বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত চরিত্র প্রফেসর শঙ্কুকে পড়েনি এবং যারা পড়েছে তাদের মধ্যে কে তার আশ্চর্য সব আবিষ্কার সম্পর্কে পড়ে চোখ কপালে তোলেনি কিংবা মুগ্ধ হয়নি? এসব আবিষ্কার সম্পর্কে পড়লে মনে হতো- আবিষ্কারগুলো যদি সত্যি সত্যি হতো, আবিষ্কারগুলো যদি আমরা হাতের নাগালে পেতাম! প্রোফেসর শঙ্কুর অনেকগুলো আবিষ্কারের মধ্যে দুটি আবিষ্কার ছিল কারবোথিনের তৈরি বৈদ্যুতিক শক নিরোধক পোশাক। গিরিডিতে ঝড়ের মধ্যে তার বাগানের গাছের চারাগুলো বাঁচাতে গিয়ে কাছাকাছি একটা তালগাছে বাজ পড়ায় প্রফেসর শঙ্কু অজ্ঞান হয়ে যান এবং এরপরেই এই জামাটি আবিষ্কার করেন। আরেকটি আবিষ্কার হচ্ছে এয়ারকন্ডিশনিং পিল যে বড়িটি পকেটে রাখলেই মানুষ শীতকালে গরম এবং গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা অনুভব করে। আবার মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা “বিজ্ঞানী সফদর আলীর মহা মহা আবিষ্কার” বইয়ে দেখা যায় বৃষ্টির মধ্যে দোকানে জিলাপী খেতে এসে সফদর আলী তার ভেজা জামার একটি সুইচ টিপে দিলেন। ভেজা জামার পানিগুলো বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে গেল এবং জামা শুকিয়ে গেল। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সুতার ভিতর নাইক্রোম ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তাই যখন ইচ্ছা শুকিয়ে নেয়া যায়!
ভূমিকায় এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে অনেক আগে লেখা এই কল্পকাহিনীগুলো এখন একটু একটু করে বাস্তবতার রূপ নিচ্ছে। প্রযুক্তিতে পৃথিবী দিন দিন এত এগিয়ে যাচ্ছে যে আগের দিনে যেগুলো শুধু কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল আজ সেগুলো সত্যি সত্যি আবিষ্কার হচ্ছে এবং মানুষ তা একটু একটু করে ব্যবহারও করতে পারছে। ঠিক এমনই কিছু একটা করা হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়াতে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকে। পিয়ংচেং এর এই অলিম্পিকে এবার রেকর্ড ঠাণ্ডা পড়েছে। এই ঠাণ্ডার উৎস মাঞ্চুরিয়ান এবং সাইবেরিয়া থেকে আগত হিম শীতল ঠাণ্ডা বাতাস। তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট অর্থাৎ প্রায় -১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে পড়েছে। এই আবহাওয়ার মধ্যে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের খেলতে হচ্ছে। এরকম ঠাণ্ডা সহ্য করার জন্য মানুষের শরীর তৈরি হতে হবে ইস্পাতের, নাহলে সম্ভব নয়। কিন্তু এরকম বৈরি পরিবেশেও খেলা হচ্ছে।
এই অলিম্পিকে যারা খেলোয়াড়দের জন্য পোশাক তৈরি করেছে তারা কিছু অভিনব প্রযুক্তি এই পোশাকের ভিতর ব্যবহার করেছে যা প্রচণ্ড ঠাণ্ডাকেও হার মানাতে পারবে। তারা পোশাকগুলো এমনভাবে তৈরি করেছে যে, জ্যাকেটগুলো নিজে নিজেই তাপ তৈরি করে শরীর গরম রাখবে এবং এমন সব ফেব্রিক ব্যবহার করা হয়েছে যা বিদ্যুৎ এবং তাপ অপরিবাহী। এমনকি বিদ্যুৎ পরিবহণের জন্য কোনো বৈদ্যুতিক তার নয়, বরং জামার কালি ব্যবহার করা হয়েছে এই পোশাকগুলোতে। এরকম ঠাণ্ডা এর আগে পড়েছিল ১৯৯৪ সালে নরওয়েতে। সেই অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এত ঠাণ্ডা পড়েছিল যে অনুষ্ঠান বাতিল করে দিতে হয়েছিলো। কারণ সেই অনুষ্ঠানে পায়রা উড়ানোর একটি পর্ব ছিল। ঠাণ্ডার কারণে যাতে পায়রাগুলোর কষ্ট না হয় সেজন্য এরকমটি করা হয়েছিলো।
এই অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী আমেরিকান দলের জন্য তাদের দেশের ডিজাইনার এবং প্রকৌশলীরা তাদের পোশাক পরিচ্ছদের সাথে সাথে পোশাকের বায়ুগতিবিদ্যা এবং এর সাথে সাথে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার বিপরীতে কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় তা নিয়েও গবেষণা শুরু করে। যে জায়গায় খেলা হবে সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে তারা আগে থেকেই জানতো। তাই সেভাবেই তারা আগে থেকে পোশাক নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছিলো। পিয়ংচেং এর যে মাঠে খেলা হচ্ছে সেটা হচ্ছে খোলা এবং উপরে কোনো ছাদ নেই। পুরো অলিম্পিকে সর্বাধিক শীতল এলাকা হচ্ছে এই জায়গা। এর আগে নভেম্বর মাসে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে ছয় জন এখানে কনসার্ট করতে এসে হাইপোথার্মিয়ার শিকার হয়।
আমেরিকান দলটির জন্য যে পোশাকটি তৈরি করা হয় তার ধারণাটি ছিল অনেকটা এরকম। পুরো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে পোশাকের মধ্যে। এই প্রযুক্তি ক্রীড়াবিদদের শরীর গরম রাখতে সাহায্য করবে। আমেরিকান পতাকার মতো করে তৈরি এই পোশাকে থাকবে তাপ পরিবাহী ধাতব কালি, যা রূপা এবং কার্বন দিয়ে তৈরি হবে। পোশাকটি কাজ করবে বৈদ্যুতিক কম্বলের মতো। পোশাকের ভিতরেই লিথিয়ামের তৈরি ব্যাটারি থাকবে। ক্রীড়াবিদরা যখন ইচ্ছা ব্যাটারি ব্যবহার করে শরীর গরম করে নিতে পারবে।
একবার যদি সুইচ চালু করা হয় তাহলে কালি দিয়ে ইলেকট্রন প্রবাহ শুরু হবে এবং এটি প্রবাহিত হতে থাকবে যতক্ষণ না পর্যন্ত ভিতরে রাখা একটি কার্বন প্যাড ইলেকট্রনগুলোকে বাধা না দেয়। এই বাধা দেয়ার পরে পোশাকের ভিতর তাপ উৎপন্ন হবে। এভাবে উৎপন্ন তাপ টানা ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত পোশাক গরম রেখে ক্রীড়াবিদদের শরীর গরম রাখতে পারবে। এর মধ্যে তিন ধরনের প্রযুক্তিগত প্রতিবেশ দেয়া থাকবে যাতে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এরকম পোশাক তৈরির ধারণা আসে গাড়ির ভিতর উষ্ণতা প্রদানকারী আসন তৈরি থেকে। এবারের অলিম্পিকে এরকম পোশাক পরেই আমেরিকান দলগুলো খেলায় অংশগ্রহণ করেছে।
আমেরিকার ববস্লে (Bobsleigh) দলের জন্য আরেক ধরনের পোশাক তৈরি করা হয়েছে, যেটা শরীর তো গরম রাখবেই, এছাড়া বায়ুগতির দিকটাও খেয়াল রাখবে। ববস্লে খেলায় অংশগ্রহণ করলে এটি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৯০ ঘণ্টা থেকে বেশী গতিতে ছুটে যেতে থাকে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে এরকম বেগের ভিতর থাকলে খুব স্বাভাবিকভাবে ঠাণ্ডা আরও বেশী লাগবে। সেজন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ফেব্রিক তৈরি করা হয়েছে, যাতে করে তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। এগুলো সিরামিক জাতীয় বস্তু দিয়ে তৈরি, যেটা খুব ভাল তাপ অপরিবাহক। Under Armour বলে এক আমেরিকান কোম্পানি এটা তৈরি করেছে এবং ক্রীড়াবিদদের কাছ থেকে খুব ভাল প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে। তারা বলেছেন, এটা ব্যবহারের ফলে তাদের শরীর আগের পোশাকের তুলনায় বেশী গরম থাকছে। ব্যবহারকারীদের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য হতোই, কারণ খেলায় অংশগ্রহণের ঠিক আগের মুহূর্তে শরীর গরম রাখা তাদের নিজেদের জন্য প্রয়োজন এবং খেলা শুরু হবার পর যাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে তারা অস্বস্তিতে না পড়ে সেজন্যও তাদের জন্য এরকম পোশাকের দরকার ছিল।
এই পোশাকগুলো তৈরির জন্য যে ধরনের পদার্থ দরকার ছিল সেটা খুঁজে বের করার জন্য প্রায় ১০০টি বিভিন্ন ফেব্রিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। Under Armour-দের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি পদার্থ বের করা যেটা একইসাথে শরীর গরম করবে এবং ববস্লে খেলার সময় ক্রীড়াবিদদের শরীরের উপর আসা বায়ুগতির বাঁধাও অনেকাংশে কমিয়ে দিবে। ববস্লে খেলায় সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ভগ্নাংশ সময় ব্যবধানের কারণে একটি দল হেরে যেতে পারে। তাই পোশাকের উপর বাতাসের বাঁধা যদি কমানো যায়, তাহলে খুব স্বাভাবিক যে তারা আরও দ্রুত বেগে এগিয়ে যেতে পারবে। সেজন্য অনেকগুলো পরীক্ষার পর তারা এমন একটি পোশাক তৈরি করলো যেটা নাইলন এবং স্পেন্ডেক্সের তৈরি। স্পেন্ডেক্স হচ্ছে এমন একটি পদার্থ যেটা কাপড়কে টান টান রাখতে পারে এবং অনেক বেশী টানলেও যেটা ছিঁড়ে যাবে না এমন একটি পদার্থ দিয়ে তৈরি। পোশাকের একদম বাইরের স্তর Sandpaper দিয়ে তৈরি, যেটা খুব সহজেই বাতাসের প্রবাহকে বিঘ্ন করতে পারে।
যেভাবে প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে এবং সাথে সাথে মানুষের সৃজনশীলতার যে বিকাশ দিন দিন হচ্ছে তাতে সামনে আরও অনেক কল্পনাকে বাস্তবে রূপ পেতে দেখা যাবে।
ফিচার ইমেজ: wordpress.com