ে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর আগস্টে নিউমোনিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। তারা এই দায় ই-সিগারেটের ওপর চাপিয়ে নিজেদের বানানো ভাইরাস লুকিয়ে ফেলে বলা হচ্ছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান টুইটারে ক্রমাগত পোস্টের মাধ্যমে বলে যাচ্ছেন এই ভাইরাস আমেরিকানদের তৈরি।
এদিকে ইরানও করোনাভাইরাস মহামারির জন্য আমেরিকানদের দায়ী করছে। ইরানের ইসলামি রেভ্যুলেশনারি গার্ডের কমান্ডার হোসেন সালামি বলেছেন, করোনাভাইরাস আমেরিকানদের তৈরি জীবাণু অস্ত্র হতে পারে। ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদও আছেন এই দলে। তিনিও টুইটারে পোস্ট করে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এটা মানবসৃষ্ট জৈবাস্ত্র।
এসব তত্ত্বের আগুনে ঘি ঢালছে গণমাধ্যম। রাশিয়ান গণমাধ্যমে আবার দায়ী করা হচ্ছে যুক্তরাজ্যকে! সরকার-সমর্থিত স্পুৎনিক রেডিওতে প্রচারিত এক অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, ব্রেক্সিটের পর বাজার খুলে দেওয়ার জন্য চীনকে বাধ্য করতে ব্রিটেন এই কাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে। আবার অনেকে বলছেন ইচ্ছাকৃতভাবে না ছড়ালেও চীনের পরীক্ষাগার থেকে দুর্ঘটনার মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে যেতে পারে।
এসব কন্সপিরেসি থিওরি বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কোনোটার পক্ষেই কি প্রমাণ আছে? বিজ্ঞানীরা নেতিবাচক উত্তরই দিচ্ছেন। তারা এই ভাইরাসের উৎস খুঁজে বের করতে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে একটি ব্যাপারে তারা নিশ্চিত, এটি কোনো মানবসৃষ্ট ভাইরাস নয়। বরং এটি একটি প্রাকৃতিক ভাইরাস, যা ক্রমাগত মিউটেশন বা জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে মানবদেরহে সংক্রমণ করছে।
নেচার মেডিসিনের জার্নালে গত ১৭ মার্চ একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে গবেষকরা নতুন করোনাভাইরাস সার্স সিওভি-২ এর সাথে বাকি ছয়টি সংক্রমণকারী করোনাভাইরাসের জিনোম তুলনা করে দেখেন। সেই ছয়টি ভাইরাসের মধ্যে সার্স এবং মার্স খুবই সংক্রামক। অন্যদিকে HKU1, NL63, OC43, 229E তুলনামূলক দুর্বল ভাইরাস।
সার্স সিওভি-২ ভাইরাসের পৃষ্ঠ থেকে প্রোটিনের একধরনের স্পাইক বের হয়ে আসে। একে বলা হয় স্পাইক প্রোটিন বা এস প্রোটিন। করোনাভাইরাস এই স্পাইকগুলোকে ব্যবহার করে পোষক দেহের কোষ আকড়ে ধরে। এরপর ভাইরাস কোষে প্রবেশ করে। বিজ্ঞানীরা এই স্পাইক প্রোটিনের দুটি জিনিসের জিন সিকুয়েন্স নিয়ে পরীক্ষা করেছেন।
একটি হচ্ছে রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন বা আরবিডি, যা মূলত পোষক দেহের কোষকে ধরে রাখে। অন্যটি হচ্ছে ক্লিভেজ সাইট, যা ভাইরাসকে পোষক কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।
মানবকোষের বাইরে একটি রিসেপ্টর থাকে, যার নাম ACE2 রিসেপ্টর। এটি মূলত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে থাকে। স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি এই রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই আরবিডি রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য খুবই কার্যকরভাবে বিবর্তিত হয়েছে। এটি শুধু প্রাকৃতিকভাবেই হওয়া সম্ভব, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সম্ভব নয়।
সার্স সিওভি-২ ভাইরাস যে লক্ষণ প্রকাশ করে, তার সাথে ২০০২ সালে চীনেই সংক্রমিত সার্স ভাইরাসের সাথে মিল আছে। সার্স ভাইরাসের সাথে সার্স সিওভি-২ এর জেনেটিক কোডের কিছুটা পার্থক্য আছে। কিন্তু সার্স ভাইরাসকে মিউটেশনের মাধ্যমে সার্স সিওভিতে রূপান্তরিত করলে সেটা মানব কোষের সাথে যুক্ত হওয়ার মতো উপযোগী হতো না। বিজ্ঞানীরা যদি ইচ্ছাকৃতভাবে জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ভাইরাসকে তৈরি করতেন, তাহলে এমন কিছু করতেন না যা কম্পিউটার মডেল গ্রহণ করে না।
এক্ষেত্রে প্রকৃতিই বিজ্ঞানীদের সাথে চতুরতা করেছে। সার্স সিওভি-২ ভাইরাস এত কার্যকর আর ভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়েছে, যা কোনো বিজ্ঞানীর পক্ষে বানানো সম্ভব হতো না। পরীক্ষা থেকে এটিই প্রমাণ হয়েছে, এটি জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বানানো হলে মানবদেহে কাজ করত না। প্রাকৃতিকভাবে বিবর্তনের মাধ্যমে হওয়ায় ভাইরাস সংক্রমণ করতে পারছে।
আবার নতুন করোনাভাইরাস গাঠনিক দিক দিয়ে অন্য সংক্রামক করোনাভাইরাসগুলো থেকে আলাদা। এর গঠনের সাথে বাদুড় এবং প্যাঙ্গোলিনের ভাইরাসদের সাথে মিল পাওয়া যায়, যারা মানবদেহে ক্ষতিকর নয়। বিজ্ঞানীরা যদি জীবাণু হিসেবে নতুন ভাইরাস তৈরি করতেন, তাহলে এমন কোনো ভাইরাস থেকে করতেন যা শরীরে রোগ সৃষ্টি করে। সার্স সিওভি জৈবাস্ত্র হিসেবে খুবই দুর্বল। এর চেয়ে ইবোলা ভাইরাসে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। চীন বা যুক্তরাষ্ট্র যদি জৈবাস্ত্র হিসেবে কোনো ভাইরাস তৈরি করত, তাহলে করোনাভাইরাসের চেয়ে আরো মারাত্মক ভাইরাস নিয়ে কাজ করতে পারত।
তাহলে এই নতুন করোনাভাইরাস সার্স সিওভি-২ কোথা থেকে এসেছে? বিজ্ঞানীরা দুটি সম্ভাবনার কথা বলেছেন।
প্রথম সম্ভাবনাটি হচ্ছে, ভাইরাসটি কোনো প্রাণীদেহ থেকে এসেছে। সার্স ভাইরাস মানবদেহে আসে সিভেট থেকে এবং মার্স ভাইরাস আসে উট থেকে। নতুন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা বলছেন বাদুড়ের কথা। বাদুড় থেকে কোনো ইন্টারমিডিয়েট হোস্ট, যেমন-প্যাঙ্গোলিনের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করেছে। এই ক্ষেত্রে ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশের আগেই সংক্রামক হয়ে আসে।
দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি হচ্ছে, ভাইরাসটি প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে আসার পর বিবর্তিত হয়ে সংক্রামক হয়েছে। প্যাঙ্গোলিনের দেহে যে করোনাভাইরাস থাকে, তাদের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন বা আরবিডি-এর সাথে সার্স সিওভি-২ এর আরবিডি’র মিল আছে। এক্ষেত্রে ভাইরাসটি প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে আসার পর ভাইরাসের ক্লিভেজ সাইট আরো বিবর্তিত হয়। এতে ভাইরাসটি মানব কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশের উপযোগী হয়ে উঠতে পারে। তখন ভাইরাসটি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে আরো কার্যকরভাবে সংক্রমণের উপযোগী হয়।
এই সম্ভাবনাগুলো ভাইরাসের মহামারির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা করতে সাহায্য করবে। যদি ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশের আগেই সংক্রামক হয়ে থাকে, তবে তা আবারো মহামারি সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, এখনো হয়তো অনেক প্রাণীদেহে ভাইরাসটি আছে। কিন্তু যদি ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশের পর বিবর্তিত হয়ে সংক্রামক ধর্ম প্রকাশ করা শুরু করে, তাহলে ভবিষ্যতে মহামারি রূপে দেখা দেয়ার সম্ভাবনা কম।
শুধু নেচার মেডিসিনই নয়, এর আগে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, এটার উৎপত্তি বাদুড় থেকে। পরবর্তীতে বাদুড় থেকে চীনের বন্য প্রাণীর বাজারের কোনো অজানা প্রাণীর মাধ্যমে মানবদেহে এসেছে।
আর উহানের পরীক্ষাগার থেকে দুর্ঘটনার মাধ্যমেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ নেই। ওই পরীক্ষাগারের বায়োসেফটি লেভেল-৪, যা আমেরিকার পরীক্ষাগারগুলোর মতোই। তাই ভাইরাসটির ভ্যাক্সিন বা উৎপত্তি নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও এটুক নিশ্চিত যে এটি মানবসৃষ্ট নয়। বরং রাজনীতিবিদরা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্যই কন্সপিরেসি থিওরিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন।