সিগমুন্ড ফ্রয়েড নামটির সঙ্গে বোধকরি অনেকেই পরিচিত। মনোসমীক্ষণের জনক হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত তিনি। তার তত্ত্ব পাঠ না করে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
তবে, ফ্রয়েডের প্রণীত তত্ত্বগুলো যে সবই ধ্রুব সত্য, এবং বিতর্কের ঊর্ধ্বে, তা কিন্তু নয়। পুরুষালি দৃষ্টিকোণ থেকে মনোযৌনতার বিকাশের (psychosexual development) যে ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন, তা নিয়ে গোড়া থেকেই, অর্থাৎ তার সমসাময়িকদের মাঝে অনেকেরও, প্রবল বিরোধিতা ছিল। তাদের মতে, নারী ও পুরুষ উভয় সেক্সের বিকাশকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি শিশ্নের গুরুত্ব এবং এটি না থাকা বা খুইয়ে ফেলার আশঙ্কার উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করেছেন, যা তার তত্ত্বকে একপেশে ও দুর্বল করে তুলেছে।
(এই লেখায় বাংলা পরিভাষা ‘লিঙ্গ’ না লিখে কোথাও ‘সেক্স’ আর কোথাও ‘জেন্ডার’ লেখা হয়েছে। কেন সেক্স ও জেন্ডার আলাদা, তা জানতে পারবেন এই লিংক থেকে।)
একদম শুরু থেকেই ফ্রয়েডের তত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন যারা, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কারেন হর্নাই (Karen Horney)। তিনি ছিলেন বিংশ শতকের প্রথমার্ধ্বের একজন জার্মান মনোসমীক্ষক। একাধারে তিনি নারীবাদী মনোবিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা, এবং নব্য-ফ্রয়েডীয় মনোবিদ্যার সহ-প্রতিষ্ঠাতাও বটে।
তরুণ বয়সে ক্রনিক ডিপ্রেশনে ভোগা এই নারী চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রবল আগ্রহী হয়ে ওঠেন, এবং কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন একজন মনোসমীক্ষক হিসেবে। এর পাশাপাশি তিনি প্রণয়ন করেছেন ব্যক্তিত্ব ও স্নায়বিক পীড়া নিয়ে কিছু বৈপ্লবিক তত্ত্ব। এবং সেই কারণেই একপর্যায়ে তাকে বহিষ্কৃত হতে হয় নিউ ইয়র্ক সাইকোঅ্যানালিটিক সোসাইটি অ্যান্ড ইনস্টিটিউট থেকে।
মনোবিজ্ঞানের উন্নয়নে কারেনের ছিল ব্যাপক অবদান। তিনি শুধু স্নায়বিকতা বিষয়েই কিছু অতি-গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেননি। নারীদের প্রতি মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও গবেষণা করেছেন তিনি। ভুলে গেলে চলবে না, বিংশ শতকের শুরুর দিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো মনোবিজ্ঞানেও চলছিল পুরুষাধিপত্য। ফলে পুরুষতান্ত্রিকতার নিগড়ে বন্দি ছিল এই তাৎপর্যপূর্ণ খাতও। বিশেষত, ফ্রয়েডকেই এই পরিসরের ঈশ্বরজ্ঞান করতেন অনেকে। সেরকম পটভূমিতে একজন নারীর মনঃসমীক্ষক হয়ে ওঠা, এবং সরাসরি ফ্রয়েডের তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া কোনো অংশে কম বৈপ্লবিক বিষয় নয়।
প্রাথমিক জীবন
কারেন হর্নাই (জন্মনাম ড্যানিয়েলসেন) জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, জার্মানির ব্ল্যাঙ্কেনিসে। বাবার প্রতি শৈশব থেকেই তার মনে জন্মেছিল বিরূপভাব। সেটি মূলত এ কারণে যে, জোর করে তার উপর অনেক বেশি পড়াশোনা চাপিয়ে দিতেন বাবা। এজন্য অল্প বয়স থেকেই বড় ভাইয়ের শরণ নিতে শুরু করেন তিনি, এবং ভাইয়ের সঙ্গে অনেক বেশি অন্তরঙ্গ হয়ে পড়েন।
কিন্তু সেই ভাই-ই একটা সময়ে এসে কারেনকে দূরে ঠেলে দিলে গভীর বিষাদে নিমজ্জিত হন তিনি। ক্রনিক ডিপ্রেশনে রূপান্তরিত হয় সেই বিষাদ। এছাড়াও, আরো নানা ধরনের সঙ্কটে জর্জরিত ছিল তার প্রথম জীবন। ফলে লেখাপড়ার দুনিয়ায় ডুব দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন তিনি।
কারেনের বিষণ্নতা বা প্রথম জীবনের হীনম্মন্যতার আরেকটি কারণ ছিল তথাকথিত সৌন্দর্যের মানদণ্ডে তার পিছিয়ে থাকা। তাই তো পরবর্তীতে তিনি বলেছিলেন,
“যদি আমি সুন্দরী হতে না পারি, সিদ্ধান্ত নিই বুদ্ধিমতী হবো।”
১৯০৬ সালে কারেন ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব ফ্রেইবুর্গের ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিনে। তখনকার দিনে খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়েই নারী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হতো, যার মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। অচিরেই কারেন যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব গ্যটিঙেনেও। এবং শেষমেশ, ১৯০৯ সালে, তিনি ইউনিভার্সিটি অব বার্লিনে ভর্তি হন, সিদ্ধান্ত নেন মনোসমীক্ষণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার।
ইউনিভার্সিটি অব বার্লিন তখন সবে সাইকোলজি স্কুল হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সেখানে পড়াশোনা করেই ১৯১৫ সালে তিনি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। তবে এর আগেই, ১৯০৯ সালে, তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী অস্কার হর্নাইকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তাদের তিন কন্যাসন্তান জন্ম নেয়।
পেশাজীবন
পেশাজীবনের সূচনালগ্নে কারেন হর্নাই বার্লিন সাইকোঅ্যানালিটিক ইনস্টিটিউটে একজন অধ্যাপক ও বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু পেশাজীবনে দারুণ অগ্রগতি সত্ত্বেও, ব্যক্তিগত জীবনে সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকেন তিনি। দাম্পত্যজীবনে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না তার। এদিকে ফুসফুসের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে তার বড় ভাইও মারা যান। সব মিলিয়ে কারেনের অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়ে যে, আবারও সুদীর্ঘ ডিপ্রেশনে পড়েন তিনি।
১৯৩২ সালে কারেন চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে গিয়ে শিকাগো সাইকোঅ্যানালিটিক ইনস্টিটিউটের সহযোগী পরিচালক পদে কাজ শুরু করেন। এর বছর দুয়েক বাদে তিনি চলে যান ব্রুকলিনে, এবং অধ্যাপনা শুরু করেন নিউ ইয়র্ক সাইকোঅ্যানালিটিক সোসাইটি অ্যান্ড ইনস্টিটিউটে।
এখানে অবস্থানকালেই কারেন নিউরোসিস ও পার্সোনালিটি নিয়ে নিজস্ব তত্ত্ব দাঁড় করাতে শুরু করেন। তার যোগাযোগ হয় একই খাতের তৎকালীন স্বনামধন্য লেখক যেমন এরিক ফ্রম ও হ্যারি স্ট্যাকদের সঙ্গে।
কারেন যে সমালোচনাত্মক তত্ত্বগুলো প্রণয়ন করেন, সেগুলো ছিল ফ্রয়েডের তত্ত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বলা যায়, ফ্রয়েডের তত্ত্বের প্রবল বিরোধিতা করেন তিনি। কিন্তু এই বিরোধিতার ফলাফল ইতিবাচক ছিল না। তাকে তার প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হয়।
তবে বহিষ্কৃত হয়েও হাল ছেড়ে দেননি কারেন। তিনি একাট্টা হন সমমনাদের সঙ্গে, যারা ছিলেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী, এবং যারা ফ্রয়েডের তত্ত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে নিজস্ব তত্ত্ব খাড়া করতে চাইছিলেন। এই মানুষগুলোকে নিয়ে কারেন প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য আমেরিকান জার্নাল অব সাইকোঅ্যানালিসিস’ এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব সাইকোঅ্যানালিসিস। ১৯৫২ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত কারেন এখানেই কাজ করে যান।
কারেন যেভাবে করেন ফ্রয়েডের বিরোধিতা
ফ্রয়েড দাবি করেছিলেন, নারীরা নিজেদের শরীরকে পুরুষের তুলনায় কমজোরি মনে করে। কিন্তু এ কথা মেনে নিতে পারেননি কারেন। তার মতে, পুরুষালি আত্মমগ্নতা (masculine narcississm) থেকেই উৎসারিত হয়েছে এমন ধারণা যে- মানবসভ্যতার অর্ধেক অংশ নিজেদের সেক্স নিয়ে সন্তুষ্ট না।
যদিও কারেন পেনিস এনভি (শিশ্ন ঈর্ষা) ও ক্যাস্ট্রেশন অ্যাংজাইটির (খোজাকরণ উদ্বিগ্নতা) সম্ভাব্যতাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি, কিন্তু তিনি এ কথাও যোগ করেছেন যে, পুরুষরাও নারীর প্রতি ঈর্ষান্বিত।
জৈবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর রয়েছে মাতৃত্ব বা মাতৃত্বের ক্ষমতার ফলে এক অবিসংবাদিত ও অনুপেক্ষণীয় শ্রেষ্ঠত্ব। ছেলেশিশুরা যে মাতৃত্বকে ঈর্ষা করে, এর নেপথ্যে তাদের পুরুষালি মনস্তত্ত্বে মূলত নারীর ওই শ্রেষ্ঠত্বেরই প্রতিফলন ঘটে। এ ধরনের ঈর্ষার সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত আছি, কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে এটি কখনোই যথোপযুক্ত বিবেচনার আওতায় আসেনি। নারীদের দীর্ঘদিন বিশ্লেষণের অভিজ্ঞতার পর যখন কেউ পুরুষদের বিশ্লেষণ করতে শুরু করে, যেমনটি আমি করেছি, তখন গর্ভাবস্থা, শিশুর জন্ম দেওয়া, মাতৃত্ব, এবং স্তনযুগল ও স্তন্যদানকে কেন্দ্র করেও পুরুষের ঈর্ষার তীব্রতার এক বিস্ময়কর পরিচয় পাওয়া যায়।
কারেন আরো বিশ্বাস করতেন, শিশ্নের প্রতি ঈর্ষার কারণে মেয়েরা তাদের উপর অর্পিত নারী-ভূমিকাকে প্রত্যাখ্যান করে না। বরং, এর পেছনে রয়েছে আত্মরতির অনুতাপ থেকে উৎসারিত এক অচেতন ভয় যে পেনিট্রেশনের (নারীর যৌনাঙ্গে পুরুষের যৌনাঙ্গ প্রবেশ করানো) ফলে তাদের যোনি আহত হতে পারে। এভাবেই কারেন প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, পুরুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্যের কারণে নয়, বরং নিজস্ব দৈহিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেই তাদের মনোযৌনতার বিকাশ ঘটে।
মেয়েদের নারীসুলভ-ভূমিকাকে প্রত্যাখ্যানের নেপথ্যে কারেন আরেকটি কারণকেও উত্থাপন করেন। সেটি হলো- সমাজের চোখে নারীকে অপর্যাপ্ত ও পুরুষ অপেক্ষা দুর্বলতর হিসেবে দেখা, যার ফলে নারীরা ঘরের বাইরে তুলনামূলক কম সুযোগ পেয়ে থাকে।
এভাবেই কারেন হয়ে ওঠেন প্রথম মনোসমীক্ষক দলের একজন, যারা ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং শরীর-মনের আভ্যন্তরীণ বিষয়আশয়ের ভূমিকাকে একীভূত করেন।
যেমনটি আগেই বলেছি, গোঁড়া ও রক্ষণশীল ফ্রয়েডীয়-চক্র কারেন ও তার দৃষ্টিভঙ্গিকে নাকচ করে দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কারেনের তত্ত্ব ছিল যথেষ্টই প্রভাবসম্পন্ন, এবং সেই সুবাদে তিনি খ্যাতি ও সম্মানের অধিকারী হন, অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হতে শুরু করেন। অর্থাৎ বিতর্ক তার চলার পথকে রুদ্ধ করতে পারেনি।
ফ্রয়েডীয় তত্ত্বকে যেখানে বলা চলে ‘ফ্যালোসেন্ট্রিক’, অর্থাৎ যেটি আবর্তিত হয় পুরুষের শিশ্নকে কেন্দ্র করে; সেখানে কারেন ও তার গোষ্ঠীর অন্যান্য মনোসমীক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ‘গাইনোসেন্ট্রিক’, অর্থাৎ যার কেন্দ্রে রয়েছে নারীর গর্ভ।
কারেনদের এই অ্যাপ্রোচ ছেলে ও মেয়ে উভয়ের মায়ের সঙ্গে প্রাক-ইডিপাল সম্পর্কের মাধ্যমে সৃষ্ট ব্যক্তিত্বের বিকাশের উপর গুরুত্বারোপ করে, এবং নারীর উপর পুরুষ আধিপত্যের সঙ্গে মা-শিশুর প্রাথমিক বন্ধনেরও যোগসূত্র স্থাপন করে। এই প্রস্তাবিত যোগসূত্রের মাধ্যমে মায়ের প্রতি শিশুদের অচেতন মনের ভয় ও ঈর্ষাকে নির্দেশ করা হয়। এখানে দেখানো হয় যে, মেয়েশিশুদের দরকার পড়ে না আত্মপরিচয় পাল্টানোর, বরং ছেলেশিশুদেরই মায়ের বৈশিষ্ট্য থেকে বাবার বৈশিষ্ট্যে স্থানান্তরিত হতে হয়।
কারেনের মতে, পুরুষরা যে ক্রমাগত নতুন কিছু সৃষ্টি করতে বা অর্জন করতে চেষ্টা করে, সেটির উৎস মূলত তাদের ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স যে তারা নারীদের মতো মা হতে পারে না, নতুন মানবপ্রাণের জন্ম দিতে পারে না। তাছাড়া, পুরুষরা যে অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যায় নারীদের দমিয়ে রাখার বা খাটো করার, সেটাও এ জন্য নয় যে নারীদের শিশ্ন নেই, বরং সেটাও নারীর প্রতি পুরুষের অবচেতন মনের ঈর্ষারই বহিঃপ্রকাশ।
এক্ষেত্রে কারেনের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন অস্ট্রিয়ান-ব্রিটিশ লেখক এবং মনোসমীক্ষক মেলানি ক্লাইনও। তিনি বলেছেন, মা ও মাতৃত্বের প্রতি উদ্বেগ, ঈর্ষা ও হীনম্মন্যতা ঢাকতেই ছেলেরা নিজেদের শিশ্ন নিয়ে অতিরিক্ত গর্ববোধ করে।
কারেন ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের যে সমালোচনা করেছিলেন, তার মাধ্যমে নারীর ব্যক্তিত্ব বা মনোযৌনতার বিকাশের ক্ষেত্রে তার নিজের শরীরের প্রভাবের পুনরুদ্ধার ঘটে; পুরুষের শরীরের প্রতি ঈর্ষার ব্যাপার খারিজ হয়ে যায়। তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে, কারেনের এই সমালোচনা শুরুর দিকে কেবল ব্যক্তিত্বকে ব্যাখ্যা করতে ফ্রয়েড প্রণীত শারীরতত্ত্ব ও প্রবৃত্তির উপর নির্ভরশীলতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
নিজের পরবর্তী কাজগুলোতে কারেন এই অবস্থান থেকে সরে আসেন যে, মানব আচরণ তার প্রবৃত্তিগত তাড়না (যৌনতা, আগ্রাসন) থেকে জন্ম নেয়। এবার তিনি বলেন, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের অভিজ্ঞতা থেকেই আসলে ব্যক্তিত্ব ও মানব আচরণ নির্দিষ্ট ছাঁচবদ্ধ হয়।
কারেন ব্যাখ্যা করেন, মানুষ মূলত পরিচালিত হয় তার সুরক্ষা (আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা) ও সন্তুষ্টির প্রয়োজনীয়তার দ্বারা। একটি শিশুর সামাজিক পরিবেশই নির্ধারণ করে দেয় যে, তার প্রয়োজনগুলো সহজেই মিটছে, নাকি এজন্য তাকে কোনো বিশেষ স্নায়বিক ‘সমাধান’ গড়ে তুলতে হবে, যেমন- নির্ভরশীলতা, যাতে সে প্রতিকূল পরিবেশ থেকে আগত উদ্বেগ ও বৈরিতা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে।
১৯৩৯ সালে প্রণীত কারেনের তত্ত্ব অনুযায়ী, পরিবেশ শিশুর উপর সম্ভাব্য দুটি বিপদ দাঁড় করাতে পারে: অবমূল্যায়ন (একজন স্বতন্ত্র, যোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের শ্রদ্ধার ঘাটতি), এবং যৌনকরণ (একটি যৌন অ্যাপ্রোচ, জোর করে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে শিশুকে শিক্ষাদানের প্রয়াস)।
শিশুর কোনো একজন অভিভাবকের প্রতি বেশি ঝুঁকে যাওয়া এবং অন্যজনকে ঈর্ষা করার যে প্রবণতা, সেটিকে ফ্রয়েড বিশেষায়িত করেছেন ইডিপাস কমপ্লেক্স হিসেবে। কিন্তু কারেনের মতে, এটি আসলে শিশুর প্রতি কোনো একজন অভিভাবকের ক্ষমতার অপব্যবহার, অবমাননা ও যৌনকরণের ফলাফল।
কারেনের লেখা থেকে এটি স্পষ্ট যে, তিনি মনে করতেন, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে কন্যাসন্তানের চেয়ে পুত্রসন্তান অধিকতর কাম্য হওয়ার ফলেই কন্যাসন্তানরা অবমাননা ও হীনম্মন্যতার ভুক্তভোগী হয় বেশি। তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে, কন্যাশিশুদের মনস্তত্ত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বিভিন্ন পরিবারের এমন আচরণ, যেখানে কন্যাসন্তানদের যৌনতাকেই তাদের আত্মপরিচয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বা ক্ষেত্রবিশেষে একমাত্র, উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
ফলে দেখা যাচ্ছে, তাত্ত্বিকভাবে অবমাননা ও যৌনকরণের শিকার হওয়ার আশঙ্কা ছেলে-মেয়ে দুয়েরই থাকলেও, প্রকৃত বাস্তবতায় এর শিকার প্রধানত হয়ে থাকে মেয়েরাই। আর, তাই তো বাবা-মায়ের অবমূল্যায়নের ঢাল হিসেবে মেয়েশিশুদের মাঝেই আনুগত্য ও স্বপরিচালিত বৈরিভাবসম্পন্ন স্নায়বিক ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার প্রবণতা বেশি।
তবে, এই জেন্ডার-বৈষম্যের ভিত্তি মোটেই জৈবিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক, যেখানে একটি সেক্সকে অন্য সেক্সের চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করা হয়।
অতিরিক্ত তথ্যসূত্র:
Sex and Gender – An Introduction by Hilary M. Lips, Mayfield Publishing Company, 1988.