দেখতে দেখতে ২০১৭ সালও শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঘটনাবহুল এই বছরের বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক প্রাঙ্গণে ঘটে গেছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বছর জুড়েই বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। এক্ষেত্রে থেমে নেই বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রাও। বছরের বিভিন্ন সময়ে নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনে মুখর ছিল বিজ্ঞানমহল। তাই ২০১৭-কে বিদায় জানানোর লগ্নে চলুন একবার দেখে নেয়া যাক পপুলার সায়েন্সের মতে এই বছরের সাড়া জাগানো বৈজ্ঞানিক ঘটনাগুলো।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের চমক
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ২০১৭ সালের কোনো নতুন আবিষ্কার নয়। এই তরঙ্গের সাহায্যে ব্ল্যাকহোল সংঘর্ষ নির্ণয় করার মতো চমৎকার সব কাজ করা সম্ভব। কিন্তু ২০১৭ সালে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। LIGO এবং Virgo Observatory এর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেপ্টেম্বরের দিকে বিজ্ঞানীরা সর্বপ্রথম এই তরঙ্গ নির্ণয় করতে সক্ষম হন। এই আবিষ্কারে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালের পদার্থবিজ্ঞানের সম্মানজন নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয় রাইনার ওয়েস, ব্যারি বেরিশ এবং কিপ থর্নকে।
কিন্তু এখানেই থেমে যাননি বিজ্ঞানীরা। তারা এই তরঙ্গের সাহায্যে আরও গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। অক্টোবর মাসে গবেষকগণ নিউট্রন নক্ষত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের প্রমাণ পেয়েছেন। এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা সৌরজগতের উৎপত্তি সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারবো। এই পুরো আবিষ্কারের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান মহাকর্ষীয় তরঙ্গের। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী, মাত্র একটি নিউট্রন নক্ষত্রের সংঘর্ষের মাধ্যমে পৃথিবীর ভরের প্রায় ১০০ গুণ পরিমাণ সোনা, কয়েকশত গুণ পরিমাণ প্লাটিনাম এবং দশগুণ ইউরেনিয়াম উৎপাদিত হতে পারে।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আমাদের সামনে এক অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। তাই ২০১৭ সালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ঘটনার তালিকায় মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অবস্থান সবার উপরে।
নবায়নযোগ্য রকেট
মহাকাশযান নির্মাণকারক মার্কিন সংস্থা Space Exploration Technologies Corporation (সংক্ষেপে SpaceX) এ বছরের শুরুর দিকে নবায়নযোগ্য রকেট নির্মাণ করে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। রকেটের লিফটঅফ বুস্টার (Liftoff Booster) একবার ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত না করে তা পুনরায় ব্যবহারের জন্য বিশেষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে এই সংস্থা। ফলে একটি রকেট একবার ব্যবহারের পর পুনরায় উড্ডয়ন করতে সক্ষম হবে। এর দ্বারা রকেট ব্যবস্থাপনায় প্রায় ৩০ শতাংশ ব্যয় হ্রাস পাবে। ফলে মহাকাশযান প্রযুক্তিতে বিনিয়োগও বৃদ্ধি পাবে।
আলিঙ্গন করা রোবট
২০১৭ সালের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীরা এক নতুন ধরনের রোবট তৈরি করতে সক্ষম হন। দেখতে মানুষের মতো হাত-পা বিশিষ্ট না হলেও বেশ আদুরে এই রোবট আপনাকে আলিঙ্গন করতে খুব পছন্দ করে। কিন্তু আলিঙ্গন করা রোবট কোনো নতুন আবিষ্কার নয়। এর আগেও বিজ্ঞানীরা আলিঙ্গন করতে পারা রোবট তৈরি করেছেন। তাহলে এই নতুন রোবটের বিশেষত্ব কী?
বিজ্ঞানীদের মতে, এই রোবট আলিঙ্গনের মাধ্যমে আপনার হৃদপিণ্ডের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম। তাই বিভিন্ন হৃদরোগের চিকিৎসায় এই আদুরে রোবটের আলিঙ্গন আপনার রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা বহুগুণে বাড়িতে দিতে পারে। এখনও রোবটটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে। তাই এর বাজারজাতকরণ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছু সময়। আর চিকিৎসার পূর্বে একটি রোবটের আলিঙ্গন করা ব্যাপারটা মন্দ নয়! হয়তো কয়েক বছর পরে প্রতিটি হৃদরোগ নিরাময় কেন্দ্রে একটি করে রোবটের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাবে। এবার আপনি প্রস্তুত তো? রোবট কিন্তু আসছে!
জীবন বাঁচাতে জিন থেরাপি
স্টেম সেল নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার শেষ নেই। এই স্টেম সেলের (Stem Cell) সাহায্যে দেহের যেকোনো নষ্ট হয়ে যাওয়া কোষ পুনরায় প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। বর্তমান যুগে গবেষণায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অনেক কল্পনাই আজ সত্য হতে চলেছে স্টেম সেলের সাহায্যে। কিন্তু এই বছর ডিসেম্বর মাসে বিজ্ঞানীরা এর সাহায্যে এমন কিছু করে দেখালেন, যা এর আগে কখনো দেখা যায়নি।
Epidermolysis bullosa-নামক রোগে আক্রান্ত সেই বালকের দেহের প্রায় ৮০ শতাংশ বহিত্বক (epidermis) সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। পূর্বে আরো দুজন কিশোরের উপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলেও এই প্রথম কোনো গুরুতর রোগের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। বিজ্ঞানীগণ বালকের দেহের সুস্থ কোষ থেকে বহিত্বকের টিস্যু আলাদা করেন। সেই রোগমুক্ত টিস্যুর সাহায্যে পরবর্তীতে নতুন বহিত্বক টিস্যু উৎপাদন করতে সক্ষম হন।
স্টেম সেল গবেষণায় এই ঘটনা এক নতুন মাইলফলক হিসেবে গণ্য হবে। এর ফলে বিজ্ঞানীরা আরও গুরুতর পর্যায়ে মানব কোষ প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে জিন থেরাপি প্রয়োগ করতে সক্ষম হবেন। বিখ্যাত জার্নাল ন্যাচার এ এই পদ্ধতি সম্পর্কিত বিস্তারিত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।
ক্যান্সার নিরাময়ে বিপ্লব
ক্যান্সারের কারণে প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এই মরণব্যাধি ক্যান্সারকে বধ করার জন্য চালিত গবেষণায় প্রতি বছর প্রায় কয়েক বিলিয়ন ডলারের মতো বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ক্যান্সার নিরাময়ে কোনো মহৌষধ আবিষ্কৃত হয়নি। তবে থেমে নেই গবেষণার অগ্রযাত্রা। সেই অগ্রযাত্রায় নতুন মাইলফলক হিসেবে যুক্ত হয়েছে ২০১৭ সালের নাম।
Center for Cancer Research-এর প্রধান ড. স্টিভেন রোজেনবার্গ এবং তার সহকর্মীরা ক্যান্সার নিরাময়ে এক নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন, যার নাম ‘CAR T-cell Immunotherapy‘। এই পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে দুজন যমজ শিশুর Acute Lymphoblastic Leukemia ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব হয়েছে। এ বছর অক্টোবরে FDA (Food and Drug Administration) কর্তৃক এই চিকিৎসা পদ্ধতি অনুমোদিত হয়েছে। তবে বর্তমানে এই পদ্ধতি শুধু শিশু-কিশোরদের জন্য উপযোগী বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আরো প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে তা সার্বজনীন করা হবে।
ক্যান্সার চিকিৎসায় গতানুগতিক কেমোথেরাপি কিংবা বিকিরণের ব্যবহারের তুলনায় এই পদ্ধতি নিরাপদ। তাছাড়া লিউকেমিয়া চিকিৎসায় এই পদ্ধতিই বর্তমানে সবচেয়ে সফলতম চিকিৎসা। কেমোথ্যারাপির ন্যায় এই পদ্ধতি সরাসরি ক্যান্সার কোষকে আক্রমণ না করে মানবদেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় আক্রমণ করে। আর সবচেয়ে আশাজনক সংবাদ হচ্ছে, তত্ত্বগতভাবে এই এটি ভ্যাক্সিনের ন্যায় কাজ করে। অর্থাৎ একবার দেহে প্রয়োগ করার পর তা চিরদিনের জন্য দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় যুক্ত হয়ে যায়। তাই পুনরায় ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা খুবই কম।
ভিনগ্রহে প্রাণের সন্ধানে
ভিনগ্রহে প্রাণের সন্ধান কোনো নতুন ঘটনা নয়। বিংশ শতাব্দীতে মানুষ যখন প্রথম মহাকাশকে জয় করতে শিখলো, তখন থেকেই ভিনগ্রহে প্রাণের সামান্যতম নিদর্শনের খোঁজে গ্রহ থেকে গ্রহে ছুটে চলছে শত শত কৃত্রিম উপগ্রহ এবং মহাকাশযান। ২০১৭ সালও এর ব্যতিক্রম নয়। এ বছর মহাকাশে প্রাণের সন্ধান অভিযানে বেশ কিছু আশাব্যঞ্জক ফলাফল পাওয়া গেছে।
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে সেরেস নামক এক বামন গ্রহতে জৈব পদার্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। মঙ্গল এবং বৃহস্পতির মাঝামাঝি অঞ্চলে অবস্থিত এই বামন গ্রহ আকারে নিতান্তই ক্ষুদ্র। এই ক্ষুদ্র গ্রহে প্রাণের সন্ধান লাভ করার সম্ভাবনা অনেক কম। তবুও এই গ্রহের জৈব পদার্থের গঠন বিন্যাস বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনেক অজানা তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে। জ্যোতির্বিদদের মতে, সৃষ্টির শুরুতে আমাদের পৃথিবীর তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। তাই ধারণা করা হয়, বহিরাগত বামন গ্রহ কিংবা গ্রহাণুর দ্বারা আমাদের পৃথিবীতে প্রাণের আগমন হয়েছে। সেরেসের বুকে জৈব পদার্থের সন্ধান লাভের মাধ্যমে সেই তত্ত্ব আরও সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করা সম্ভব হবে।
এই বছর এপ্রিলের দিকে গবেষকরা দাবি করেন, শনি গ্রহের অন্যতম প্রধান উপগ্রহ এনসেলাডাস (Enceladus)-এ প্রাণের বিকাশের জন্য অপরিহার্য সবধরনের রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই উপগ্রহের ভূপৃষ্ঠের নিচে পুরো একটি সাগর থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা।
ক্যাসিনির বিদায়
NASA, ESA এবং ইতালীয় মহাকাশ সংস্থার সমন্বয়ে ১৯৯৭ সালে নির্মিত হয় মহাকাশযান ক্যাসিনি। ২০০৪ সালে এই মহাকাশযানটি শনি গ্রহের অক্ষে আবর্তন করা শুরু করে। প্রায় এক দশক ধরে যাত্রা করা ক্যাসিনির সাহায্যে শনি গ্রহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, ছবি এবং এর অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে বহু অজানা তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে। শনি গ্রহের উপগ্রহসমূহ এবং এর বায়ুমণ্ডলের উপাদান সম্পর্কিত অনেক অজানা তথ্য প্রদান করে এই মহাকাশযানটি এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
সুদীর্ঘ ২০ বছরের যাত্রা শেষে এই বছর সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ ক্যাসিনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। একটি মহাকাশযানের বিদায় যেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে একটি সোনালী অধ্যায়ের সমাপ্তি টানলো। ক্যাসিনির অসামান্য অবদানের কারণে শনি গ্রহ সম্পর্কিত আমাদের অনেক ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে, যা প্রাণের সন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এভাবে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ঘটনা এবং আবিষ্কারের মাধ্যমে বছর জুড়েই সরগরম ছিল বিজ্ঞানমহল। দুনিয়া কাঁপানো বিভিন্ন আবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা এক নতুন সম্ভাবনার দিকে খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি। ২০১৮ সালেও এরকম হাজারো আবিষ্কার এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবো, সেই প্রত্যাশায় ২০১৭-কে বিদায় জানাচ্ছি।
ফিচার ইমেজ: NASA