ধরুন, আগামীকাল আপনার কোনো একটা ফাইনাল পরীক্ষা, আপনি পড়ছেন, আরো পড়ছেন, কিন্তু সিলেবাস শেষ হচ্ছে না। যা-ই পড়ছেন, নতুন কিছু একটা শুরু করতে গিয়েই মনে হচ্ছে আগেরটা ভুলে গিয়েছেন। এমন অবস্থা তো আমাদের সবার জীবনেই হয়েছে, তা-ই না? তখন কি মনে হয় না, ইশ আমার যদি ফটোগ্রাফিক মেমোরি থাকতো, কতই না ভালো হতো! একবার দেখতাম, সব ঢুকে যেত মাথায়, পরীক্ষায় গিয়ে শুধু উগড়ে দিয়ে আসতাম! তারপর একদম কেল্লা ফতে! সেরা ফলাফল আর ঠেকায় কে!
শুনতে বেশ সিনেমাটিক লাগছে তাই না? সিনেমাটিকই বটে, সুপারম্যানের লেক্স লুথর, এক্স ম্যানের প্রোফেসর এক্সের মতো চরিত্রের মাঝে ফটোগ্রাফিক মেমোরি দেখতে দেখতেই আমাদের মনে গেঁথে গেছে ফটোগ্রাফিক মেমোরির অস্তিত্ব।
কিন্তু পর্দার বাইরের বাস্তব জীবনে কি আসলেই ফটোগ্রাফিক মেমোরি বলে কিছু আছে? মানুষের ভালো স্মৃতিশক্তি তো আমরা অহরহই দেখতে পাই। দাবার গ্র্যান্ডমাস্টাররা দাবা বোর্ডের দিকে পাঁচ সেকেন্ড তাকিয়েই স্মৃতিতে গেঁথে নিতে পারেন সবার অবস্থান। রুবিক্স কিউব যারা অনেক দ্রুত মেলান, তারাও একবার তাকিয়ে মনে রাখতে পারেন সম্পূর্ণ কিউবটা কীভাবে আছে। অবশ্য তাদের এটা পারেন কারণ তাদের কাছে দাবার ঘুঁটির বিভিন্ন অবস্থান আর রুবিক্স কিউবের সজ্জা মাথায় প্যাটার্নের মতো গেঁথে আছে। তারপর হাইপারথেসমিয়া বা ‘কিছু না ভোলার রোগ’ বলে একটা ব্যাধি আছে, এ রোগ থাকলে মানুষ দৈনন্দিন জীবনের কিছুই ভুলতে পারে না এবং এ ব্যাপারটার উপর সে রোগীর কোনো নিয়ন্ত্রণও থাকে না। কিন্তু ফটোগ্রাফিক মেমোরি বলতে আমরা বুঝি একটু অন্যরকম কিছু- কোনো একজন মানুষ কোনোকিছুর দিকে তাকালো, একটি মানসিক ছবি নিয়ে নিলো, পরে সম্পূর্ণ একটি ছবির মতোই সেই দৃশ্যটাকে মনে করে ফেললো।
এধরনের ফটোগ্রাফিক মেমোরির আসলে কোনো নজির আছে কি না, তা জানতে আমরা একটু পেছনে তাকাই।
১৯৭০ সালে ‘ন্যাচার’ জার্নাল থেকে একটা স্টাডি প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয় এলিজাবেথ নামক এক নারীর কথা, যিনি নাকি অনেকটাই ফটোগ্রাফিক মেমোরির অধিকারী। তার উপরে করা টেস্টটায় তাকে আলাদাভাবে এমন দুটো ডট প্যাটার্ন দেখানো হয়, যেগুলোকে এক করলে একটি পরিচিত চিহ্ন বা অক্ষর দেখা যাবে। এলিজাবেথকে সেগুলো দেখানোর পর তিনি বলে দিতে পারতেন, অক্ষর বা চিহ্নটি আসলে কী। তিনি নাকি বিদেশী ভাষা, অর্থাৎ যেই ভাষা তিনি জানেনই না, সে ভাষার কবিতাও মুখস্থ বলে দিতে পারতেন একবার দেখেই।
এ স্টাডিটি তখন বিজ্ঞানীমহলে হৈচৈ ফেলে দেয়। অন্য বিজ্ঞানীরাও তখন ব্যাপারটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৭৯ সালে জন মেরিট নামের আরেকজন গবেষক একটি ফটোগ্রাফিক মেমোরি টেস্ট তৈরি করে জনপ্রিয় পত্রিকায় প্রকাশ করেন।
প্রায় দশ লাখের মানুষ তার টেস্টটি সল্ভ করার চেষ্টা করেন, সফল হন মাত্র ৩০ জন। তাদের মধ্যে ১৫ জন মানুষের সাথে তিনি সরাসরি সাক্ষাৎ করেন, কিন্তু সামনাসামনি সেই মানুষগুলো আর ফটোগ্রাফিক মেমোরির প্রমাণ দেখাতে পারেন না। তাই এলিজাবেথ তখনো অদ্বিতীয়ই থেকে যান।
কিন্তু এই এলিজাবেথ গল্পের সত্যতা সম্পর্কেই আসলে কোনো নিশ্চয়তা নেই। তার এই স্টাডিটি প্রকাশ হবার পর, তার উপর আরো টেস্ট করার প্রস্তাব করা হয়, কিন্তু তিনি আর রাজি হননি। এবং, স্টাডিটির লেখক আর এলিজাবেথ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন কিছুদিনের মধ্যেই।
সুতরাং, সেই গবেষণাটির ফলাফল যে বৈজ্ঞানিক কৌতূহল ছাড়াও অন্য কোনো আবেগ দ্বারা প্রভাবিত ছিল না, তার নিশ্চয়তা কি আদৌ আছে?
এই ঘটনার পরও, বেশকিছু মানুষই দাবি করেছেন যে তাদের ফটোগ্রাফিক মেমোরি আছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা করার পর দেখা গেছে, তাদের কারোরই আসলে এধরনের কিছু ছিল না, কেউ হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে খুব ভালো স্মৃতিশক্তির নজির দেখিয়ে ফেলেছিলেন, কারো দাবিটিই ছিল নিতান্ত মিথ্যে।
তবে ফটোগ্রাফিক মেমোরির কাছাকাছি একটা ব্যাপার কিন্তু প্রকৃতিতে আছে। এর নাম ‘আইডেটিক ইমেজারি’। পুরোপুরি ফটোগ্রাফিক মেমোরির মতো না হলেও আইডেটিক ইমেজারি ব্যাপারটাও বেশ মজার।
আইডেটিক ইমেজারি যাদের থাকে, তাদেরকে বলা হয় আইডেটিকারস। তারা বাস্তবে কোনো একটা ছবি দেখার পর চোখ সরিয়ে নিলেও সে ছবিটি দেখা চালিয়ে যেতে পারে, বিবরণ দিতে পারে খুব ছোট ছোট ডিটেইলের। তাদের সেই ছবি দেখার অভিজ্ঞতাও হয় একদম আসলটা যখন দেখেছিল, ঠিক তেমন। এছাড়াও মনের মধ্যেও তারা তৈরি করে ফেলতে পারে এরকম ছবি, যেটা দেখার অভিজ্ঞতার সাথে বাস্তব ছবি দেখার অভিজ্ঞতার কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু ছবিটা সাধারণত ধীরে ধীরে কয়েক মিনিটের মধ্যে উধাও হয়ে যায় চোখের সামনে থেকে, আর চোখ বন্ধ করলে বা পলক ফেললেও উধাও হয়ে যায় এমনিতেই। আর যদি একবার চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে যায়, তখন সেটা আর ফিরেও আসে না। এছাড়া যখন ছবিটা চোখের সামনে থাকেও, এমন না যে সেখান থেকে লেখা পড়ে লিখে ফেলা যাবে খুব, তাই আমরা ফটোগ্রাফিক মেমোরি দিয়ে যা করার কথা ভাবি, তা আসলে আইডেটিক ইমেজারি দিয়ে করা সম্ভব নয়।
তবে অদ্ভুত বিষয় হলো, এই আইডেটিক ইমেজারিটা শুধুমাত্র শিশুদের মধ্যেই দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এর নজির এখনো একবারও পাওয়া যায়নি। আর শিশুদের জন্যেও, তারা যত বড় হতে থাকে, এই ইমেজ দেখার ক্ষমতা কমতে থাকে। তাই গবেষকরা ভাবছেন, আইডেটিক ইমেজারি হারিয়ে যাওয়া সম্ভব স্বাভাবিক বিকাশেরই অংশ। তবে অনেকে এও বলেন যে, আমরা যত বড় হই, আমাদের চিন্তা তত ভাষাভিত্তিক হয়। আমরা শব্দে ভাবি, ছবিতে নয়। আর যখন কোনো একটা বস্তুর জন্য আমরা শব্দ তৈরি করে ফেলি, তখন সে বস্তুর আইডেটিক ইমেজ আর আমরা তৈরি করতে পারি না। এ কারণেই আইডেটিক ইমেজারি হারিয়ে যেতে থাকে ভাষায় দক্ষ হবার সাথে সাথেই।
তবে একটি শিশুর ভাষার দক্ষতা বাড়ার সাথে সাথেই তার আইডেটিক ইমেজারি কমে যাচ্ছে, এটা সবসময়ই হয় না, কিছু স্টাডিতে এর ব্যতিক্রমও দেখা গেছে। তাই এই ব্যাখ্যাটি ভুলও হতে পারে।
আবার এও দেখা গেছে যে, আইডেটিক ইমেজারি মস্তিষ্কের অক্সিপিটাল লোবে আলফা-ওয়েভ অ্যাক্টিভিটির জন্ম দেয়। আলফা-ওয়েভ অ্যাক্টিভিটি সাধারণত মানুষের হয় জাগ্রত অবস্থায় চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নেবার সময়, অথচ আইডেটিক ইমেজারি দেখবার সময় চোখ থাকে বন্ধ। এসব তথ্যে বিজ্ঞানীরা বেশ বিভ্রান্তই আছেন এখনো।
তাই আইডেটিক ইমেজারির প্রকৃতি ও কারণ এখনো একদম নিশ্চিতভাবে বের করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
কিন্তু ফটোগ্রাফিক মেমোরি যে আসলে বাস্তবে নেই, সেটা বিজ্ঞানীরা মোটামুটি নিশ্চিত। তাই এক ঝলকেই স্মৃতিতে গেঁথে ফেলব, এরকম শর্টকাটও আসলে নেই। স্মৃতিশক্তিকে তুখোড় করার উপায় তাই নিয়মিত অনুশীলন। এছাড়া নেমোনিক (Mnemonics) ব্যবহার করে মনে রাখাও একটা ভালো উপায়। নেমোনিক হচ্ছে ছড়া, ছন্দ বা কোনো গল্প- এধরনের বিভিন্ন স্মৃতিসহায়ক দিয়ে কিছু মনে রাখার পদ্ধতি। এই নেমোনিক ব্যবহারকে পাকাভাবে রপ্ত করেই বিভিন্ন স্মৃতিশক্তি প্রতিযোগিতার প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতায় সয়লাব করে থাকে। মোদ্দা কথা, চর্চা আর অধ্যবসায় আপনাকে করতেই হবে। তবে এই প্রবন্ধ পড়ার পর থেকে নিশ্চয়ই আপনি আর আপনার ফটোগ্রাফিক মেমোরি থাকার আশা করবেন না। এ নিয়ে আফসোস করারও কিছু নেই, এটা আপনার যেমন নেই, তেমনি পৃথিবীর কারোরই নেই।
ফিচার ইমেজ- 123rf.com