ব্রিটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার একদিন হাসপাতালে কাজ করছিলেন। এলাকার এক গরুপালক সেইসময় তার এক সহকর্মীর কাছে কথায় কথায় বললো, “আমার কখনো গুটিবসন্ত (Smallpox) হবে না স্যার, আমার গোবসন্ত (Cowpox) হয়েছে একবার”। পাশ থেকে জেনার শুনতে পেলেন কথাটি।
খোঁজ নিয়ে জেনার জানতে পারলেন, বাড়িতে যারা গরু পালন করে, গরুর দুধ বিক্রি করে, তাদের মাঝে প্রচলিত একটি বিশ্বাস হলো, কারো যদি গোবসন্ত হয়ে যায় একবার, তবে আর প্রাণঘাতী গুটিবসন্ত হবে না। এসবই আঠারো শতকের শেষ সময়ের গল্প।
জেনার গরুপালকদের এই বিশ্বাসটি একেবারে ফেলে দিতে পারেননি। সেসময়ে সমাজের উঁচু-নিচু সকলেই জাতভেদ ভুলে গিয়ে এই গুটিবসন্তে আক্রান্ত হতো, আর কুৎসিত এক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে তারা মারা যেতো। জেনার ভাবলেন, তিনি একবার চেষ্টা করে দেখবেন, যদি গুটিবসন্ত নিরাময়ে কিছু করা যায়।
গোবসন্ত হওয়া এক গরুর পুঁজ সংগ্রহ করে আট বছরের জেমস ফিপসের দেহে প্রবেশ করালেন জেনার। এই ব্যাপারে তিনি প্রথমেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, গোবসন্তের পেছনে দায়ী কারণটি কোনো একভাবে গরুকে আক্রান্ত করছে, কিন্তু মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারছে না। ভাইরাস তখনো আবিষ্কৃত হয়নি বিধায় কী দিয়ে এই রোগগুলো হয়ে থাকে জেনার তা জানতেন না। গোবসন্তের ভাইরাস প্রবেশ করানোর কিছুদিন পর জেনার নির্দিষ্ট পরিমাণে গুটিবসন্তের ভাইরাস সমৃদ্ধ পুঁজ ফিপসের দেহে প্রবেশ করালেন। নির্ধারিত সময়ের মাঝে ফিপসের মাঝে গুটিবসন্তের কোনো লক্ষণই দেখা গেলো না। একমাস সময় নিয়ে জেনার আবারো বেশি পরিমাণে গুটিবসন্তে আক্রান্ত ব্যক্তির পুঁজ প্রবেশ করালেন ফিপসের দেহে। এবারো ফিপসের মাঝে গুটিবসন্তের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পেলো না।
জেনার বক্তব্য প্রকাশ করলেন তার এই এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপারে। শত শত মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী যে রোগ, সেই রোগের নিরাময়ে এই সামান্য সমাধান, মানুষের মাঝে বোধগম্য হলো না। জেনারকে তাই বাধ্য হয়েই আরো অনেকগুলো মানুষের উপর এই এক্সপেরিমেন্ট চালাতে হয়েছিলো। অবশেষে মানুষের মনে বিশ্বাস আসে যে, গোবসন্তে আক্রান্ত গরুর পুঁজ কারো দেহে প্রবেশ করালে তার আর কখনো গুটিবসন্ত হবে না। এই তো হলো শুরু, একে একে এই সমাধানের মাধ্যমে মানুষের মৃত্যুহার কমে আসতে শুরু করে।
তবু তর্ক কিছুটা রয়েই গিয়েছিলো মানুষের মনে। এ আবার কেমন চিকিৎসা! সুস্থ মানুষের দেহে রুগ্ন এক গরুর পুঁজ প্রবেশ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এই চিকিৎসার সফলতার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়াতে মানুষ একেই শেষ আশ্রয়স্বরূপ গ্রহণ করে নেয়।
‘গরু’ শব্দের ল্যাটিন হলো ‘ভ্যাক্সা’, এর থেকেই ‘ভ্যাক্সিন’ শব্দটি প্রণয়ন করেন এডওয়ার্ড জেনার। আর তাকে বলা হয় ভ্যাক্সিনেশন কিংবা টিকাদানের জনক।
ভ্যাক্সিন কিংবা টিকা হিসেবে আপনার রক্তে যা প্রবেশ করানো হচ্ছে তা সবই জীবন্ত ভাইরাস। পার্থক্য হলো, এই ভাইরাসগুলো আপনাকে ক্ষতি করার ক্ষমতা বহন করে না; যেমনটি করতে পারতো না গোবসন্তের ভাইরাস।
পোলিও ভ্যাক্সিন একমাত্র মুখে খাওয়ানো হয়, বাকি সকল ভ্যাক্সিন রক্তে ইঞ্জেকশন দেয়া হয়। এবার ভ্যাক্সিনেশনের মূল রহস্যের উন্মোচন করা যাক। ভ্যাক্সিনে আসলে জীবন্ত ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে দেহের মাঝে। ভাইরাসগুলো দেহে সংক্রমিত হতে পারবে না এ ব্যাপারে নিশ্চিত। কিন্তু এতে করে ভবিষ্যতে অন্য কোনো সূত্র থেকে ভাইরাস প্রবেশ করলেও দেহ সংক্রমিত হবে না, এই ব্যাপারটা কীভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে? এর মূলে অন্য কিছু নেই, সৃষ্টিকর্তার দানকৃত আমাদের শরীরের মহান এক প্রতিরক্ষা বাহিনীই রয়েছে শুধু। প্রতিরক্ষাবাহিনী এই ব্যাপারে সারাক্ষণ কাজ করে যাচ্ছে। রক্তে অবস্থানকৃত তিনটি কণিকার মাঝে একটি হলো লিউকোসাইট অথবা শ্বেত রক্ত কণিকা। এই শ্বেত রক্ত কণিকার কাজই হলো শরীরের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা। কোনোভাবে যদি শরীরে এই কণিকার সংখ্যা কমে যায়, তখন শরীর নানারকম রোগ-জীবাণুর বাসস্থানে পরিণত হয়।
শ্বেত রক্তকণিকার আবার বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। লিম্ফোসাইট নামের শ্বেতরক্তকণিকাগুলো মূলত আজকের আলোচ্য বিষয়ের পক্ষে কাজ করে থাকে। লিম্ফোসাইটেরও দুটো টাইপ রয়েছে। তন্মধ্যে T-Lymphocyte এই ভ্যাক্সিনের মাঝে সুরক্ষায় কাজ করে থাকে। যদিও T-Lymphocyte এর আরো চার ধরনের টাইপ রয়েছে, কিন্তু এত গভীরে না গেলেও চলবে। কেবলমাত্র T-Lymphocyte দিয়েই আলোচ্য বিষয়াবলী বিশ্লেষণ হয়ে যাবে।
T-Lymphocyte-কে এমনই এক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে, যার দরুন এটি ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার চেহারা শনাক্ত করে এর নিজস্ব স্মৃতিভান্ডারে সংরক্ষণ করতে পারে। আপনার যদি একবার টাইফয়েড হয়ে যায়, শরীরের প্রতিরক্ষা বাহিনী তার সর্বস্ব নিয়ে নামবে আপনাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু পেরে উঠবে না টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়ার সাথে। আপনাকে বাঁচাতে বাইরে থেকে নির্ধারিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবস্থা করতে হবে। আপনার শরীর তখন দূরবস্থা কাটিয়ে বেঁচে উঠবে, সেই সাথে T-Lymphocyte টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়াটিকে চিনে রাখবে, ভবিষ্যতে যখনই এই ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করবে, এক সেকেন্ডও লাগবে না, T-Lymphocyte পুরো প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাছে সংবাদ পৌঁছে দেবে। এভাবেই কাজ করে আসছে আমাদের শরীরের আশ্চর্যজনক এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
ঠিক এই কারণেই গোবসন্ত হওয়া কারো গুটিবসন্ত হচ্ছিলো না। গোবসন্তের ভাইরাস শরীরের কোনো ক্ষতি করতে পারছে না, কিন্তু T-Lymphocyte-কে বসন্তের ভাইরাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো। ফলে গুটিবসন্তের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। এই ধারণাকে ভিত্তি করেই পরবর্তীতে নানা সময়ে বিভিন্ন ভ্যাক্সিনেশন আবিষ্কৃত হয়েছে।
শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হলো ‘সহজাত (Innate)’, আরেকটি ‘অর্জিত (Acquired)’। সহজাত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে মানবযন্ত্রের বিস্ময়কর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নামক আর্টিকেলে।
অর্জিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে- প্রত্যক্ষ (Active) ও পরোক্ষ (Passive)। এই দুটোরই আবার দুটি করে উপবিভাগ রয়েছে- প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম।
প্রত্যক্ষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দু’ভাবে হতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে পরিপার্শ্ব থেকে কোনো অণুজীব প্রবেশ করে শরীরে, তাহলে রক্ত এর বিরুদ্ধে যে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করবে, এটিই হলো প্রাকৃতিক প্রত্যক্ষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আরেকভাবে হতে পারে, আমরা যদি অণুজীব শরীরে প্রবেশ করিয়ে আগে থেকেই এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সজাগ করে তুলতে পারি, তবে প্রতিরক্ষা বাহিনী আগে থেকেই সচেতন থাকবে উক্ত অণুজীবের বিরুদ্ধে। নিঃসন্দেহে কৃত্রিমভাবে যে অণুজীব প্রবেশ করানো হবে সেটি কোনোরূপ ক্ষতি করতে অক্ষম। এই কৃত্রিম সহজাত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটিই আসলে ভ্যাক্সিন।
পরোক্ষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নামেই এর পরিচয় লুকিয়ে আছে, যা অন্য কোনো মানুষের থেকে অর্জিত হয়। একজন মানুষের সাথে কখন অপর একজন মানুষের রক্ত সরাসরি যোগাযোগ করে থাকে? মায়ের পেটে সন্তান যখন অবস্থান করে, তখন মা আর সন্তান সরাসরি যুক্ত থাকে আম্বিলিক্যাল কর্ড দিয়ে। এই আম্বিলিক্যাল কর্ডের ভেতরেই সকল পুষ্টি, প্রতিরক্ষা আর বর্জ্যের আদান-প্রদান হয়ে থাকে। এই হলো প্রাকৃতিকভাবে মায়ের শরীর থেকে সন্তানে অর্জিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রবেশ। আরেকটি কাজ করা যেতে পারে। কারো দেহে কোনো এক ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয়েছে। তার মানে আর কখনো সেই ভাইরাসটি দেহের মাঝে রোগ সংক্রমিত করতে পারবে না। যদি সেই অ্যান্টিবডি নিয়ে অপর কোনো মানুষে প্রবেশ করানো যায়, তাহলে সেই মানুষটির শরীরেও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অর্জিত হবে। এটিই হলো কৃত্রিমভাবে অর্জিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি এই শব্দগুলো বিস্তারিত বুঝতে হলে এই আর্টিকেলটি পড়ে দেখতে পারেন।
আর্টিকেলটির মূল উদ্দেশ্য ছিলো একটি শিশুকে কী কী ভ্যাক্সিন প্রদান করতে হয়। কিন্তু সেই ব্যাপারে সরাসরি বললে কারো বোধগম্য হবে না বিধায় প্রথম পর্বে ভ্যাক্সিনেশনের বিস্তারিত ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ভ্যাক্সিনেশন বুঝতে হলে মোটামুটিভাবে যা যা জানা প্রয়োজন, সেগুলো অল্প করে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে একজন শিশুর ভ্যাক্সিনেশন কোর্সের ব্যাপারে বিস্তারিত বলা হবে।
২য় পর্ব: শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিনসমূহ