
আমেরিকান জ্যোতির্বিদ এম. এল. হিউমাসন লাল সরণ পদ্ধতি ব্যবহার করে অনেকগুলো নাক্ষত্রিক বস্তু পর্যবেক্ষণ করেন। এই পর্যবেক্ষণের সাহায্যে বিজ্ঞানী এডউইন হাবল দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করেন যে, আকাশপটে দৃশ্যমান অধিকাংশ ক্ষীণ বস্তুই আসলে আলাদা আলাদা গ্যালাক্সি। দেখতে স্বল্প উজ্জ্বলতার হলেও বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রের সমন্বয়ে একেকটি গ্যালাক্সি গঠিত। খুব বেশি দূরে অবস্থান করছে বলে তাদেরকে ক্ষীণ বলে প্রতিভাত হয়।
তখন পর্যন্ত এটি পরিষ্কার যে, সমস্ত মহাবিশ্বই গ্যালাক্সি দিয়ে পরিপূর্ণ। সবচেয়ে শক্তিশালী অপটিক্যাল টেলিস্কোপ বা সবচেয়ে শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে সবচেয়ে দূরে পর্যবেক্ষণ করলেও দেখা যাবে সে অংশটি গ্যালাক্সি দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। বিস্তৃত শূন্যস্থানের মাধ্যমে এসব গ্যালাক্সি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। মহাবিশ্ব নিয়ে আলোচনার গভীরে যাবার আগে পরিষ্কার হওয়া উচিত ‘মহাবিশ্ব’ বলতে কী বোঝায়।
শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে সবচেয়ে দূরবর্তী স্থানেও আমরা গ্যালাক্সির অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছি। এমনটা মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে পর্যবেক্ষণকৃত সবচেয়ে দূরের গ্যালাক্সির বাইরেও আরো অনেক গ্যালাক্সি বিদ্যমান আছে। ধারণা করা হয়, আমাদের চোখে দৃশ্যমান সবচেয়ে দূরের গ্যালাক্সিতে যদি বুদ্ধিমান প্রাণের অস্তিত্ব থাকে এবং তারাও যদি টেলিস্কোপ দিয়ে মহাবিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করে তাহলে আমাদের মতোই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবে। যেদিকেই তাকাক না কেন, যত দূরেই তাকাক না কেন, সবদিকে সবখানেই গ্যালাক্সির অস্তিত্ব খুঁজে পাবে। এভাবে হিসাবকৃত সকল গ্যালাক্সির সমষ্টিকে বলা যেতে পারে ‘মহাবিশ্ব’।

চিত্র: প্রত্যেকটি বিন্দুই এক একটি স্বতন্ত্র গ্যালাক্সি; Source: NASA
উপরের বক্তব্যকে মহাবিশ্বের সংজ্ঞা বলে ধরে নিলে এখান থেকে একটি প্রশ্নের জন্ম হয়। এমন কোনো গ্যালাক্সির অস্তিত্ব থাকতে পারে কি যারা এই সমষ্টির বাইরে অবস্থিত? এই প্রশ্ন আবার মহাবিশ্বের আরেকটি বিকল্প সংজ্ঞার সাথে সাথে সম্পর্কিত- জগতে অস্তিত্বমান সকল বস্তুকে একত্রে মহাবিশ্ব বলে। সংজ্ঞা দুটির মাঝে মিল থাকলেও তারা উভয়ে এক নয়। আমরা এখানে প্রথম সংজ্ঞাটিকেই ব্যবহার করবো, কারণ দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি কিছুটা জটিলতার জন্ম দেয়।
কিছু কিছু গ্যালাক্সি একত্রে একটি গ্রুপ তৈরি করে। এধরনের গ্রুপকে বলে ক্লাস্টার। একেকটি ক্লাস্টারে কয়েকটি থেকে কয়েক হাজার পর্যন্ত গ্যালাক্সি থাকতে পারে। কিছু তথ্য-উপাত্ত বলছে ক্লাস্টারগুলোও একটি আরেকটির সাথে মিলে গ্রুপ তৈরি করে। এধরনের গ্রুপকে বলা হয় সুপারক্লাস্টার। কয়েকটি সুপার ক্লাস্টার মিলে আবার আরো বড় গ্রুপ তৈরি করে কিনা? সুপার ক্লাস্টারের গ্রুপ কিংবা তার চেয়েও বড় কোনো গ্রুপের সন্ধান এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

গ্যালাক্সির অনেকগুলো ক্লাস্টার মিলে তৈরি করে সুপারক্লাস্টার, ছবিতে লানিয়াকিয়া সুপারক্লাস্টারে লাল চিহ্নিত অংশে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অবস্থান; Image: Nature
পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গড়পড়তাভাবে মহাবিশ্বের সকল স্থানে গ্যালাক্সিগুলো সমানভাবে বণ্টিত। আমরা যদি মহাবিশ্বের দুটি অংশকে বিবেচনা করি এবং গড়পড়তাভাবে তুলনা করি তাহলে তাদেরকে একইরকম বলে মনে হবে। দুই ভিন্ন অংশে গ্যালাক্সির পরিমাণ এবং গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে গড় দূরত্ব প্রায় একই থাকবে।
হিসাব অনুসারে এক গ্যালাক্সি থেকে আরেক গ্যালাক্সির গড় দূরত্ব প্রায় এক মিলিয়ন আলোক বর্ষ। এখন আমরা যদি এই মহাবিশ্বের মাঝে একশো মিলিয়ন আলোক বর্ষ দৈর্ঘ্য, একশো মিলিয়ন আলোক বর্ষ প্রস্থ এবং একশো মিলিয়ন আলোক বর্ষ উচ্চতার দুটি ঘনক কল্পনা করি এবং তাদেরকে তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে তারা প্রায় একইরকম। দেখা যাবে উভয়ের মাঝে মোট গ্যালাক্সির পরিমাণ প্রায় একই এবং গ্যালাক্সিগুলোর মাঝে গড় দূরত্বও প্রায় একই।

Source: Paolo Bottarelli
ঘনক দুটি মহাবিশ্বের যে স্থানেই অবস্থান করুক না কেন তাদের মাঝে গ্যালাক্সির বণ্টন গড়পড়তা একই হবে। এটি শুধু বর্তমান কালের জন্যই নয়, অতীত বা ভবিষ্যতের যেকোনো সময়ের বেলাতেও তারা এরকম সদৃশ হবে। এখানে ‘যেকোনো সময়’-এর নামে মহাবিশ্বের গঠনবিন্যাস সম্পর্কে যে শর্তটি উল্লেখ করা হয়েছে সেটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মহাবিশ্ব পরিবর্তনশীল এবং মহাবিশ্বের যেকোনো স্থানে গ্যালাক্সির সংখ্যাও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়।
পাশাপাশি দূরের গ্যালাক্সির বর্তমান অবস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। দূরের গ্যালাক্সি থেকে অবমুক্ত হওয়া আলো অনেক অনেক পথ অতিক্রম করে আমাদের চোখে এসে ধরা দেয়। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে আলোর মিলিয়ন মিলিয়ন বছর লেগে যায়। বর্তমানে গ্যালাক্সিকে যেরকম দেখছি তা আসলে গ্যালাক্সির মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগের রূপ। সেসব গ্যালাক্সির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কোনো তথ্যই নেই আমাদের কাছে।
আমাদের সাপেক্ষে গ্যালাক্সির বিন্যাস আইসোট্রপিক। এর মানে যেভাবেই পর্যবেক্ষণ করি না কেন, সবদিক থেকে গ্যালাক্সির বিন্যাস একইরকম বলে মনে হবে। আর যদি মেনে নেই মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান বিশেষ কোনো স্থানে নয়, ‘শ্রেষ্ঠ’ তকমার কোনোকিছু দখলও করে রাখছি না, আমাদের গ্যালাক্সিও অন্যান্য সকল গ্যালাক্সির মতোই সাধারণ, তাহলে আরো চমকপ্রদ কিছুর প্রত্যক্ষ করবো। তাহলে দেখতে পাবো গ্যালাক্সিসমূহের বিন্যাস মহাবিশ্বের যেকোনো স্থানের সাপেক্ষেই আইসোট্রপিক। শুধু আমাদের সাপেক্ষেই নয়, মহাবিশ্বের যেকোনো কিছুর সাপেক্ষেই গ্যালাক্সিগুলো সমরূপে বিন্যস্ত। শুধু বর্তমানের কালের জন্যই নয়, অতীত ও ভবিষ্যতের যেকোনো সময়ের জন্যই এটি প্রযোজ্য।
তার উপর গ্যালাক্সির বিন্যাস ও বিস্তৃতি যদি মহাবিশ্বের যেকোনো স্থান থেকেই আইসোট্রপিক হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবে দেখানো যায় যে, গ্যালাক্সিগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

গ্যালাক্সিগুলো আইসোট্রপিক; Source: phy.olemiss.edu
১৯৩০ সালের দিকে হাবল আবিষ্কার করেন দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শুধু এতটুকুই নয়, তিনি তাদের মধ্যে সুস্থিত কিছু নিয়মবদ্ধতাও খুঁজে পান। তিনি দেখতে পান, কোনো গ্যালাক্সি আমাদের কাছ থেকে যত দূরে অবস্থিত তার অপসরণের বেগ তত বেশি। দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর অপসরণের এই বেগ একটি নিয়ম মেনে চলে। একে বলা হয় হাবলের নীতি বা Hubbles’ Law।
এই নীতি বলছে যে, গ্যালাক্সির দূরত্ব কত সেটি জানলেই তার অপসরণ বেগ বের করা যাবে। দূরত্বকে বিশেষ একটি ধ্রুবক দিয়ে গুণ করলেই তার বেগ পাওয়া যাবে। বিশেষ এই ধ্রুবককে বলা হয় হাবল ধ্রুবক। এই ধ্রুবক সকল গ্যালাক্সির জন্য এবং সকল সময়ের জন্য একই থাকে।
গ্যালাক্সির অপসরণের এই ব্যাপারটিকে অন্যাভাবেও বলা যায়। গ্যালাক্সির অপসরণ বেগ তার দূরত্বের সমানুপাতিক। উদাহরণ হিসেবে দুটি গ্যালাক্সির কথা বিবেচনা করতে পারি। একটি গ্যালাক্সি আমাদের কাছ থেকে কোনো এক বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। অপর গ্যালাক্সির অবস্থান প্রথম গ্যালাক্সির দ্বিগুণ দূরে। দ্বিগুণ দূরত্বে অবস্থানের কারণে তার অপসরণ বেগও হবে প্রথম গ্যালাক্সির দ্বিগুণ।
হাবলের এই নীতিটি সকল প্রেক্ষাপটে সঠিক নয়, এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেসকল গ্যালাক্সি আমাদের নিকটে অবস্থান করছে তাদের বেলায় এই নীতি কাজ করে না। সকল গ্যালাক্সিতেই অপসরণ বেগের পাশাপাশি আরো কিছু বেগ কাজ করে। যেমন এক গ্যালাক্সির প্রতি আরেক গ্যালাক্সির আকর্ষণ বেগ। আমাদের নিকটবর্তী গ্যালাক্সিগুলোতেও এরকম কিছু বেগ ক্রিয়াশীল আছে। হয়তো এই ক্রিয়াশীল বেগ এবং অপসরণ বেগ পরস্পর কাটাকাটি হয়ে যায়, যার কারণে তারা আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যায় না। এর অন্যতম একটি উদাহরণ হলো এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি। এটি দূরে সরে তো যায়ই না উপরন্তু আরো কাছে ধেয়ে আসছে ধীরে ধীরে।

আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কি ওয়ের কাছে চলে আসছে প্রতিবেশী এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি; Source: Pop Science
অন্যদিকে খুব নিকটের গ্যালাক্সির পাশাপাশি খুব বেশি দূরের গ্যালাক্সির বেলাতেও হাবলের নীতি কাজ করে না। কারণ, অতি-দূরের গ্যালাক্সিগুলোর বেলায় যদি হাবলের সূত্র প্রয়োগ করা হয় তাহলে দেখা যাবে এদের অপসারণ বেগও হয়ে গেছে অকল্পনীয় পরিমাণ বেশি। এতই বেশি যে এর পরিমাণ হবে আলোর বেগের চেয়েও অধিক। কিন্তু আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বলছে কোনোকিছুই আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারে না। বেগের এই সমস্যার অবশ্য সুরাহা আছে, তবে এই সুরাহা অনেক সূক্ষ্ম ও জটিলতাপূর্ণ।
পাশাপাশি অতি-দূরবর্তী গ্যালাক্সির বেলায় যে হাবলের নীতি কাজ করে না সেটিও একদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই নীতির সাপেক্ষে অতি-দূরের গ্যালাক্সির ব্যতিক্রমী আচরণ আমলে নিয়ে মহাবিশ্বের সামগ্রিক গঠন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। সেসব তথ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে পরবর্তী পর্বে।
উৎস
Islam, Jamal N. (1983), the Ultimate Fate of the Universe, Page 16–18, Cambridge University Press
নোট
বিদ্যমান লেখাটি বিশ্ববিখ্যাত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের দা আল্টিমেট ফেইট অব দা ইউনিভার্স বইয়ের ৩য় অধ্যায়ের একটি অংশের অনুবাদ। বিশ্বের বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই বইটি। কিন্তু আক্ষেপের ব্যাপার হলো বাংলাদেশী এই বিজ্ঞানীর বিশ্ববিখ্যাত এই বইটি স্বয়ং বাংলাতে অনূদিত হয়নি এখনও। মহাবিশ্বের অত্যন্ত চমকপ্রদ একটি বিষয় নিয়ে লেখা বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর অত্যন্ত চমৎকার এই বইটি বাংলায় ফিরিয়ে আনা উচিত ছিল অনেক আগেই। এই দায়িত্ববোধ থেকেই বইটিকে অনুবাদের প্রয়াস নেয়া হয়েছে। বইয়ের পূর্ববর্তী অংশগুলো হলো-
১. আমাদের মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি কী || ২. আমাদের গ্যালাক্সি পরিচিতি || ৩. যেভাবে আবিস্কৃত হয়েছিল এন্ড্রোমিডা ‘গ্যালাক্সি’ || বিশেষ সংযোজন- জামাল নজরুল ইসলামের জীবনী: বিশ্বের বুকে বাংলার গর্ব জামাল নজরুল ইসলাম
Featured Image: hdqwalls.com