মহাকাশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও সুন্দর বস্তু হলো নীহারিকা বা নেবুলা। নীহারিকা হচ্ছে একপ্রকার মহাজাগতিক মেঘ। ‘নেবুলা’ শব্দের অর্থ মেঘ। এই বিশেষ মেঘ গঠিত হয় ধুলো আর গ্যাসের সংমিশ্রণে। প্রাচীন আকাশ পর্যবেক্ষকেরা আমাদের ছায়াপথ মিল্কি ওয়ের বাইরে অবস্থিত মহাকাশের সমস্ত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুকেই নীহারিকা বলে মনে করতো। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ছায়াপথ এন্ড্রোমিডাকেও ছায়াপথ না বলে নীহারিকা বলেই ডাকা হতো। বিংশ শতাব্দীতে শক্তিশালী টেলিস্কোপের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের ফলে এই ধারণার ইতি ঘটে। নীহারিকার গঠন, গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টিতে এদের ভূমিকা, বিচিত্র রকমফের প্রভৃতি কারণে এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে ব্যাপক কৌতুহল আর আগ্রহের বস্তু। সে আগ্রহের বস্তু নিয়েই জানবো আজকে।
নীহারিকা কীভাবে গঠিত হয়?
বিজ্ঞানীরা বলছেন মহাকাশের শূন্যস্থানকে শূন্য বলা হলেও সেখানে আদতে নিরবচ্ছিন্ন শূন্যতা বিরাজ করে না। মহাশূন্যে থাকে গ্যাস আর ধূলিকণা, যাদের একত্রে আন্তঃনাক্ষত্রিক উপাদান (Interstellar Medium) বলে। এর শতকরা ৯৯ ভাগ গঠিত হয় গ্যাস দিয়ে। গ্যাসের শতকরা ৭৫ ভাগ হাইড্রোজেন আর ২৫ ভাগ হিলিয়াম। গ্যাসসমূহ চার্জ নিরপেক্ষ পরমাণু-অণু বা চার্জিত কণা (আয়ন বা ইলেকট্রন) উভয় হিসেবেই থাকে। এরা খুব হালকাভাবে ছড়ানো থাকে। এক ঘন সেন্টিমিটারে গ্যাসীয় মাধ্যমে গড়ে থাকে মাত্র একটি পরমাণু। সে তুলনায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের এক ঘন সেন্টিমিটারে প্রায় ত্রিশ কুইন্টিলিয়ন (৩×১০ˆ১৯ ) সংখ্যক অণু থাকে। আন্তঃনাক্ষত্রিক উপাদানগুলো যখন মহাকর্ষীয় সংবন্ধন (Gravitational Collapse)-এর মধ্য দিয়ে যায়, তখন নীহারিকা গঠিত হয়।
মহাকর্ষীয় সংবন্ধন হচ্ছে এমন একটি অবস্থা, যখন আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুগুলো নিজেদের আকর্ষণ বলের প্রভাবে পরস্পর একত্র হয়। এই প্রক্রিয়াতেই নক্ষত্র গঠিত হয়। আমাদের ছায়াপথের কালপুরুষ নীহারিকা এমনই একটি উদাহরণ। বেশিরভাগ নীহারিকাই অবিশ্বাস্য রকমের বড় হয়। এদের ব্যাস হয় কয়েক আলোক বর্ষ থেকে কয়েক হাজার আলোকবর্ষের সমান। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে নীহারিকার ছবিও দেখা যায়। বর্ণিল সেসব ছবি দেখলে সৌন্দর্যে চোখ কপালে উঠে যায়। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় নীহারিকার দিকে।
নীহারিকার শ্রেণীবিভাগ
নীহারিকা প্রধানত চার ধরনের হয়। এই ধরনগুলো হলো:
১. বিক্ষিপ্ত নীহারিকা (Diffuse Nebulae)
বেশিরভাগ নীহারিকাই এই শ্রেণীতে পড়ে। এহেন নামকরণের কারণ হলো, এরা অনেক অনেক এলাকাজুড়ে বিস্তৃত থাকে। মনে হয় যেন এর কোনো সীমা পরিসীমা নেই। এই নীহারিকাকে আবার দুটি রকমফের আছে।
১ (ক). নির্গমন নীহারিকা (Emission Nebulae)
এ ধরনের নীহারিকারা আয়নিত হাইড্রোজেন পরমাণু দিয়ে গঠিত হয়। সেখান থেকে বিকিরণ নির্গত হয়, যা বিশেষভাবে রঙ্গিন চিত্রে চিত্রিত করলে দেখতে খুব আকর্ষণীয় লাগে।
মিল্কিওয়ে ছায়াপথের সবচেয়ে উজ্জ্বল নীহারিকা কালপুরুষ একটি নির্গমন নীহারিকা। এ ধরনের আরেকটি নীহারিকা আছে উত্তর আমেরিকার মানচিত্রের মতো দেখতে। এর নাম হচ্ছে নর্থ আমেরিকা নেবুলি।
১ (খ). প্রতিফলন নীহারিকা (Reflection Nebulae)
এই নীহারিকাগুলো এদের গায়ে এসে পড়া আশেপাশের দীপ্তমান নক্ষত্রের আলোকে প্রতিফলিত করে উজ্জ্বল হয়।
২. অস্থিরমতি নীহারিকা (Planetary Nebulae)
স্বল্প ভরের কোনো নক্ষত্র জীবনচক্রের শেষ ধাপে এসে যখন লাল বামনে পরিণত হতে শুরু করে, তখন এর বাইরের স্তর ক্ষয়ে যেতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় এতে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয় এবং অতিবেগুনি রশ্মি নির্গত করে। সে রশ্মি আশেপাশ ছিটিয়ে থাকা হারানো পদার্থকে আয়নিত করে দেয়। এরা আলো নির্গমন করে উজ্জ্বল হয় এবং নীহারিকার ন্যায় আচরণ করে। নাম প্ল্যানেটারি হলে কী হবে, এর সাথে প্ল্যানেট বা গ্রহের কোনো সম্পর্কই নেই।
এ ধরনের নীহারিকা মোটামুটি গোলাকার এবং উজ্জ্বল রংয়ের হয়ে থাকে। মজার মজার নামে এদের নামকরণ করা হয়ে। যেমন- বিড়ালের চোখের মতো দেখতে ক্যাটস আই নীহারিকা, গোলাকার হেলিক্স নীহারিকা। আরও আছে গ্রিনল্যান্ডের বরফবাসী এস্কিমোদের চেহারার মতো দেখতে এস্কিমো নীহারিকা। আছে নিখাদ লেবুর এক টুকরো পাতলা অংশের মতো আকৃতির লেমন স্লাইস নীহারিকা।
৩. সুপারনোভাজাত নীহারিকা (Supernova remnant nebulae)
অল্প জীবনকালের কিছু ভারী নক্ষত্রের জীবন শেষ হয় বিশাল এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এধরনের নক্ষত্রকে বলে সুপারনোভা। সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে তারার বাইরের অংশ, ধুলো, গ্যাস আর বিপুল পরিমাণ শক্তি অবমুক্ত করে। বিস্ফোরণের ফলে যে শক্তি নির্গত হয়, তা আশেপাশের গ্যাসগুলোতে আয়নিত করে ফেলে। তখন পুরো এলাকাটিকে উজ্জ্বল দেখায়। এভাবে সুপারনোভার ধ্বংসস্তুপ থেকে জন্ম হয় এই নীহারিকার।
ক্র্যাব নেবুলা বা কর্কট নীহারিকা হলো একটি বিখ্যাত সুপারনোভা নীহারিকা। ১,০০০ বছর আগে এক চীনা জ্যোতির্বিদ দেখতে পান, আকাশে নতুন একটি তারা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। দু’বছর পর সেটি উধাও হয়ে যায়। সেই উজ্জ্বল তারা ছিল আসলে একটি সুপারনোভা, যাকে বর্তমানে আমরা কর্কট নীহারিকায় নামে ডাকি।
৪. অন্ধকার নীহারিকা (Dark Nebulae)
এই নীহারিকার অন্ধকার মেঘ কোনো আলো বিকিরণ করে না। ঘনত্ব বেশি হবার কারণে এদের পেছনের দিকের নক্ষত্র থেকে আলো আসতে পারে না। আলোকে আটকে দিয়ে অন্ধকার করে রাখে বলেই এই নাম। এই নীহারিকাগুলোর নামও মজার। যেমন- সাপের আকৃতিধারী স্নেক নীহারিকা। আরও আছে ঘোড়ার মাথার মতো দেখতে হর্সহেড নীহারিকা।
নীহারিকা পর্যবেক্ষণের ইতিহাস
১৫০ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত গ্রীক জ্যোতির্বিদ ক্লডিয়াস টলেমি তার ‘আলমাজেস্ট’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, তিনি পাঁচটি আবছা তারা দেখতে পেয়েছেন। তিনি এও লিখেছিলেন, উরসা মেজর এবং লিও নক্ষত্রমণ্ডলীর মাঝখানে তারাবিহীন একটি মেঘাচ্ছন্ন এলাকা দেখেছেন। সর্বপ্রথম সত্যিকারের নীহারিকার কথা উল্লেখ করেন অবশ্য পার্সিয়ান জ্যোতির্বিদ আব্দুর রহমান আল-সুফী। তিনি এন্ড্রোমিডা ছায়াপথের কাছেই একটা মেঘাচ্ছন্ন অঞ্চল দেখতে পান। ১৬১০ সালে ফরাসী জ্যোতির্বিদ পেইরেস্ক টেলিস্কোপ ব্যবহার করে কালপুরুষ নীহারিকা আবিষ্কার করেন। ১৭১৫ সালে এডমন্ড হ্যালি তার দেখা ছয়টি নীহারিকার কথা উল্লেখ করেন। এরপর ধীরে ধীড়ে বিভিন্ন জ্যোতির্বিদের অবদানে আবিষ্কৃত নীহারিকার সংখ্যা বেড়ে চলছিল। এ সংখ্যা আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় উইলিয়াম হার্শেল আর তার বোনের পর্যবেক্ষণের ফলে। এভাবে হাজার খানেক নীহারিকার দেখা পাওয়া যায়। তবে তখনো পুরোপুরি জানা ছিল না নীহারিকা আসলে কী, তারার সাথে এদের সম্পর্ক কী।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল এবং স্লাইফার অনেক নীহারিকা এবং তারার বর্ণালী সংগ্রহ করেন এবং তা পর্যবেক্ষণ করেন। ১৯২২ সালে গবেষণালব্ধ তথ্যের উপর ভিত্তি করে হাবল ঘোষণা দেন যে, নীহারিকা আসলে তারার সাথে সম্পর্কিত। এদের আলো তারা থেকেই আসে। হাবলের ঘোষণার পর সব বিতর্কের অবসান ঘটে।
একটি তারা যখন জন্ম নেয়, তখন যে উপাদানগুলোর প্রয়োজন পড়ে, তারার মৃত্যুর সময়ও সেই একই উপাদানগুলোই ছড়িয়ে পড়ে। আর এই উপাদানগুলো নীহারিকাতেই থাকে। নীহারিকাতেই তারার জন্ম নীহারিকাতেই তারার মৃত্যু। নক্ষত্রে ঠাঁসা, নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত সুবিশাল মহাকাশের সৌন্দর্যরাজিতে নীহারিকার অবস্থান একদমই অনন্য।
ফিচার ইমেজ- Wikimedia Commons (Witches Broom by Ken Crawford)