আজ ২৭ জুলাই বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতে পৃথিবী প্রত্যক্ষদর্শী হতে যাচ্ছে এক দারুণ দুর্লভ মহাজাগতিক ঘটনার। তখন পৃথিবী সরাসরি সূর্য এবং চাঁদের ঠিক মাঝ বরাবর একই সরলরেখায় অবস্থান করবে। পৃথিবীর ছায়া ঢেকে দেবে চাঁদকে। চাঁদের স্নিগ্ধ অবয়ব হয়ে পড়বে লালচে। প্রতিবছর দুইবার করে এরকম ঘটনা ঘটতে দেখা গেলেও আজকের দিনের চন্দ্রগ্রহণটি মহাকাশ নিয়ে আগ্রহীদের কাছে বিশেষ একটি দিন। কারণ এই পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ মধ্য এশিয়া এবং আফ্রিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ১ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট যাবৎ স্থায়ী হবে।
আর্থস্কাইয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে দীর্ঘতম পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ হওয়া সম্ভব ১ ঘন্টা ৪৭ মিনিট ব্যাপী। আর আজকের চন্দ্রগ্রহণ ১ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট। সর্বোচ্চ থেকে ৪ মিনিট কম মাত্র। এদিকে পৃথিবীর প্রতিবেশী মঙ্গলগ্রহ আজকে এই গ্রহণকালীন সময়ে আকাশপটে চাঁদের নিচে থাকবে। তার অবস্থানও এগিয়ে আসবে পৃথিবীর কাছে অনেকটা। কাছাকাছি অবস্থানের কারণে সেসময়ে মঙ্গলগ্রহকে তুলনামূলক উজ্জ্বল এবং স্পষ্ট দেখা যাবে।
শুধু তা-ই নয়, বৃহস্পতি গ্রহের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশও সেসময়ে দৃশ্যমান হবে। পপুলার অ্যাস্ট্রোনমির ভাইস প্রেসিডেন্ট রবিন সেগ্যাল বলেন, পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের পাশাপাশি মঙ্গল ও বৃহস্পতির এই অবস্থান- এরকম ঘটনার চেয়ে বিশেষ ঘটনা মহাকাশপ্রেমীদের কাছে আর কী হতে পারে!
এই পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ বিশ্বের অধিকাংশ এলাকা থেকে দেখা যাবে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় দেখা যাবে স্থানীয় সময় রাত ১টার পরে থেকে। উপচ্ছায়া পর্যায় শুরু হবে ২৭ জুলাই রাত ১১টা ১৪ মিনিটে। এরপরে আংশিক চন্দ্রগ্রহণ শুরু হবে রাত ১২টা বেজে ২৪ মিনিটে আর পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ শুরু হবে রাত ১টা বেজে ৩০ মিনিটে। পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ শেষ হবে রাত ৩টা বেজে ১৩ মিনিটে এবং আংশিক চন্দ্রগ্রহণ শেষ হবে রাত ৪টা বেজে ১৯ মিনিটে।
ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের মাটি থেকে অবশ্য শুরু থেকে গ্রহণ দেখা যাবে না। তখন দেশগুলোর অবস্থান থাকবে দিগন্তের নিচে। মধ্য এবং উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় চন্দ্রগ্রহণটি দৃশ্যমান হবে স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। উত্তর আমেরিকানদের কিছুটা দুর্ভাগ্য, কানাডার কিছু অংশ এবং ক্যারিবিয়ার পূর্বাংশ বাদে আমেরিকার কোনো অংশ থেকেই থেকে এই গ্রহণ দেখা যাবে না। এর পরবর্তীতে ২০১৯ সালের চন্দ্রগ্রহণ অবশ্য উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা থেকেই সবচাইতে ভালোভাবে দেখা যাবে।
গ্রহণের সময়ে চাঁদের রঙ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হতে দেখা যায়। সেসময়ে চাঁদকে লালচে দেখাবার কারণে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণকে ‘ব্লাড মুন’ বলেও ডাকা হয়। এ নিয়ে নানা দেশে বহু কুসংস্কার প্রচলিত আছে। এমনকি অনেক জায়গায় একে পৃথিবী ধ্বংসের আলামত হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
এ ব্যাপারে গ্রিনিচের রয়্যাল অবজারভেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডক্টর গ্রেগরি ব্রাউন বলেন, চাঁদের এই অশুভ রূপ ধারণ করা আশ্চর্য কিছু না। চন্দ্রগ্রহণ চলাকালীন সময়ে সূর্যের আলোর কিছু অংশ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে বিচ্ছুরিত হয়ে চাঁদের ওপরে পড়ে। দৃশ্যমান আলোর মধ্যে লাল রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি, তাই তার বিচ্ছুরণ ঘটে সবচেয়ে কম। সে কারণেই চাঁদ হালকা কমলা থেকে শুরু করে একসময় গাঢ় লাল, এমনকি বাতাস পরিষ্কার থাকলে একে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণও ধারণ করতে পারে।
সূর্যগ্রহণের সময় কিন্তু এরকম কিছু ঘটে না। তাই সূর্যকে পুরোপুরি কালো হয়ে যেতে দেখা যায়। এ বছরের ৩১ জানুয়ারির চন্দ্রগ্রহণটি ১ ঘন্টা ১৩ মিনিট স্থায়ী ছিল। আবার ২০১৯ এর ২১শে জানুয়ারি উত্তর আমেরিকা থেকে যে চন্দ্রগ্রহণটি দেখা যাবে, তার স্থায়িত্বকাল হবে মাত্র ১ ঘন্টা ২ মিনিট।
সময়ের এরকম তারতম্য হবার কারণ কী? চাঁদ সূর্যের আলোকে পৃথিবীতে পৌঁছাতে বাধা দিলেই সূর্যগ্রহণ সংঘটিত হয়। তবে এর স্থায়িত্ব সবসময়েই চন্দ্রগ্রহণের থেকে কম হয়। লুইজিয়ানার নিকোলস স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিদ ক্যায়সা ইয়ং বলেছেন, এর পেছনে প্রভাব রাখে তাদের ছায়ার আকারের পার্থক্য। সহজ ভাষায় সূর্যগ্রহণ হলো, বড় একটি গ্রহের ওপরে ছোট একটি গ্রহের (এক্ষেত্রে উপগ্রহ) ছোট আকারে ছায়া ফেলা। আর চন্দ্রগ্রহণ হলো ছোট একটি গ্রহের ওপরে বড় একটি গ্রহের (এক্ষেত্রে নক্ষত্র) বড় আকারে ছায়া ফেলা। সূর্যগ্রহণের সময়ে প্রচ্ছায়া অর্থাৎ সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা কয়েক ডজন মাইল লম্বা হয়। কিন্তু পৃথিবীর প্রচ্ছায়া বিশাল, চাঁদের এই অংশ পার হতে অনেক বেশি সময় লাগে। কেননা চাঁদ এই অঞ্চলের প্রান্ত দিয়ে নয়, মাঝ বরাবর পার হয়।
প্রতিবছর দুইবার করে সূর্য, পৃথিবী এবং চাঁদ একই সরলরেখায় আসে। পৃথিবীর অবস্থান থাকে সূর্য এবং চাঁদের মাঝখানে। থাকলে সেটা চন্দ্রগ্রহণ। আর চাঁদের অবস্থান পৃথিবী এবং সূর্যের মাঝখানে থাকলে হবে সূর্যগ্রহণ। সেকারণেই সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ সাধারণত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে জোড়ায় জোড়ায় হতে দেখা যায় এবং একবছরে দুইবার করে সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ হতে দেখা যায়। তবে অবস্থান সবসময় একইরকম না থাকার কারণে সেগুলো আজকের মতো ব্যাপক আকারে হয় না।
তাছাড়া চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ বছরের কোন সময়ে সংঘটিত হচ্ছে, সেই ব্যাপারটিও এদের স্থায়ীত্বের ওপরে প্রভাব রাখে। জুলায়ে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব সবচেয়ে বেশি থাকে। সেকারণে পৃথিবী এবং চাঁদ দুইয়ের ছায়াই তুলনামূলক বড় থাকে। এদিকে জানুয়ারি মাসে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব থাকে সবচেয়ে কম। সুতরাং উত্তর গোলার্ধে যখন গ্রীষ্মকাল, তখনই চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণের স্থায়িত্বকাল হয় সবচেয়ে বেশি। তেমনই উত্তর গোলার্ধে শীতকাল হলে এদের স্থায়িত্বকাল কমে যায়। তাই ২৭শে জুলাইয়ের চন্দ্রগ্রহণটি এত বেশি সময় স্থায়ী হতে যাচ্ছে।
খালি চোখে সূর্যগ্রহণ দেখার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও চন্দ্রগ্রহণ দেখতে কোনো বাধা নেই। আশেপাশের এলাকা যত বেশি অন্ধকার হবে এবং আবহাওয়া যত বেশি পরিষ্কার থাকবে, চন্দ্রগ্রহণের দৃশ্য তত বেশি স্পষ্টভাবে চোখে ধরা দেবে। মহাকাশের ব্যাপারে উৎসাহীদের জন্য ২০১৮ সালটা দারুণ। এ বছরের জানুয়ারি মাসের ৩১ তারিখেই দেখা গিয়েছিল সুপার ব্লু ব্লাড মুনের নমুনা। কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসায় চাঁদকে সেদিন দেখা গিয়েছিল স্বাভাবিকের চাইতে ৭গুণ বড় আকারে। সর্বশেষ সুপার ব্লু ব্লাড মুন দেখা গিয়েছিল দেড়শ বছর আগে ১৮৬৬ সালের ৩১শে মার্চ। তার ছয়মাস বাদেই আবার এই বিশেষ ঘটনা। এরকম দৈর্ঘ্যের পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ দেখতে আবার অপেক্ষা করতে হবে ২১২৩ সাল পর্যন্ত।