জুলাই ১০, ১৮৫৬
মধ্যরাত। ক্রোয়েশিয়ার এক প্রান্তিক গ্রাম স্মিয়ানের এক ছোট্ট বাড়িতে প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে ডিউকা। চিন্তিতভাবে পায়চারি করছে তার খ্রিস্টান পুরোহিত স্বামী মিলাটিন। ওদিকে বাইরে তখন চলছে তুমুল ঝড়। থেকে থেকে মেঘে ঢাকা কালো আকাশের বুক চিরে দিয়ে যাচ্ছে বজ্রপাত। প্রসব কাজ সবে শেষ হয়েছে। বৃদ্ধা ধাত্রী বজ্রপাতের ঝলকানিতে ভয় পেয়ে গেল। শিশুটির জন্মে সে একে অশুভ সংকেত হিসেবে ধরে নিলেও, তা মানতে রাজি হননি ডিউকা। বরং পরম ভালোবাসায় বললেন,
“আমার এ সন্তান ছড়িয়ে দেবে আলো!”
বর্তমান বিশ্বের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাপনার অন্যতম এক বিস্ময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাওয়ার গ্রিড। প্রায় একশো বছরে গড়ে ওঠা এই জটিল বৈদ্যুতিক নেটওয়ার্কে যুক্ত অসংখ্য পাওয়ার প্ল্যান্ট ও ট্রান্সফর্মার ছড়িয়ে আছে প্রায় ৪৫০ হাজার মাইল এলাকা জুড়ে। আর এমন সুদীর্ঘ অঞ্চলকে এ অভাবনীয় সংযোগে যুক্ত করে দুনিয়ার বুকে আলো ছড়িয়ে দেয়া মানুষটির নাম নিকোলা টেসলা।
নিকোলা টেসলার সমৃদ্ধ কর্মজীবনের শুরুটা হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। খুব কষ্টে পয়সা জমিয়ে চেপে বসা জাহাজটা যখন ভিড়লো আমেরিকায়, টেসলার সম্বল ছিল কিছু পুরনো জামা আর পকেটের চার সেন্ট। জীবিকার খোঁজে আমেরিকায় এসে চাকরি পেয়ে যান বিখ্যাত বিজ্ঞানী থমাস আলভা এডিসনের কাছে।
২৮ বছরের তাগড়া জোয়ান টেসলা যখন আমেরিকায় পা রাখলেন, সেখানে তখন চলছে শিল্পসমৃদ্ধির স্বর্ণযুগ। কিন্তু, সূর্য ডোবার সাথে সাথেই থেমে যেত সমৃদ্ধির এ চাকা। অন্ধকারে ডুবে যেত গোটা আমেরিকা। ঘরে ঘরে জ্বলে উঠত মোমবাতি আর লণ্ঠনের মৃদু আলো। থমাস আলভা এডিসন তখন প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে বৈদ্যুতিক বাল্ব উৎপাদন শুরু করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে শুধু বৈদ্যুতিক বাল্ব পৌঁছে দিলেই তো হবে না, পৌঁছে দিতে হবে বিদ্যুৎ সংযোগও।
এডিসন তার ডিসি পাওয়ার (ডিরেক্ট কারেন্ট) ব্যবহার করার চেষ্টা করলেও ত্রুটিপূর্ণ সেই পদ্ধতিতে এত বিশাল অঞ্চল জুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না। আর তাই, এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্বটা তিনি তুলে দেন তরুণ ইঞ্জিনিয়ার নিকোলা টেসলার হাতে। বলেন,
“যদি সত্যিই এর সমাধান করতে পারো, তোমার জন্য থাকছে ৫০ হাজার ডলার বোনাস।”
আপাতদৃষ্টিতে যখন মনে হচ্ছিল কাজটা কারো পক্ষেই আর সম্ভব না, কয়েক মাসে অক্লান্ত পরিশ্রমে টেসলা করে ফেললেন এর সমাধান। এডিসনকে এসে মনে করিয়ে দিলেন সেই বোনাসের কথা। জবাবে এডিসন বললেন,
“তুমি হয়তো আমেরিকান সেন্স অফ হিউমার এখনো বুঝে উঠতে পারোনি। ঐ ৫০ হাজার ডলার তো ছিল রসিকতা!”
নানা রকম অসন্তুষ্টি নিয়ে, মাস কয়েক বাদেই চাকরি ছেড়ে, একা কাজ করা শুরু করলেন টেসলা। ডিসি পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশনের ত্রুটি দূর করতে গিয়েই তৈরি করে বসলেন এসি পাওয়ার (অল্টারনেটিং কারেন্ট)। পাল্টে গেল দুনিয়ার বুকে বিদ্যুৎ সরবরাহের চিত্র। পরবর্তীতে এডিসন টেসলাকে ফিরে পাবার অনেক চেষ্টা করেছেন, না পেয়ে তাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন, তার নামে করেছেন অপপ্রচার। কিন্তু পাহাড়ি ঝর্ণার মতো টেসলা এগিয়ে গেছেন আপন গতিতে।
অসম্ভব মেধাবী ও পরিশ্রমী ছিলেন টেসলা। মুখে মুখে ক্যালকুলাস করতে পারা এই মানুষটির ছিল ফটোগ্রাফিক মেমরি। কলেজ ড্রপ-আউট হলেও, কাজের প্রতি তার কখনোই ছিল না ক্লান্তি। ৮টি ভাষায় পারদর্শী সার্বিয়ান বংশোদ্ভূত এ বিজ্ঞানী ছিলেন একইসাথে পদার্থবিদ, উদ্ভাবক, তড়িৎ প্রকৌশলী, যন্ত্র প্রকৌশলী এবং ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। তিনি আধুনিক পরিবর্তী তড়িৎ প্রবাহ ও তারবিহীন তড়িৎ পরিবহন ব্যবস্থার আবিষ্কারের জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তার নামে রয়েছে তিন শতাধিক অফিসিয়াল পেটেন্ট। আমাদের মাথার ওপর ঘোরা ফ্যান থেকে শুরু করে ঘর আলো করে রাখা ফ্লুরোসেন্ট লাইট (যা কি না টিউব লাইট হিসেবে পরিচিত), টেসলার অবদান মিশে আছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন তথা তারবিহীন শক্তি সঞ্চালনা ছিল টেসলার বিশেষ আগ্রহের জায়গা। রেডিও উদ্ভাবনের জন্য ১৯০৯ সালে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গুলিয়েলমো মার্কনি যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেও, তার আগেই রেডিও উদ্ভাবন করেছিলেন টেসলা। ১৮৯৫ সালে এক পরীক্ষা চলাকালে দুর্ঘটনায় তার ল্যাবরেটরি ও সেই ল্যাবে থাকা তার রেডিও বিষয়ক গবেষণাপত্রগুলো আগুনে পুড়ে যায়। সুদীর্ঘ ৬৪ বছর পর, ১৯৪৩ সালে ইউএস সুপ্রিম কোর্ট মার্কনির রেডিও পেটেন্টকে অকার্যকর ঘোষণা করার পাশাপাশি নিকোলা টেসলাকে রেডিওর প্রকৃত উদ্ভাবক হিসেবে ঘোষণা করে।
জীবনের জটিলতাকে সহজ চোখে দেখে সহজ করার প্রয়াস ছিল টেসলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরও সহজ ও পরিবেশবান্ধব করার চেষ্টা থেকেই একসময় টেসলার নজরে আসে কানাডা অন্টারিওতে অবস্থিত নায়াগ্রা ফলস। প্রাকৃতিক এ জলপ্রপাত থেকে প্রতি সেকেন্ডে ১৫০ হাজার গ্যালন পানি নেমে আসে। আর এর শক্তিকে ও টেসলার ট্রান্সফর্মার কাজে লাগিয়েই শুরু হয় উচ্চশক্তি উৎপাদনশীল হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন। এ অনন্য উদ্ভাবনের সম্মাননা ও স্বীকৃতির স্মারক হিসেবে নায়াগ্রা ফলসের পাশে টেসলার একটি ভাস্কর্যও রয়েছে।
নিকোলা টেসলাকে শুধু জিনিয়াস বললে কম হয়ে যাবে। যুগের চেয়ে এগিয়ে থেকে যুগান্তকারী সব আইডিয়া বের করা এবং সেগুলোকে বাস্তবে রূপ দেয়ার চেষ্টাই যেন ছিল টেসলার জীবনের সারাংশ। ২০০২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে সিআইএর একটি বেনামি ড্রোন চালনার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো বিশ্ববাসী পরিচিত হয় চালকবিহীন এ যানের সাথে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বহুকাল আগেই টেসলা তৈরি করেছিলেন ড্রোন প্রোটোটাইপের ডিজাইন। এছাড়াও তার অবিশ্বাস্য গবেষণাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ডেথ রে বা পার্টিকেল বিম ওয়েপন। ছিল “ইলেক্ট্রো-স্ট্যাটিক এনার্জি ওয়াল”, যা ব্যবহার করে একটি দেশকে যেকোনো বহিরাগত আক্রমণ থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
যে আলোক-দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে অমানিশার বিস্তীর্ণ ললাটে, তার ওপর থেকে কি আর সরানো যায় নজর? একদমই না। আর তাই, প্রায় ৬০টি বসন্ত আমেরিকায় কাটিয়ে দিলেও, তার জীবন কিন্তু সেখানে মোটেই সহজ ছিল না। ধারণা করা হয়, টাইম ট্রাভেল করা যায় এমন যন্ত্র তথা টাইম মেশিন থেকে শুরু করে ডিস্ক শেপের এয়ারক্রাফট (ফ্লাইং সসার) সহ বিভিন্ন অদ্ভুত সব গবেষণা করেছেন তিনি। ডিস্ক শেপের এয়ারক্রাফটের জন্য তিনি পেটেন্ট অ্যাপ্লিকেশনও করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন অজুহাতে তার অনুমোদন দেয়া হয়নি।
এসব সিক্রেট রিসার্চে তিনি এতটাই অগ্রগামী ছিলেন যে, একের পর এক অভাবনীয় উদ্ভাবন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়া টেসলাকে সবসময়ই থাকতে হয়েছে আমেরিকান ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশনগুলোর রাডারে। তার অসামান্য মেধা, জ্ঞান ও উদ্ভাবন-ক্ষমতা হয়তো তিনি আমেরিকার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেন, এ আশঙ্কায় কড়া নজরদারিতে রাখা হতো তাকে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পক্ষে কাজ করার মতো সন্দেহমূলক অভিযোগও প্রকাশ করেছিল বেশ কিছু সংস্থা।
আর তাই, নিজ হোটেল কক্ষে যে রাতে তার মৃত্যু হলো, ইতিহাসের পাতায় যুক্ত হলো আরও নতুন কিছু রহস্য।
নামী-দামী বিলাসবহুল হোটেলে থাকতে পছন্দ করতেন টেসলা। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি নিজের সব ডকুমেন্টও সবসময় সাথে সাথেই রাখতেন। তখনও চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ইতিমধ্যেই টেসলা দাবী করেছিলেন “ডেথ রে” নামক এক অতিশক্তিশালী পার্টিকেল বিম ওয়েপনের কথা, যা চলমান যুদ্ধে রাখতে পারে বড় রকমের ভূমিকা। আর সেজন্যই ১৯৪৩ সালের ৭ই জানুয়ারি, টেসলার মৃত্যুর খবর শোনার সাথে সাথে এসব টেকনোলজি আমেরিকার শত্রুপক্ষের হাতে পড়ার সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে, নিউ ইয়র্কের সেই হোটেল রুমটি সিল করে এফবিআই। ভেতরে টেসলার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের সাথে ছিল অসংখ্য নথিপত্র। কিন্তু যে মানুষটি বদলে দিয়েছে সভ্যতার গতিপথ, তার গবেষণাকর্ম সাদা চোখে বোঝা কি আর এতই সহজ? ৮৬ বছর বয়সী মহান এ বিজ্ঞানীর সব নথিপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষার দায়িত্বটা তাই এফবিআই তখন তুলে দেয় জন জি. ট্রাম্পের হাতে।
কে এই জন ট্রাম্প?
জন জর্জ ট্রাম্প ছিলেন ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি) এর একজন অধ্যাপক। ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আর হ্যাঁ, এই জন ট্রাম্পই ছিলেন আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আপন চাচা।
ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে প্রকাশিত এক মেমোরিয়াল ট্রিবিউট থেকে জানা যায়, প্রফেসর রবার্ট জে ভন ডি গ্রাফের অধীনে কাজ করার উদ্দেশ্যে জন ট্রাম্প এমআইটি-তে যোগ দেন। প্রফেসর রবার্টকে বলা হতো “সুপার হাই ভোল্টেজ জেনারেশন ও অ্যাপ্লিকেশনের নতুন খাত” এর অগ্রদূত। তার অধীনে ১৯৩৩ সালে ডক্টরেট সম্পন্ন করার পর ১৯৩৬ সালে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে এবং পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে পরিপূর্ণ অধ্যাপক হিসেবে এমআইটিতে যোগদান করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এমআইটির রেডিয়েশন ল্যাবে ফিল্ড সার্ভিসেস ডিরেক্টর হিসেবে মাইক্রোওয়েভ রাডার নিয়ে কাজ করার পর রেডিয়েশন ল্যাবের ব্রিটিশ ব্রাঞ্চে তার পোস্টিং হয়। সেখানে তিনি সরাসরি জেনারেল ডুইট ডি. আইজেনআওয়ারের সাথে কাজ করার সুযোগ পান।
হাই ভোল্টেজ ও রেডিয়েশন নিয়ে কাজ করার দক্ষতা থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের কাছে ট্রাম্পের বিশেষ কদর ছিল। এছাড়াও বিভিন্ন গোপন সরকারী প্রোগ্রামে কাজ করার ব্যাপারেও ছিল তার বিশেষ সুনাম। ১৯৪৩ সালের ১৩ই জানুয়ারি, নিকোলা টেসলার মৃত্যুর পর তার ব্যক্তিগত কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার গুরুদায়িত্বটাও তাই বিশেষভাবে তাকেই দিয়েছিল এফবিআইয়ের অফিস অফ এলিয়েন প্রোপার্টি কাস্টোরিয়ান।
নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষার পর শেষ পর্যন্ত জন তার রিপোর্ট জমা দেন। নিত্য নতুন অবিশ্বাস্য গবেষণা, আবিষ্কার ও উদ্ভাবনে বিশ্ববাসীকে চমকে দেয়া মানুষটির গোপন সব নথিপত্রে কী লুকনো আছে, তা নিয়ে কারোরই উৎকণ্ঠার কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু, প্রায় ৬ সপ্তাহের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জন তার রিপোর্টে টেসলার রেখে যাওয়া কাগজপত্রকে কাল্পনিক, দার্শনিক ও প্রচারণামূলক বলে আখ্যায়িত করেন। পাশাপাশি, সেসব কাগজে নতুন কোনো তত্ত্ব কিংবা পদ্ধতির উল্লেখ নেই বলেও এফবিআইকে জানান।
ড. ট্রাম্পের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এফবিআই তখন টেসলার পার্টিকেল ওয়েপন বিম (ডেথ রে) এর অস্তিত্বকে গুজব ও কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু তা মেনে নেয়নি অনেকেই। টেসলার জীবনী ‘উইজার্ড: দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অফ নিকোলা টেসলা’র লেখক মার্ক সাইফার বলেন,
“ইউএস মিলিটারির ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এল.সি.ক্রেইগসহ অনেকেই এ ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করতেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস পার্টিকেল বিম ওয়েপনের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে।”
এছাড়াও রয়েছে ওয়্যারলেস ইলেক্ট্রিসিটি ট্রান্সমিশন সিস্টেম। ভেবে দেখুন তো, এখনকার সময়ে কোনো তারের সংযোগ ছাড়াই আমরা যেভাবে ফোন/ ট্যাব/ ল্যাপটপে ওয়্যারলেস ইন্টারনেট (যেমন: ওয়াইফাই) চালাচ্ছি, তেমনি যদি তার ছাড়াই দেয়া যেত বিদ্যুৎ সংযোগ? এত বছর আগে এসব প্রযুক্তির গবেষণা ও উদ্ভাবন করে সময়ের চেয়েও এগিয়ে ছিলেন টেসলা।
টেসলার ফাইলগুলোর পরিণতি ঠিক কী হয়েছিল আর ফাইলগুলোতেই বা কী ছিল, সবই এখন পর্যন্ত রহস্য হয়ে আছে। এসব নিয়ে কন্সপিরেসি থিওরিরও কোনো কমতি নেই। ২০১৬ সালে ‘ফ্রিডম অফ ইনফরমেশন অ্যাক্ট’ এর অধীনে টেসলার ফাইল সম্পর্কিত ২৫০ পাতার নথিপত্র প্রকাশ করে এফবিআই। পরবর্তীতে মার্চ ২০১৮তে আরও দুটি সংস্করণ প্রকাশ করে সংস্থাটি। কিন্তু তবু, অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর আজও আজও মেলেনি।
পাশাপাশি হারানো ফাইলের প্রশ্ন তো আছেই। টেসলার বেশ কিছু ফাইলের হদিশ এখনও পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপক্ষ টেসলার আপন ভাতিজা সাভা কোসানোভিচের সাথে যোগাযোগ করে। তিনি ছিলেন আমেরিকায় কর্মরত তৎকালীন ইয়োগোস্লাভ অ্যাম্বাসেডর। কোসানোভিচ হয়তো টেসলার টেকনোলজি শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দিতে পারেন, এই আশঙ্কা থেকে তাকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়।
১৯৫২ সালে, ইউএস কোর্ট কোসানোভিচকে তার চাচার সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করলে টেসলার ফাইল এবং অন্যান্য জিনিসপত্র সার্বিয়ার বেলগ্রেডে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে বেলগ্রেডে নির্মিত নিকোলা টেসলা মিউজিয়ামেই রয়েছে সেসব।
কিন্তু, এফবিআইয়ের রেকর্ড অনুযায়ী, টেসলার ডকুমেন্ট বোঝাই ৮০টি ট্রাঙ্ক থাকলেও, বেলগ্রেডে পাঠানো হয়েছিল ৬০টি ট্রাঙ্ক। লক্ষণীয় এ অসংগতির ব্যাপারে এফবিআইয়ের পক্ষ থেকে কোনো রকম বিবৃতি দেয়া হয়নি।
সত্যিই কি টেসলার টেকনোলজি আত্মসাৎ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ?
ড. ট্রাম্পের রিপোর্ট প্রকাশিত হবার পর, সরকারের পক্ষ থেকে পার্টিকেল ওয়েপন বিমের অস্তিত্ব বারবার উড়িয়ে দেয়া হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কয়েক দশকে আমেরিকার সেনাবাহিনী বারবার পার্টিকেল ওয়েপন বিম নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছে। এ ব্যাপারে মার্ক সাইফার বলেন,
“১৯৮৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান ঘোষিত স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভেও ছিল ডেথ রে এর প্রভাব। টেসলার এসব অপ্রকাশিত টেকনোলজি গোপনে সরকারের ব্যবহারই হতে পারে ফাইলগুলো হারানোর সবচেয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা।”
ওদিকে টেসলার ডকুমেন্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেই জন ট্রাম্পের ক্যারিয়ারে আসে বড় ধরনের পরিবর্তন।
মূলত ড. জন ট্রাম্প বরাবরই ইলেকট্রিক পাওয়ার মেশিনারি ডিজাইনে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু টেসলার মৃত্যুর পর ৬ সপ্তাহ ধরে তার ডকুমেন্ট নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে সেগুলোকে “কাল্পনিক” হিসেবে আখ্যায়িত করে এফবিআইয়ের কাছে রিপোর্ট করার পরেই পাল্টে যায় তার আগ্রহের জায়গা। ইলেকট্রিক পাওয়ার মেশিনারি ডিজাইন ছেড়ে তিনি ভ্যাকুয়ামে সুপার-হাই ভোল্টেজের ইনস্যুলেশন নিয়ে কাজ শুরু করেন।
এ প্রসঙ্গে, এমআইটির আর্কাইভ থেকে পাওয়া এক সাক্ষাৎকারে জন বলেছিলেন,
“অবিশ্বাস্য সব আইডিয়া ছিল তার (নিকোলা টেসলা)। বেশ কিছু আইডিয়া আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও দেখেছি। ছয় সপ্তাহ ধরে পরীক্ষা শেষে বেশ কিছু আইডিয়া আমার যৌক্তিক ও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। আর তাই আমি ইলেকট্রিক পাওয়ার মেশিনারি ডিজাইন বাদ দেই। Insulation of High Voltages in Vaccum ও Acceleration of Heavy Particles To High Energies নিয়ে গবেষণা শুরু করি।”
পার্টিকেল এক্সেলারেশন কী?
২০১০ সালে ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য ডেইলি মেইলের জন্য পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং তার লেখা একটি আর্টিকেলে ব্যাখ্যা করেন কীভাবে পার্টিকেল এক্সেলারেশনের মাধ্যমে টাইম ট্রাভেল করা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন মানুষকে পাঠানোর মতো যথেষ্ট বড় একটি পার্টিকেল এক্সিলারেটর। আর টেসলার ডকুমেন্টস পরীক্ষা করার পর এই পার্টিকেল এক্সিলারেশন নিয়েই আগ্রহী হয়ে পড়েন জন ট্রাম্প।
মেমোরিয়াল ট্রিবিউট থেকে আরও জানা যায়, সে সময় জন ট্রাম্পের আগ্রহের দুটি জায়গা ছিল ‘Insulation of High Voltages in Vaccum’ এবং ‘Biological Application of High Voltage Radiation’।
১৯৩৭ সালে আমেরিকান পদার্থবিদ রবার্ট ভ্যান ডি গ্রাফের সাথে কাজ করে জন তৈরি করেন মিলিয়ন ভোল্ট এক্স-রে জেনারেটর। ‘হাই ভোল্টেজ ভ্যান ডি গ্রাফ জেনারেটর’ এর ডিজাইন ও নির্মাণের জন্য যিনি বিখ্যাত। এছাড়াও ‘ভ্যান ডি গ্রাফ পার্টিকেল এক্সিলারেটর’ ছিল তার অনন্য উদ্ভাবন।
টেসলার মৃত্যুর তিন বছর পর, ১৯৪৬ সালে ভ্যান ডি গ্রাফ ও ব্রিটিশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ডেনিস রবিনসনকে নিয়ে ‘High Voltage Engineering Corporation’ গড়ে তোলেন ড. ট্রাম্প।
কিন্তু, শুধুমাত্র জন ট্রাম্পেই থেমে থাকেনি টেসলা টেকনোলজির অগ্রযাত্রা। ধারণা করা হয়, জনের মাধ্যমে ট্রাম্প পরিবারের হাতে পড়া টেসলা টেকনোলজি জানার ও শেখার সৌভাগ্য হয়েছিল খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও। নিজের মেধা ও চাচার প্রশংসায় তিনি বরাবরই পঞ্চমুখ। নিজ মেধার প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমার আঙ্কেল ছিলেন এমআইটির গ্রেট একজন প্রফেসর। যত দূর মনে পড়ে, প্রায় চার দশক সেখানে কাজ করেছেন তিনি। আর তার সাথে আমার সবসময়ই নিউক্লিয়ার নিয়ে কথা হতো।”
এছাড়াও চাচার চেয়ে তিনিও যে মেধায় কোনো অংশে থেকে কম না, বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ার সামনে তা তা তুলে ধরার চেষ্টাও করেছেন তিনি। ট্রাম্প বলেন,
“আমার একজন আঙ্কেল ছিলেন। আর আমি রেস-হর্স থিউরিতে বিশ্বাস করি। কারণ দুর্বল ঘোড়া থেকে তো আর কখনো তেজী ঘোড়া আসে না।”
তিনি আরও বলেন,
“আমি আসলেই নিউক্লিয়ার বুঝি। বিশ্বাস না হলে এমআইটির ড. জন ট্রাম্পের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখুন। বহু বছর তিনি এমআইটিতে কাজ করেছেন। নিউক্লিয়ার নিয়েই তার সাথে কথা হতো আমার।”
ইনগার্সলের ভবিষ্যতবাণী!
কল্পকথার কল্পধারায় পাঠকমনের কল্পনার সীমানা ছাড়িয়ে যায় গগনস্পর্শী ভাবনার অন্তরালে। তাই এবার চলুন জেনে আসা যাক ভিন্ন এক অধ্যায়। ট্রাম্প পরিবারের সাথে টেসলার রয়েছে অদ্ভুত সংযোগ নিয়ে মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি ছিল না কখনোই। পার্টিকেল এক্সেলারেটরের কারণে টাইম ট্রাভেল বিষয়ক টেসলার গবেষণার ব্যাপারটা নিয়ে তো আলোচনা ছিল সবসময়ই। কিন্তু, সম্প্রতি কল্পনার আকাশে বিস্ময় যেন আবারও মেলেছে ডানা। ১২৭ বছরের পুরনো এক বই নতুন করে তুলেছে আলোড়ন।
বইটির নাম “1900 Or, The Last President”! ১৮৯৬ সালে, আমেরিকান লেখক ইনগার্সল লকউডের লেখা বইটিতে, গল্পের শুরুই হয়, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট ইলেকশন দিয়ে। ইলেকশনে সবাই ট্রাম্পের জয় অসম্ভব ধরে নিলেও শেষ পর্যন্ত জয়ী হন ট্রাম্প। বইয়ে উল্লেখিত ট্রাম্পের হোটেলটি অবস্থিত ছিল ফিফথ এভিনিউতে। এছাড়াও, তার প্রশাসনে সেক্রেটারি এগ্রিকালচার পদে ছিলেন “লেফ পেন্স” নামের এক ব্যক্তি।
তথ্যগুলো পরিচিত লাগছে?
ইনগার্সলের গল্পের সাথে এবার একটু আমাদের বাস্তবতা মিলিয়ে দেখা যাক। গল্পের ট্রাম্পের মতনই ২০১৬ সালে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে অংশ নিলেন, কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে এই খ্যাপাটে মানুষটি ইলেকশনে জিততে পারবে।
অথচ সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে, ঠিকই শেষপর্যন্ত ইলেকশন জিতে ট্রাম্প হয়ে গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট। তার ট্রাম্প টাওয়ার কোথায় অবস্থিত জানেন? ফিফথ এভিনিউ! ইনগার্সলের গল্পে ট্রাম্প হোটেলটিও কিন্তু ছিল ঠিক এখানেই। আরও অবাক করা ব্যাপার হলো, গল্পের লেফ পেন্সের মতোই একজন বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনে আছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট, মাইক পেন্স।
২০০৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘর আলো করে জন্ম নেয়া তৃতীয় পুত্র সন্তানের নাম রাখা হয়েছিল ব্যারন ট্রাম্প! আর ২০১৬ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ায় “1900 Or, The Last President” এর সাথে অবিশ্বাস্য মিল খুঁজে পাবার পরেই মূলত ব্যারন ট্রাম্পের দিকে নজর পড়ে বিশ্ববাসীর! কারণ ইনগার্সলের লেখা আরও কিছু বইয়ের একটি প্রধান চরিত্র অবিশ্বাস্য ভাবে মিলে যায় এই ব্যারন ট্রাম্পের সাথে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প-পুত্র ব্যারনের জন্মেরও বহু বছর পূর্বে, ১৮৯৩ সালে ইনগার্সল “Baron Trump’s Marvelous Underground” নামের একটি শিশুতোষ উপন্যাস লেখেন, যা বর্তমানে হয়ে উঠেছে ভবিষ্যতবাণীর চরম নিদর্শন।
বইটির মূল কাহিনী গড়ে উঠেছে ব্যারন ট্রাম্প নামের এক ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে। যে সবসময় তার গুরু “ডন” এর নির্দেশনা মেনে চলতো। ডনের ম্যানুস্ক্রিপ্ট অনুযায়ী, ব্যারন ট্রাম্প উত্তর রাশিয়ার একটি অঞ্চল থেকে খুঁজে পায় টাইম ট্রাভেল পোর্টাল, যাকে বইয়ে “world within a world” বলে উল্লেখ করা হয়েছে!
ধারণা করা হয় অঞ্চলটি আপার ইউরালের ওয়েস্টার্ন স্লোপ। রাশিয়ার এ অঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য পাহাড়-পর্বত এবং অনাবিষ্কৃত গুহা ও সুরঙ্গ। কিন্তু রাশিয়ার এমন দুর্গম অঞ্চলে কাজ করা একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের পক্ষে কি আসলেই সম্ভব?
বাস্তবে আমেরিকা রাশিয়া সম্পর্কে প্রায় সবসময়ই টানটান উত্তেজনা বিরাজ করলেও, ২০১৬ সালের আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের কথা কম-বেশি প্রায় সকলেরই জানা। আর তাই ট্রাম্পের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক থাকা কিন্তু মোটেই অসম্ভব না।
ইনগার্সলের গল্পের সবকিছুই ছিল সময়ের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে।
এ বইয়ের ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী, ট্রাম্পই সম্ভবত হতে চলেছেন আমেরিকার শেষ প্রেসিডেন্ট। দ্য লাস্ট প্রেসিডেন্ট বইয়ে বলা হয়, ট্রাম্প জয়ী হবার পর দেশব্যাপী চরম বিদ্রোহের মুখে পড়লেও একটা পর্যায়ে দেশকে ঋণমুক্ত করে ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক মন্দা দূর করবেন।
ভবিষ্যৎবাণী মিলে যেতেই পারে কিংবা হতে পারে কাকতাল! কিন্তু ইনগার্সলের লেখা বইগুলোতে উঠে আসা এসব “তথ্য” কি আদৌ কাকতাল ছিল? নাকি সত্যিই কোনো টাইম ট্রাভেলারের দেখা পেয়েছিলেন ইনগার্সল। হতে পারে সেই টাইম ট্রাভেলারটি ছিল আমাদের চিরচেনা এই ডোনাল্ড ট্রাম্প-পুত্র!
শুধু ব্যারন ট্রাম্পকে নিয়েই চার চারটি বই লিখেছিলেন ইনগার্সল। সত্যিই কি অতীত ভ্রমণ করে এসেছে ব্যারন ট্রাম্প? আর অতীত ভ্রমণের কোনো একপর্যায়ে সে মুখোমুখি হয়েছিল ইনগার্সলের?
১৮৪১ সালে নিউ ইয়র্কে জন্মগ্রহণ করা ইনগার্সল লকউড পেশায় আইনজীবী হলেও ক্যারিয়ারের শুরুটা তার হয়েছিল ডিপ্লোম্যাট হিসেবে। ১৯৬২ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তাকে কিংডম অফ হ্যানওভারের কনসালে নিযুক্ত করেন।
চার বছর পর নিউ ইয়র্কে ফিরে বড় ভাই হেনরির সাথে লিগ্যাল প্র্যাকটিস শুরু করেন ইনগার্সল। ১৮৮০ সালে তিনি প্রভাষক এবং অধ্যাপক হিসেবে নতুন ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন। শিশুতোষ উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন বেশ কিছু নন-ফিকশন। আরউইন লংম্যান ছদ্মনামেও লিখতেন তিনি।
মূলত ২০১৬ সালের আমেরিকান প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে অবিশ্বাস্যভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতে গেলে, পরের বছর জুলাইতে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে “1900 Or The Last President” বইটির কিছু স্থিরচিত্র। আর তারপরই প্রথমবারের মতো রাতারাতি বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন এই রহস্যময় লেখক। অনুসন্ধিৎসু মানুষজনের প্রচেষ্টায় একের পর এক চমকে বিস্ময়ের ঘোর কাটার সুযোগ পাবার আগেই দুনিয়াবাসী খুঁজে পেল ইনগার্সল লকউডের আরও কিছু প্রকাশনা। বইগুলোর দেয়া তথ্য কিংবা ভবিষ্যতবাণী নিয়ে চিন্তা করলে টাইম ট্রাভেলের মাধ্যমে কোনো অতীত ভ্রমণকারীর সাথে ইনগার্সলের দেখা হওয়াকেই সবচেয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা মনে হয়!
কিন্তু সত্যিই যদি ব্যারন ট্রাম্প টাইম ট্রাভেল করেও থাকে, সেই প্রযুক্তি সে কোথায় পেল? ইনগার্সলের বইতে, ব্যারন টাইম ট্রাভেল করতে পেরেছিল তার ডন নামক কোনো ব্যক্তির ম্যানুস্ক্রিপ্ট অনুসরণ করে। আর আমরা ইতিমধ্যেই জানি যে, তার পার্টিকেল এক্সেলারেটর নিয়ে কাজ করা আংকেল জনের কাছ থেকে নিকোলা টেসলার ম্যানুস্ক্রিপ্ট পাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে খুবই সম্ভব।
২০১৬ সালে ১৯ জুলাই, নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় সাউথ ক্যারোলিনার এক অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, “নিউক্লিয়ার যে কতটা শক্তিশালী তা আমার আঙ্কেল বহু বছর আগেই আমাকে বলেছিলেন। ৩৫ বছর আগেই তিনি আমাকে শক্তির ভবিষ্যৎ বলে দিয়েছিলেন। কে ভেবেছিল যে, সেটাই সত্যি হবে!”
সত্যিই যদি জন তাকে শক্তির ভবিষ্যৎ বলে গিয়ে থাকেন, টেসলার গবেষণালব্ধ জ্ঞান আর কী কী সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে ট্রাম্প পরিবারের সামনে তা হয়তো আমাদের কল্পনারও বাইরে। প্রেসিডেন্ট হবার পর ট্রাম্পের বলা সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো “ওয়াল” নির্মাণ করা। অবৈধ অভিবাসন, মানব পাচার, চোরাচালান বন্ধ করা সহ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা জোরদার করতেই ট্রাম্পের এমন বক্তব্য। কোনো দেশের সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করার মতো অদ্ভুতুড়ে কথাকে পাগলামো হয়তো মনে হতেই পারে। কিন্তু সত্যিই কি তা নির্মাণ সম্ভব?
জীবদ্দশায় নিকোলা টেসলা পার্টিকেল বিম ওয়েপনের পাশাপাশি বলেছিলেন “ইলেক্ট্রো-স্ট্যাটিক এনার্জি ওয়াল” এর কথা, যা ব্যবহার করে একটি দেশকে যে কোনো বহিরাগত আক্রমণ থেকেও রক্ষা করা সম্ভব। যারা মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের ব্ল্যাক প্যান্থার খ্যাত আফ্রিকার গোপন কাল্পনিক রাষ্ট্র ওয়াকান্ডার সাথে পরিচিত, তারা হয়তো এ দেয়ালের কার্যকারিতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন সহজেই। এছাড়াও, পার্টিকেল বিম ওয়েপন বা ডেথ রে দিয়ে আকাশ পথে যেকোনো ধরনের আক্রমণকেও প্রতিহত করা সম্ভব, এমনটাই বিশ্বাস করতেন টেসলা!
ড. জন ট্রাম্পের ল্যাব ডিরেক্টর জেমস মেলচার একবার বলেছিলেন,
“তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে, জনের শরণাপন্ন হয়েছে প্রায় সব ধরনের মানুষ। কারণ ও চাইলেই আয়ন আর ইলেকট্রনের মেগাভোল্ট থেকে ডেথ রে তৈরি করতে পারতো। … ভাবছেন, তা দিয়ে কী করতো? ক্যান্সার রিসার্চ করতো, ডিয়ার আইল্যান্ডে বর্জ্য পদার্থ স্টেরিলাইজ করতো, করতো অদ্ভুত সব কাজ।”
“ডেথ রে”?
শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানীর গবেষণালব্ধ জ্ঞানশিখার দ্যুতি কি আর এত সহজে যায় লুকোনো? মেলচারের বক্তব্য সত্য হলে, ডেথ রে নিয়ে কাজ করে গেছেন ড. ট্রাম্প। ব্যবহার করেছেন ক্যান্সারের নিরাময় খুঁজতে। ক্যান্সার রিসার্চ কী এবং কেন প্রয়োজন তা তো সকলেই জানেন। আর জেমস মেলচারের উল্লেখ করা এই ডিয়ার আইল্যান্ডের অবস্থান বোস্টনের ম্যাসাচুসেটসে। ১৮৫ একরের এই আইল্যান্ডের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চলজুড়েই আছে দূষিত পানি পরিশোধনাগার। শিল্প-বর্জ্য শোধনাগার হিসেবেই ডিয়ার আইল্যান্ড পরিচিত।
উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে শিল্প-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আপনি যখন এই আর্টিকেলটি পড়ছেন, আমেরিকায় তখন প্রতি টন বর্জ্য পরিশোধনে খরচ হচ্ছে ৫০.৬০ ডলার। প্রতি বছর আমেরিকাতে প্রায় ২৩০ মিলিয়ন টন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপযোগী হয়। লক্ষ লক্ষ ডলারের গবেষণা হচ্ছে, কীভাবে আরও পরিবেশবান্ধব উপায়ে এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা যায়। আর এসব গবেষণা হচ্ছে বেশ কয়েক শতক ধরেই। তেমনই রিসার্চে অংশ নিয়েছিলেন জন জি. ট্রাম্প।
টেসলার প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি শুধু ট্রাম্পের পক্ষেই এত কিছু করা সম্ভব হয়ে থাকে, তাহলে স্বয়ং টেসলার জীবদ্দশায় ডেথ রে সহ বাকি প্রকল্পগুলো সরকারী অনুমোদন পেলে দুনিয়াবাসীর সামনে বিজ্ঞানের আর কী কী বিস্ময় উন্মোচিত হতো, তা কল্পনা করার শক্তি বা সামর্থ্যটুকুও হয়তো আমাদের নেই। আবার এমনও হতে পারে যে, টেসলার গোপন নথিপত্র যদি সত্যিই চুরি হয়ে থাকে। কোনো না কোনো একসময় দুনিয়ার কোনো প্রান্তে সেসব গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে বাস্তবতায় রূপ দিয়ে কেউ এনে দেবে পূর্ণতা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হবে আরও সমৃদ্ধ!
এছাড়াও, প্রফেসর ট্রাম্প এমআইটিতে ‘ভ্যান ডি গ্রাফ জেনারেটর’ এর ওপর বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। আর এই জেনারেটরই ছিল নাৎসি বাহিনীর ডিজাইন করা ফ্লাইং সসারের অন্যতম প্রধান অংশ। ১৯৪৭ সালে রসওয়েলে ফ্লাইং সসার ক্র্যাশ হওয়া আমেরিকার একটি সুপরিচিত ঘটনা। এফবিআই প্রকাশিত নথিপত্র থেকে এ ঘটনার সাথেও প্রফেসর ট্রাম্পের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়। ফ্লাইং সসার, যা কি না ছিল টেসলার গবেষণা বস্তুগুলোর একটি।
জীবদ্দশায় টেসলার গবেষণার অন্যতম একটি ক্ষেত্র ছিল তারবিহীন কণা ও শক্তি সঞ্চালনা। আর এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই হয়তো তিনি টেসলাস্কোপ ডিজাইন করেছিলেন। টেসলাস্কোপ নামটির প্রবর্তন হয় নিকোলা টেসলার মৃত্যুর পর। এটি ছিল এক বিশেষ ম্যাগনিফাইং রিসিভার যা দিয়ে বিশেষ মাধ্যমে শক্তি সঞ্চালন করা যেত। আর ধারণা করা হয়, গোপন এ ডিভাইস তৈরি করার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে শক্তি সঞ্চালন করা কিংবা মহাজাগতিক প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করা।
অবিশ্বাস্য মেধার সেই মানুষটি বিজ্ঞানের আর কোন কোন রহস্য নিয়ে খেলা করে গেছেন সেটাই হয়তো সবচেয়ে বড় রহস্য। কারণ, আজও টাইম ট্রাভেল, মহাজাগতিক প্রাণী, পার্টিকেল ওয়েপন বিম বা ডেথ রে এ সবই আমাদের কাছে সায়েন্স ফিকশন।
কিন্তু, আসলেই কি এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই? তা সময়ই বলে দেবে। হয়তো ইনগার্সলের ভবিষ্যৎবাণী ও শতাব্দী সেরা বিজ্ঞানী টেসলার সাথে ট্রাম্প পরিবারের এসব সম্পৃক্ততা নিছক কাকতালীয় ব্যাপার। কিংবা সময়ের সাথে হয়তো একে একে মিলতে থাকবে ইনগার্সলের সকল ভবিষ্যদ্বাণী। আর ভবিষ্যৎ অবলম্বনে তার রচিত বইগুলোই হয়ে উঠবে আমাদের ভাগ্যলিপি।