নাৎসি বাহিনীর চোখ এড়িয়ে যেদিন গায়েব হলো নোবেল

এপ্রিল মাসের এক সকালবেলার কথা, সময়টা ১৯৪০ সাল। ইতোমধ্যে নাৎসি বাহিনী কোপেনহেগেনের দখল নিয়ে নিয়েছে। নাৎসিদের সম্মিলিত পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। শব্দ যত জোরালো হচ্ছে, নিলস বোর এবং জর্জ ডি হেভেসির হৃদকম্পন ততই বেড়ে চলছে। তাদের হাতে এখনও ভন লু এবং  ফ্রাঙ্কের মেডেল দুটো রয়েছে। সময় খুবই কম। এরই মধ্যে মেডেল দুটো না লুকালে নাৎসিদের হাতে ধরা পড়তে হবে। মেডেল সমেত ধরা পড়লে আর রক্ষা থাকবে না। কী ঘটতে চলছে!

এই ঘটনা পুরোপুরি জানার আগে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।

১৯৩৩ সালে নাৎসি জার্মানির অধিকর্তা হিসেবে হিটলারের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ সময় তিনি কিছু বিধ্বংসী নীতি গ্রহণ করেন, যার শিকার হয়েছিলেন ম্যাক্স ভন লু এবং জেমস ফ্রাঙ্ক। ভন লুর জন্ম জার্মানির বার্লিন শহরে। তিনি ১৯১২ সালে ক্রিস্টালের এক্স ডিফ্রাকশান করেন। এজন্য ১৯১৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে তিনি নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। জেমস ফ্রাঙ্ক জার্মানির হামবুর্গ শহরের অধিবাসী ছিলেন। ১৯২৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য তিনিও নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। 

ছবির বাঁ দিকে জেমস ফ্রাঙ্ক এবং ডানদিকে ম্যাক্স ভন লু; image source: abc.net

খেয়াল করুন, দুজনেই ছিলেন জার্মানির স্বনামধন্য বিজ্ঞানী। তা সত্ত্বেও হিটলার তাদের উপর খেপেছিলেন। তাদেরকে বন্দী করে তাদের মেডেল দুটো কেড়ে নেওয়ার জন্য নাৎসি বাহিনিকে আদেশ দেন। এর কারণ, ভন লু ছিলেন ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টির বিরোধী। তাই তাকে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। অপরদিকে জেমস ফ্রাঙ্ক ছিলেন জাতিতে ইহুদী। ফলে ইহুদী দমন তালিকায় তার নামও উঠে এসেছিল। বিশেষ করে ফ্রাঙ্কের বিপদ ছিল সবচেয়ে বেশি, তাই তাকে আমেরিকায় আশ্রয় নিতে হয়। আর যাওয়ার আগে তিনি তার মেডেলটি পাঠিয়ে দেন ডেনমার্কের আরেক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী নিলস বোরের কাছে। ম্যাক্স ভন লুও তার মেডেলটি পাঠিয়ে দেন নিলসের কাছে।

নিলস বোরও ১৯২২ সালে নোবেল পেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে। তবে তার নোবেলটি তিনি নিলামে তুলে দিয়েছিলেন ফিনল্যান্ডের মানুষের সাহায্যার্থে। যা-ই হোক, নিজেদের মেডেল দুটো নাৎসিদের কবল থেকে বাঁচানোর জন্য তারা বোরের উপর দায়িত্ব দিয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু এদিকে বোর বেশ বিপদে পড়লেন। বহু জার্মান ইহুদী বিজ্ঞানীদের আশ্রয় দিয়ে এমনিতেই হিটলারের চক্ষুশুল হয়েছেন। তার উপর সম্পূর্ণ অবৈধভাবে এই দুটি মেডেল তার কাছে ছিল। সুতরাং নাৎসি বাহিনি যে তার ল্যাবরেটরিতে হানা দেবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

নিলস বোর ;image source: pinterest.com 

কিন্তু বোর কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না, তিনি কিভাবে নোবেল পদক দুটোকে হিটলারের হাত থেকে সুরক্ষা দেবেন। সেই সময়ে বোরের গবেষণাগারে গবেষণা করতেন হাঙ্গেরির এক রসায়ানবিদ, যার নাম জর্জ ডি হেভেসি। এরই মধ্যে জ্ঞানে, পান্ডিত্যে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি। বোর যখন মেডেল দুটি নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন, তখন হেভেসি তাকে মেডেল দুটো মাটি খুঁড়ে পুঁতে ফেলার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তাতে আপত্তি জানালেন বোর। তিনি সংশয় প্রকাশ করলেন, “না, কাজটা ঠিক হবে না। কারণ, হিটলার বাহিনী এই ল্যাবের সবকিছু খতিয়ে দেখবে, এমনকি বাগানের ভিতর মাটি খুঁড়েও দেখতে পারে।

জর্জ ডি হেভেসি; image source: wikimedia commons

বোর এবং হেভেসি যখন ভাবনার কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না, ঠিক তখনই হেভেসির মাথা থেকে বেরোলো বুদ্ধি। তিনি সোনার মেডেল দুটো জলে গুলিয়ে ফেলার প্রস্তাব রাখলেন।

“আমি এগুলো দ্রবীভূত করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম। যখন আক্রমণকারী বাহিনী কোপেনহেগেনের রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিলো, তখন আমি লু এবং জেমস ফ্রাঙ্কের মেডেলগুলো দ্রবীভূত করতে ব্যস্ত ছিলাম।”

– জর্জ ডি হেভেসি

কিন্তু সোনা হচ্ছে অত্যন্ত নিম্ন সক্রিয় ধাতু। কম সক্রিয় হওয়ার কারণে প্রকৃতিতে সোনা বিশুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় এবং সচরাচর কোনো বিক্রিয়ায় অংশ না নেওয়ায় দীর্ঘকাল অপরিবর্তিত থাকে। সে কারণে চাইলেই সোনাকে যেকোনো দ্রবণে দ্রবীভূত করা সম্ভব নয়। তবে হেভেসি জানতেন, ‘অ্যাকুয়া রিজিয়া ‘ এমন এক দ্রবণ, যাতে রয়েছে শতকরা ৭৫ ভাগ হাইড্রোক্লোরিক এসিড (HCl), আর শতকরা ২৫ ভাগ নাইট্রিক এসিড। হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও নাইট্রিক এসিড হচ্ছে খুবই শক্তিশালী এসিড। এদের জলীয় দ্রবণে প্রচুর পরিমাণে H+ আয়ন থাকে, যার ফলে এরা অধিক অম্লধর্ম প্রকাশ করে থাকে। এর ফলে এই দ্রবণ সোনার মতো নিম্ন সক্রিয় ধাতুকেও গলিয়ে দ্রবণে রুপান্তর করতে সক্ষম।

তবে এতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। অতঃপর বোর এবং হেভেসি মিলে নেমে পড়লেন অ্যাকুয়া রিজিয়ায় সোনা গোলানোর কাজে। কিন্তু এ যে বড় কঠিন কাজ। একদিকে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সৈন্যরা শহরে পা ফেলেছে। অন্যদিকে অ্যাকুয়া রিজিয়ায় সোনা তো সহজে গলছে না। অনেক লম্বা সময় নিচ্ছে। শঙ্কা এতই যে, বোর আর হেভেসির হৃদপিন্ডে ছোটখাট একটা ভূমিকম্প হয়ে যাচ্ছে।

অবশেষে দুজনে সফল হলেন। মেডেল দুটো ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যেতে লাগলো। একটা সময় পরে সোনা পুরোপুরি মিশে গেল অ্যাকুয়া রিজিয়ায়। সোনার জল ঠিকই। কিন্তু বর্ণ সোনালী নয়, বরং কমলা রঙের। এবার তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। হেভেসি সোনার জল পুরে ফেললেন একটি জারে। জারটি খুব সাবধানে ল্যাবের সবচেয়ে উঁচু তাকে রেখে দিয়ে দুজন সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন।

অ্যাকুয়া রিজিয়ায় গলিত সোনা; image source: science.com

এবার যথারীতি সৈন্যরা হানা দিলো বোরের ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সে। কিন্তু ততক্ষণে বোর এবং হেভেসি পালিয়ে গেছেন। হিটলারের বাহিনী ল্যাবে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে কি না তা হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলো। কিছু না পেয়ে অনেক জিনিস লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেল তারা। কিন্তু রহস্যে ঘেরা কমলা রঙের জারটি কেউ স্পর্শও করলো না। কমলা রঙের জলের আর কী দাম!

এরপর ১৯৪৩ সালে রসায়নে নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হলো, জর্জ ডি হেভেসি। যেহেতু বিজ্ঞানের নোবেল দেয়া হয় সুইডেন থেকে, তাই হেভেসিকে পালিয়ে স্টকহোমে যেতে হয় নোবেল পুরস্কার গ্রহণের জন্য। কিন্তু তার রেখে যাওয়া জারটির জন্য ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিলেন। এজন্য তিনি আবার বাধ্য হয়ে কোপেনহেগেনে ফিরে যান। সেখানে ফিরেই প্রথমে গেলেন ঐ গবেষণাগারে। ঢুকেই তাকের কাছে গিয়ে জারটি দেখলেন ঠিক আছে কি না! পরে সেটির অবস্থান নিশ্চিত করে তিনি বোরকে জানালেন। 

সোনা গলানোর পরীক্ষায়রত হেভেসি; image source: science.com

সোনা গলিয়ে হিটলারের চোখ তো ফাঁকি দেয়া গেলো। কিন্তু সেই দ্রবীভূত সোনা পুনরায় মেডেলে রুপান্তর করে যাদের আমানত তাদের তো ফিরিয়ে দিতে হবে। তাই এবার অ্যাকুয়া রিজিয়া থেকে সোনা পুনরুদ্ধারের কাজ করতে হবে। তবে কাজটি মোটেও সহজ ছিলো না। তবে কোন বিজ্ঞানী এ কাজটি করেছিলেন তা নিয়ে কিছুটা মতবিরোধ রয়েছে। কোনো কোনো বিজ্ঞানের ইতিহাস লেখকের মতে, বোরের সেজো ছেলে এই কাজটি করেছিলেন। অ্যাগেই বোর ছিলেন নিলস বোরের সেজো ছেলে। তিনিও বাবার মতো পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি ১৯৭৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। অ্যাকুয়া রিজিয়া থেকে সোনা উদ্ধারের দুটি সম্ভাব্য উপায় হচ্ছে, হয় সোডিয়াম মেটাবাইসাল ফাইট অথবা ফেরাস সালফেট ব্যবহার করে সোনা আলাদা করা।অ্যাগেই বোর এ পদ্ধতি দুটির যেকোনো একটি ব্যবহার করেছেন বলে ধারণা করা হয়।

অ্যাগেই বো’র; image source: Neils Bohr institute

এবার সদ্য মুক্তি পাওয়া সোনাগুলো প্যাকেট করে নিলস বোর নোবেল কমিটির কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি সুইডেন থেকে কোপেনহেগেনের গবেষণাগারকে লেখা বোরের এক চিঠিতে এ কথা জানা যায়। বোরের পাঠানো সোনা দিয়ে নোবেল কমিটি পুনরায় দুটি মেডেল বানালো। ম্যাক্স ভন লু ও জেমস ফ্রাঙ্কের নাম নোবেল দুটিতে অঙ্কিত করে তাদের দুজনের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

নোবেল মেডেল। ২৩ ক্যারেটের ২০০ গ্রাম সোনা দিয়ে গড়া হয় এই মেডেল; image source: washingtonpost.com

এই ২০০ গ্রাম সোনার তৈরি মেডেল দিয়ে হয়তো পৃথিবী কেনা সম্ভব নয়। তবে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে ম্যাক্স ভন লু এবং জেমস ফ্রাঙ্কের কাছে এই মেডেল দুটি অমূল্য ছিল।

ফিচার ইমেজ source: NBC News

Related Articles

Exit mobile version