বলুন তো, পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে জটিল ও দুর্বোধ্য জিনিস কোনটি?
কী, পারছেন না? অনেক ব্রেইনস্টর্মিং করতে হচ্ছে?
থাক, আপনাদের আর অহেতুক মাথা খাটিয়ে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। আমিই বলে দিচ্ছি উত্তরটা। এই যে আপনারা মাথা খাটাচ্ছেন যে জিনিসটির উপর নির্ভর করে, অর্থাৎ মস্তিষ্ক, সেটিই সম্ভবত পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে জটিল ও দুর্বোধ্য জিনিস!
কেন বলছি এ কথা? কারণ, মানব মস্তিষ্কে থাকে ৮৫ বিলিয়ন নার্ভ সেল এবং ট্রিলিয়নের পর ট্রিলিয়ন আন্তঃসংযোগ। এসব সেল নানাবিধ তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে বলেই, মানুষ অভিজ্ঞতা লাভ করে চেতনা ও চিন্তাভাবনার।
মানব মস্তিষ্ক আরো বেশি রহস্যমণ্ডিত এ কারণে যে, এটিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব কেবল যখন এটি জীবন্ত অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ এটিকে সত্যি সত্যি, যথাযথভাবে খতিয়ে দেখা সম্ভব শুধু তখন, যখন এটি পরিপূর্ণরূপে কাজ করছে একটি মানবদেহের অভ্যন্তরে।
খুব কম মানুষই আছে, যারা সুস্থ ‘মস্তিষ্কে’, ঠাণ্ডা মাথায়, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সায় দেবে তাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে বিভিন্ন যন্ত্র ও সেন্সর প্লাগইন করতে। আর এর কারণ বুঝে ওঠাও খুব একটা কঠিন নয়। মানব মস্তিষ্কে এসব জিনিস প্লাগইন করতে গেলে প্রয়োজন পড়ে মাথার খুলিতে ছিদ্র করার, যার ফলে ইনফেকশন বা ব্রেইন ড্যামেজের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তাই তো, যেসব স্নায়ুবিজ্ঞানীরা মানব মস্তিষ্ককে বোঝার চেষ্টা করছেন, তারা সরাসরি মানব মস্তিষ্ক নিয়ে নাড়াচাড়ার বদলে, হাত বাড়াচ্ছেন মানুষের নিকটতম আত্মীয়-প্রজাতির দিকে। বানর তার মাঝে অন্যতম।
এ বিষয়টি যথেষ্ট বিতর্কিত। মানব স্নায়ুবিজ্ঞানের যোগ্য মডেল হিসেবে বানরের মস্তিষ্ককে বেছে নেয়া হচ্ছে বটে, কিন্তু তাতে করে উদয় হচ্ছে এক নতুন প্রশ্নের- বানরের মস্তিষ্ক যদি মানব মস্তিষ্কের এত কাছাকাছিই হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই বানরের মস্তিষ্ক নিয়ে নাড়াচাড়ার ফলে বানররাও ঠিক তেমনই কষ্ট পাচ্ছে, যেমন কষ্ট পাওয়ার কথা মানুষের?
পশু অধিকার রক্ষায় সক্রিয় কর্মীরাও তাই সঠিক জায়গাতেই আঙ্গুল তুলে থাকেন- এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বানররা তো সম্মতি দেয় না। মানুষের সম্মতি যেমন মহাগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, বানরের সম্মতি তা নয় কেন? তবে কি জর্জ অরওয়েলের বলা কথাই ঠিক যে, “All animals are equal, but some animals are more equal than others.”?
এই প্রশ্ন ও তৎসংশ্লিষ্ট বিতর্ক ঝড় তুলেছে গোটা বিশ্বব্যাপী, কিন্তু এর প্রভাব সমানভাবে পড়েনি সর্বত্র। ইউরোপ ও আমেরিকায়, পশু অধিকার রক্ষায় সক্রিয় কর্মীদের আন্দোলনে জেরবার হয়ে, বানরের উপর করা স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণা ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছে। উভয় মহাদেশেই পথ খোঁজা হচ্ছে যেন আইনের ভেতরে থেকেই, নিরাপদে (হোক তা যতই মন্থর গতিতে) বানরের মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়। কিন্তু চীন ও জাপানের মতো দেশগুলোতে পশু অধিকারের সক্রিয় কর্মীদের খুব একটা ‘উৎপাত’ না থাকায়, তারা তুমুল বেগে এগিয়ে চলেছে এই সেক্টরে, বানরের মস্তিষ্ককে পুঁজি করে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমেরিকা ও ইউরোপের উচিত চীন ও জাপানের সঙ্গে তাদের সৃষ্টি হওয়া ব্যবধানটিকে ঘুচিয়ে ফেলা। বিশেষত চীনকে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেয়া হবে বড়সড় বোকামি।
চীনের সাংহাইয়ের একটি গবেষণাগার ইতোমধ্যেই নিজেদের শিবিরে ভিড়িয়ে ফেলেছে জার্মানির শীর্ষস্থানীয় একজন গবেষক ও তার গবেষণাগারকে। তিনি ও তার সহকর্মীরা মিলে মস্তিষ্কের ভেতর প্রবেশ ও মস্তিষ্ককে ম্যানিপুলেট করার ক্ষেত্রে দ্রুতবেগে এগিয়ে চলেছেন। এই গতি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে চীনই হবে মানব মস্তিষ্ককে পুরোপুরি বুঝতে পারা প্রথম সফল দেশ।
চীনের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্বের কথা তো সর্বজনবিদিত। তাই মস্তিষ্কের মতো একটি স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের জ্ঞানের জন্য আমেরিকা ও ইউরোপ নির্ভর করবে চীনের ওপর, তা মোটেই ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না।
অবশ্য মানব মস্তিষ্ক সম্পর্কে যাবতীয় জ্ঞানও যে মানবজাতির জন্য কেবল সুফলই বয়ে আনবে, তাও কিন্তু নয়। চীনের যে সামরিক নীতিমালা, তাতে এ কথা বলাই বাহুল্য যে একবার মানব মস্তিষ্ক সংক্রান্ত অগাধ জ্ঞানের নাগাল পেলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি নিউরো-ওয়েপন নির্মাণের ব্যাপারেও পিছপা হবে না। তবে উদারনৈতিক চিন্তাধারার মানুষদের অন্তত জানা দরকার যে মানব মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণায় আসলে কী ঘটছে, কীভাবে এসব গবেষণায় এগোনো হচ্ছে, এবং ভবিষ্যতেই বা কী অপেক্ষা করছে।
এদিকে চীনা ও জাপানি গবেষণাগারগুলো যদি বিভিন্ন স্নায়বিক রোগ যেমন আলঝেইমারের সফল চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ফেলে, তবে পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষে অসম্ভব হবে চীন ও জাপানের কাছ থেকে সেগুলো কিনে নিজেদের জনগণকে সুরক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
এখানে আবার নীতি-নৈতিকতার এক ভিন্নধর্মী প্রশ্নেরও উদয় হয়। যদি ব্যাপারটি এমন হয় যে বানরের মস্তিষ্ক নিয়ে ‘নোংরা’ কাজগুলো অনৈতিক বলে পশ্চিমারা নিজেরা সেই কাজে না জড়িয়ে অন্যদের সফলতার আশায় বসে থাকে, এবং পরবর্তী নিজেরাও সেই ‘নোংরা’ কাজের সুফল ভোগ করে, তবে তাদের এমন দৃষ্টিভঙ্গিকেও কি খুব একটা নৈতিক বলে অভিহিত করা যাবে?
সম্ভবত না। বরং এটিই হবে হিপোক্রেসি। আর তাই তো বিশেষজ্ঞরা এই মত প্রদান করছেন যে, পশ্চিমা দেশগুলোর উচিত নিজেদেরই মানব মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করা, এবং সেক্ষেত্রে ঠিক ততটুকুই ঝুঁকি গ্রহণ করা বা বানরের প্রতি ‘অমানবিক’ হওয়া, যতটুকু না হয়ে উপায় নেই। আর এর মাধ্যমে, যদি কোনো ক্ষতি হয়, সেই দায়ভারও পশ্চিমা দেশগুলোকে নিজেদের কাঁধেই তুলে নিতে হবে।
এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো- জনগণের সামনে নিজেদের কাজকে যুক্তিসঙ্গত হিসেবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে স্নায়ুবিজ্ঞানীদের আরো বেশি সাহসিকতার পরিচয় দিতে হবে। পশ্চিমা সরকারগুলোরও সেই সক্ষমতা থাকতে হবে যেন তারা বৈধ গবেষণাগুলোকে যেকোনো বিতর্ক, বিক্ষোভ বা আন্দোলনের হাত থেকে সুরক্ষা প্রদান করতে পারে।
তাছাড়া মানব মস্তিষ্ককে বোঝার নিমিত্তে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষাই যে এক বানর বেচারার উপরই চালাতে হবে, তা-ও তো নয়। কম্পিউটার সিমুলেশন ব্যবহার করে, কিংবা অন্য কোনো লভ্য উপায়ে বানরের মস্তিষ্ক ব্যবহার এড়ানো যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত মানব মস্তিষ্ককে এত কমই জানা ও বোঝা গেছে যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবন্ত প্রাণীর মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ না করে উপায় নেই।
স্নায়ুবিজ্ঞানে বানরের মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করার একটি কট্টরপন্থী বিকল্প হতে পারে কেবল সেইসব মানুষের মস্তিষ্কের উপরই নির্ভর করা, যেসব মানুষেরা স্বেচ্ছায় তাদের মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করার অনুমতি দেবে। এবং সেক্ষেত্রেও নিশ্চিতভাবেই কিছু মানুষকে পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যেই যে অনেক মানুষ জৈবচিকিৎসার গবেষণায়ও স্বেচ্ছায় নাম লিখিয়েছে, এবং সেজন্য নন-ইনভেসিভ ব্রেইন-স্ক্যানিং হার্ডওয়্যার পরিধানেও সম্মত হয়েছে।
পরিশেষে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, মানুষের মাথার খুলির ভেতর, স্নায়ুর ঠিক পাশে, সেন্সর স্থাপন করা সবসময়ই অত্যন্ত দুরূহ একটি ব্যাপার।
যদিও এক্ষেত্রে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি প্রতিনিয়ত আকারে ছোট ও কম ঝুঁকির হয়ে উঠছে। একদিন হয়তো তারা স্থাপনযোগ্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের পরিবর্তে ইনজেকশনযোগ্য, সংযোজক সিলিকন ডাস্টে পরিণত হবে। যদি তাই হয়, সেক্ষেত্রে মানব স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করা হয়ে উঠবে তুলনামূলক কম চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। তাই সেই পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য, আপাতত এ সময়টায় মানুষকে বানরের উপরই ভরসা করতে হচ্ছে।