নোবেল পুরস্কার বিতর্ক: বিজ্ঞানে নোবেলের নিয়ম-কানুনের অযৌক্তিকতা

২০০৩ সালে বিখ্যাত মার্কিন চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং এমআর স্ক্যানিং মেশিনের আবিষ্কারক রে ডামাডিয়ান এক অদ্ভুত কাজ করে বসেন। তিনি একইসাথে আমেরিকার তিনটি প্রথম সারির পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট এবং লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসে পূর্ণপৃষ্ঠা বিজ্ঞাপন প্রচার করে নোবেল কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন এই বলে যে, তাকে অন্যায়ভাবে নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। 

সে বছর ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং আবিষ্কারের জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে দুই জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, পল লটেরবার এবং পিটার ম্যানসফিল্ড। কিন্তু রে ডামাডিয়ানের দাবি ঐ আবিষ্কারে প্রধান ভূমিকা ছিল তার নিজের। তার মতে, ঐ আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার পেতে হলে প্রথমে তার পাওয়া উচিত, এরপর পাওয়া উচিত পল লটেরবারের। তিনি বলেন, নোবেল কমিটি অন্যায়ভাবে তাকে পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে তাকে যে ইতিহাস থেকেই মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে, তা মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব না।

বিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক নতুন না। একেবারে শুরু থেকেই এ বিতর্ক চলে আসছে। ১৯০১ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের একেবারে প্রথম নোবেল পুরস্কারটি পেয়েছিলেন এমিল ভন বেহরিং। অ্যান্টিটক্সিন আবিষ্কারের জন্য। কিন্তু ঐ গবেষণায় তার ঘনিষ্ঠ সহকারী, বিজ্ঞানী শিবাসাবুরো কিতাসাতো কোনো স্বীকৃতি পাননি। সে সময় অবশ্য এর একটা ব্যাখ্যা ছিল। নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেল তার উইলে লিখে গিয়েছিলেন, এই পুরস্কার এমন ‘একজন ব্যক্তিকে’ দিতে হবে, পূর্ববর্তী বছরে যার আবিষ্কার সমগ্র মানবজাতির জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছিল। কাজেই উইল অনুযায়ী সে সময় একজনের বেশি ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করার নিয়ম ছিল না। 

আলফ্রেড নোবেল; Image Source: ABC Australia

কিন্তু এই নিয়মের সীমাবদ্ধতা বুঝতে নোবেল কমিটির খুব বেশি সময় লাগেনি। বিজ্ঞান বিষয়টা সাহিত্য কিংবা শান্তির মতো ব্যাপার না। এখানে একক উদ্যোগে আবিষ্কার খুব কমই ঘটে। অধিকাংশ গবেষণার পেছনেই জড়িত থাকে দলীয় অবদান। ফলে নোবেল কমিটি পরবর্তী বছরই নিয়মটি সংশোধন করে। একজনের পরিবর্তে তারা তিনজনকে পুরস্কার দেওয়ার বিধান চালু করে। কিন্তু একটি আবিষ্কারের পেছনে ঠিক কোন তিনজন ব্যক্তির অবদান সবচেয়ে বেশি, সে বিতর্কের অবসান কখনোই করা সম্ভব হয়নি।

মাত্র তিনজনকে পুরস্কার দেওয়া নিয়েও বিতর্ক আছে। কোনো গবেষণার পেছনে তিনজনের চেয়ে বেশি বিজ্ঞানী জড়িত থাকলে কীভাবে সেরা তিনজনকে নির্বাচিত করা হবে? উদাহরণস্বরূপ ২০১২ সালে হিগস-বোসন কণা আবিষ্কারের জন্য এর পরের বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান পিটার হিগস এবং ফ্রাঁসোয়া এঙ্গলার। কিন্তু বাস্তবে ঐ গবেষণার পেছনে জড়িত ছিলেন মোট ছয় জন বিজ্ঞানী। 

২০১৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের কথাই ধরা যায়। সে বছর গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য তিন জন বিজ্ঞানীকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। তারা হলেন রেইনার ওয়েইজ, কিপ থর্ন এবং ব্যা‌রি ব্যারিশ। কিন্তু দেড় বছর আগে তারা যখন প্রথম পুরস্কারটির কথা ঘোষণা করেছিলেন, তখন ব্যারি ব্যারিশের নাম সম্ভাব্য পুরস্কারের দাবিদারদের মধ্যে নিচের দিকে ছিল। সে সময় ধারণা করা হচ্ছিল, প্রথম দুজনের সাথে তৃতীয় যে বিজ্ঞানী পুরস্কারটি পাবেন, তিনি হলেন রন ড্রেভার। 

কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় নোবেল কমিটির আরেকটি নিয়মের কারণে। কোনো বিভাগে পুরস্কার পাওয়ার জন্য নোবেল কমিটিতে তাদের নামে সুপারিশ জমা পড়তে হয় সে বছরের জানুয়ারি মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে। কিন্তু ২০১৬ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি যখন প্রথম গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ পর্যবেক্ষণের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছিল, তখন সে বছরের জন্য নমিনেশনের সময়সীমা পার হয়ে গিয়েছিল। তখনই অনেকে নোবেলের তিন জনকে পুরস্কার দেওয়ার নিয়মের সমালোচনা করছিল এই বলে যে, শুধুমাত্র এই নিয়মের কারণেই ব্যারি ব্যারিশ নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হবেন।

এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলবিজয়ীরা; Image Source: nobelprize.org

কিন্তু ২০১৭ সালে যখন পুরস্কার ঘোষণা হয়, তখন দেখা যায় ব্যারি ব্যারিশের নাম থাকলেও রন ড্রেভারের নাম নেই। কেন? এর কারণ নোবেলের আরেকটি বিতর্কিত নিয়ম। নোবেল পুরস্কার মরণোত্তর দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। যত গুরুত্বপূর্ণ অবদানই হোক না কেন, কেবলমাত্র বেঁচে থাকলেই এই পুরস্কার পাওয়া যাবে। ফলে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে মৃত্যুবরণ করার কারণে রন ড্রেনভারের নাম নমিনেশন থেকে বাদ পড়ে যায়, এবং তার পরিবর্তে পুরস্কারটি জোটে ব্যারি ব্যারিশের ভাগ্যে

নোবেল কমিটির এই নিয়মগুলো নিয়ে তাই বিভিন্ন সময় বার বার বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই দাবি করেছেন, এই পুরস্কার বিজ্ঞানের জন্য প্রকৃত অবদানকে মূল্যায়ন করে না। বরং মূল্যায়ন করে অ্যাকাডেমিয়াতে কে কার সাথে যুদ্ধ করে কোনো গবেষণার পেছনে নিজের অবদানকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রতীয়মান করতে সক্ষম হয়, সেই টিকে থাকার যোগ্যতাকে। এছাড়াও যেহেতু মরণোত্তর পুরস্কার প্রদানের নিয়ম নেই, সেই অর্থেও বলা যায়, “টিকে থাকাকেই” নোবেল সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। 

এ বছর রসায়নে নোবেলবিজয়ীরা; Image Source: nobelprize.org

সম্প্রতি অনেকেই নোবেল পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের ব্যক্তিগত অবদানকে মূল্যায়ন না করে দলগত প্রচেষ্টাকে মূল্যায়ন করার আহ্বান জানাচ্ছেন। তাদের মতে, বর্তমান পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সহযোগিতা না, বরং প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব সৃষ্টি হয়। যদি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে, কিংবা কোনো আবিষ্কারের পেছনে জড়িত দলকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলেই সেটাই বরং বিজ্ঞানের জন্য কল্যাণকর হবে।

বর্তমানে খুব কম সংখ্যক আবিষ্কারই একক তো দূরের কথা, মাত্র তিন জন বিজ্ঞানীর পক্ষে করা সম্ভব হয়। অধিকাংশক্ষেত্রেই আবিষ্কারগুলো হয় দলগত প্রচেষ্টার ফলাফল। উদাহরণস্বরূপ যে আবিষ্কারটির জন্য ২০১৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে তিন জনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, সেই গবেষণাপত্রে লেখকদের নাম ছিল মোট তিন পৃষ্ঠাজুড়ে। হিগস-বোসন সংক্রান্ত ভিন্ন একটি গবেষণায় যুক্ত ছিলেন ৫,১৫৪ জন গবেষক!

ভিন্ন একটি বিতর্কও আছে। আলফ্রেড নোবেল যখন তার উইল করেছিলেন, তখন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানই ছিল বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি শাখা। কিন্তু গত সোয়াশো বছরে বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখা অনেক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের প্রথম বাস্তুসংস্থাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান, দ্য ব্রিটিশ ইকোলজিকাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯১৩ সালে। ভূতত্ত্ববিদ্যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ১৯১৫ সালে আলফ্রেড ওয়াগনারের কন্টিনেন্টাল ড্রিফটের ব্যাখ্যা প্রদানের পর থেকে। আবহবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা বৃ্দ্ধি পেয়েছে পঞ্চাশের দশক থেকে। 

Image result for nobel prize
নোবেল পদক; Image Source: sciencemag.org

কিন্তু এসব বিভাগের একটিতেও এখনও পর্যন্ত নোবেল পাওয়ার কোনো সুযোগ সৃষ্টি হয়নি, এমনকি যদি এসব বিভাগের কোনো বিজ্ঞানী যদি মানবকল্যাণে অপরিসীম অবদান রাখেন, তবুও। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের এই সংকটময় মুহূর্তে এসেও তাই পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীদের নোবেল পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, যদি না তাদেরকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

বিপুল পরিমাণ অর্থ ছাড়াও নোবেল পুরস্কারের সাথে বিশাল সম্মান এবং প্রভাবের ব্যাপার জড়িত আছে। নোবেলবিজয়ীরা গণমাধ্যমে অতিরিক্ত গুরুত্ব পান, তাদের যেকোনো বক্তব্যকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়, দেশের এবং বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের সাথেও তারা সাক্ষাৎ করার আমন্ত্রণ পান। ফলে তাদের বিভাগগুলোই আরো গুরুত্ব পায়, আরো ফান্ডিং পায়। অন্যদিকে অবহেলায় পড়ে থাকে পরিবেশ বিজ্ঞানসহ গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের মতো ব্যাপারগুলো।

২০০৯ সালে তাই একজন নোবেলবিজয়ীসহ মোট ১০ জন বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলী নোবেল কমিটির কাছে একটি খোলা চিঠি লিখে দাবি করেছিলেন, নোবেলের নিয়ম-কানুনগুলো যেন সংশোধন করা হয়। তারা যুক্তি দেখিয়েছিলেন, আলফ্রেড নোবেলের উইলে না থাকলেও যেহেতু ১৯৬৮ সালে অর্থনীতিকে নোবেলের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছিল, তাহলে বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রকেও কেন আনা হবে না? বলাই বাহুল্য, রক্ষণশীল নোবেল কমিটির কাছে এখন পর্যন্ত তাদের দাবি গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।

This article is in Bangla language. It's about the absurdity of the rules of Nobel Foundations in scientific fields. All the references are hyperlinked inside the text.

Featured Image: New York Times

Related Articles

Exit mobile version