লাল গ্রহ বলে পরিচিত মঙ্গল গ্রহ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যেমন বিপুল উৎসাহ দেখা যায়, সাধারণ মানুষের মাঝেও আগ্রহ কিন্তু মোটেই কম নয়। মানুষের পরবর্তী সম্ভাব্য বাসস্থান হিসেবে বিজ্ঞানীরা যে গ্রহকে বিবেচনা করছেন, সেটি নিয়ে বিস্তর গবেষণা, আলোচনা-সমালোচনা হবে এটিই স্বাভাবিক। তবে মঙ্গল গ্রহের বেশ কিছু ছবিকে ঘিরে রয়েছে রহস্যের জাল। আজ আমরা এই গ্রহের কিছু ছবি ও এর রহস্য সম্পর্কে জানব।
গত শতকের মাঝামাঝি থেকে বিভিন্ন মহাকাশযানের সাহায্যে মঙ্গল গ্রহ এবং এর পৃষ্ঠের ছবি তোলা হচ্ছে। এ পর্যন্ত যত ছবি পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে এমন বেশ কিছু ছবি রয়েছে যেগুলো দেখে মানুষের চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এমনিতেই পৃথিবীর সাথে মঙ্গলের বেশ কিছু সাদৃশ্য রয়েছে, যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে মঙ্গলকে পৃথিবীর বোনও বলা হয়। এর মধ্যে এসব ছবি মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্বের প্রশ্নটি নতুন করে সামনে এনে দেয়।
ফেস অন মার্স
রহস্যের শুরু মঙ্গলের ওপর থেকে তোলা বিভিন্ন ছবি থেকে। ১৯৭৬ সালে ভাইকিং-১ মহাকাশযান মঙ্গলের সিডোনিয়া অঞ্চলের বেশ কিছু ছবি তোলে। সেসব ছবি থেকে মঙ্গলের ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। কিন্তু এসব ছবির মধ্যে অদ্ভুত কিছু জিনিস লক্ষ্য করা যায়।
মঙ্গল গ্রহের সিডোনিয়া অঞ্চলের যে ছবিগুলো নেওয়া হয় তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক পাহাড়ের আকৃতি দেখা যায়। এসবের মধ্যে একটি আকৃতি খুব সহজেই চোখে পড়ে যায়। যেন কোনো মানুষের মুখ তাকিয়ে আছে আমাদেরই দিকে। এই ছবিটি সেসময় তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়। ছবিতে মানুষের মুখাবয়ব এতটাই স্পষ্ট ছিল যে অনেক বিজ্ঞানীই হতভম্ব হয়ে যান। এলিয়েন বিশ্বাসী সোসাইটি একে কাকতালীয় মিল বলতে নারাজ। তারা একে মঙ্গলে বুদ্ধিমান কোনো প্রাণীর অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করাতে লাগলেন।
পরবর্তীতে আরো কিছু মহাকাশযানের সাহায্যে ঐ অঞ্চলের ছবি তোলা হয়। ২০০১ সালে আরো ভালো প্রযুক্তির সাহায্যে তোলা কিছু ইমেজে দেখা যায়- প্রায় ১.৫ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত ঐ অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি পাহাড়ি অঞ্চলের মতোই। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীর মতে, ছবিতে আলো-ছায়ার প্রভাব ও মানব মুখমন্ডলের আকৃতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ভূপ্রকৃতিই এই রহস্যময় ছবির কারণ। একে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘প্যারাডোলিয়া’।
প্যারাডোলিয়া হলো একপ্রকার মানসিক বিভ্রান্তি, যা সৃষ্টি হয় কোনো কিছু দেখার পর যদি তাকে পূর্বের পরিচিত কোনো কিছুর সাথে খুব সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে হয়। এটি অনেক সময় মনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। মঙ্গলের ঐ পাহাড়ি অঞ্চল আকৃতিগত দিক থেকে মানুষের মুখের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়াতেই এটা সকলের কাছে এত রহস্যময় বলে মনে হয়। আর এর সাথে ছবি তোলার সময় সূর্যের আলোর কারসাজি একে আরো বেশি বাস্তব করে তোলে।
উড়ন্ত আলো
মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে আরো জানার জন্য নাসার পাঠানো বিভিন্ন রোবট আমাদের অনেক তথ্য দেয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো কিউরিওসিটি-১। ২০১৯ সালের জুন মাসে কিউরিওসিটির ক্যামেরায় ধরা পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য। মঙ্গলের পৃষ্ঠ থেকে পাঠানো এক ছবিতে দেখা যায় দিগন্তের কাছাকাছি একটি উড়ন্ত আলোর গোলা একস্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে যাচ্ছে।
নাসার ওয়েবসাইট থেকে এই ছবি প্রকাশ করার পর মুহুর্তেই তা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ইউএফও সন্ধানী সোসাইটি এই ছবিকে মঙ্গলে বুদ্ধিমান কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব হিসেবে দাবী করে। তাদের দাবী, ঐ উড়ন্ত আলোর উৎস মঙ্গলের কোনো উন্নত প্রযুক্তি। কিন্তু নাসার বিজ্ঞানীরা এই প্রস্তাব পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন। তাদের মতে, মঙ্গলের মাটিতে রয়েছে খুব চকচকে পাথর বা গ্লিন্ট রকস। এই পাথরে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়েই এই আলো তৈরি হয়েছে। আরেকদল বিজ্ঞানী মনে করেন, কিউরিওসিটির ক্যামেরার অভ্যন্তরে কোনো সূক্ষ্ম ছিদ্রপথে সূর্যের আলো প্রবেশ করে এই বিভ্রান্তিমূলক ছবির সৃষ্টি হয়েছে।
উড়ন্ত চামচ
মঙ্গল গ্রহ থেকে বিভিন্ন সময় তোলা বিভিন্ন ছবিতে একধরনের চামচ সদৃশ বস্তুর দেখা পাওয়া যায়, অনেকটা যেন শূন্যে ভেসে আছে এমন চামচ। ঠিক এর নিচের ভূমিতে এই চামচের ছায়াও দেখা যায়। অনেকে মনে করেন, এটি এলিয়েনদের উড়ন্ত চামচ! কিন্তু বিজ্ঞানীরা এরও ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
বিজ্ঞানীদের মতে, এটি মঙ্গলের একটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ভূপ্রাকৃতিক অবস্থা। মঙ্গলের রুক্ষ শুষ্ক পাহাড় বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণ, যেমন- আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা, ভূমিক্ষয় প্রভৃতি কারণে এ ধরনের আকৃতি লাভ করে থাকতে পারে। এর সাথে উন্নত মস্তিষ্কের কোনো প্রাণীর সম্পর্ক নেই।
মঙ্গলের নারী
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার প্রকাশিত আরেকটি ছবি ‘লেডি অব মার্স’। কিউরিওসিটি রোভারের তোলা এই ছবিতে দেখা যায় মঙ্গলের শুষ্ক এক পাহাড়ি অঞ্চল। তবে আরো একটু কাছ থেকে দেখলে নারীর মতো এক অবয়ব দেখা যায়। এই নারী যেন আমাদেরই দিকে তাকিয়ে আছে।
অনেকের মতে, এটি মঙ্গলে প্রাণের পরিষ্কার উদাহরণ। আবার অনেকের মতে এটি মঙ্গল গ্রহে কোনো প্রাচীন সভ্যতার মূর্তি। তবে বিজ্ঞানীরা বলেন অন্য কথা। এখানেও তারা এর ব্যাখ্যা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন প্যারাডোলিয়া বা দৃষ্টিভ্রম। তাদের মতে, এটি ঐ পাহাড়ের একটি অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। পাহাড়ের ঐ অংশের আকৃতি অনেকটা নারী দেহের আকৃতির মতো হওয়ায় আমাদের চোখ সেটিকে দাঁড়িয়ে থাকা নারী বলে ভুল করে। এছাড়া ওখানে আর কোনো রহস্য নেই। যদিও অনেকেই নাসার এই ব্যাখ্যা মানতে নারাজ।
মঙ্গলের মাকড়সা
মঙ্গল গ্রহ থেকে আরো একটি আলোচিত ছবি তোলা হয় মঙ্গলের দক্ষিণ মেরু থেকে ২০১৮ সালের মে মাসে। এই ছবিতে দেখা যায় অনেক মাকড়সাসদৃশ বস্তু, যা দেখলে মনে হয় অনেক মাকড়সা একসাথে দল বেধে চলছে।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এগুলো মাকড়সা নয়, কোনো জীবন্ত প্রাণীও নয়। এগুলো আসলে মঙ্গলের মাটিতে থাকা কার্বন ডাইঅক্সাইড আইস ক্যাপ, যা শীতকালে এমন আকৃতি ধারণ করে জমে থাকে। মঙ্গলে বসন্ত কাল এলে ধীরে ধীরে সূর্যের আলোয় দাগগুলো ফুটে উঠতে থাকে। সেই ছবিটিই ধরা পড়ে কিউরিওসিটির ক্যামেরায়।
প্রাণীর হাড়
২০১৪ সালে কিউরিওসিটি রোভারের তোলা আরো একটি ছবি নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। ছবির চিহ্নিত বস্তুটিকে অনেকে মানুষ বা কোনো ডাইনোসরসদৃশ প্রাণীর উরুর হার বলে মনে করেছেন। অনেকে এ বিষয়ে দৃঢ় মতবাদ প্রকাশ করেছেন যে, এই হাড় কোনো উন্নত প্রাণীর। তাহলে কারা এই প্রাণী এবং কেনই বা আজ তারা বিলুপ্ত তা একটি বড় প্রশ্ন। কিন্তু নাসার বিজ্ঞানীরা এই সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন। তাদের মতে, এগুলো আর্দ্র আবহাওয়া, বাতাস বা পানির প্রবাহের ফলে পাথর ক্ষয় হয়ে সৃষ্টি হয়েছে।
সবুজ বলয়
মঙ্গল গ্রহকে ঘিরে অতি ক্ষীণ বায়ুমন্ডল আছে তা বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই শনাক্ত করেছেন। তবে সেই বায়ুর উপাদানসমূহের মধ্যে কী কী আছে তা একদম নিশ্চিতভাবে এখনও জানা যায়নি।
সম্প্রতি মঙ্গলের আরেকটি ছবি বেশ আলোচনায় এসেছে। ইউরোপ ও রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে মঙ্গলে পাঠানো ট্রেস গ্যাস অর্বিটার (টিজিও) স্যাটেলাইটের তোলা ছবিতে দেখা যায় মঙ্গলের চারদিকে রয়েছে একটি সবুজ বলয়। বিজ্ঞানীদের মতে, এমন সবুজ বলয় সৃষ্টি হতে পারে বায়ুমন্ডলে উপস্থিত অক্সিজেন থেকে। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে মেনে নিতে হয় যে, মঙ্গলের বায়ুতে অক্সিজেন রয়েছে। আর বায়ুতে অক্সিজেন থাকলে মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনাও বহুগুণ বেড়ে যায়।
মঙ্গল গ্রহ নিয়ে এখন সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় হলো এই গ্রহ কি একদিন মানুষের বাসযোগ্য হয়ে উঠবে কি না। আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই মঙ্গলের বায়ুমন্ডল, ভূপ্রকৃতি, এবং সেখানে কোনো প্রাণী বা অণুজীবের অস্তিত্ব বর্তমান বা পূর্বে কখনও ছিল কি না এই বিষয়গুলো সামনে আসে।
মঙ্গলের দিন-রাতের দৈর্ঘ্য এবং ঋতু পরিবর্তন প্রায় পৃথিবীরই মতো। এর মেরু অঞ্চলে বরফের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় এবং তরল পানিও একসময় ছিল বলে ধারণা করা হয়। পাশাপাশি বায়ুমন্ডলে যদি অক্সিজেনের উপস্থিতি আবিষ্কার করা যায় তবে মঙ্গল গ্রহ থেকে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াও অসম্ভব কিছু হবে না, হোক সে উদ্ভিদ বা প্রাণী অথবা কোনো আণুবীক্ষণিক জীব।