সাপের বিষের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা যেভাবে গড়ে উঠেছে কিছু প্রাণীর দেহে

পৃথিবীতে আজ অবধি অগণিত প্রাণীর মাঝে সাপের অস্তিত্ব বেশ আলাদা করেই চোখে পড়ে। সরীসৃপ শ্রেণীর এই প্রাণীর যেমন রয়েছে অনুপম বিষ উদগারের ক্ষমতা, ঠিক তেমন তার প্রজাতিভেদে বহুরূপী খোলসের আবরণ, যা তাকে দান করেছে বিশেষত্ব। খাদ্যজালে অবস্থিত এই মাংসাশী প্রাণীর শিকার করবার অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে তার প্রাণ সংহারকারী বিষের ব্যবহার এবং শক্তিশালী মাংসপেশী। সমস্ত সাপের প্রজাতির মাঝে ৮৫ ভাগই নির্বিষ। তবুও সাপের বিবর্তিত স্যালিভারি গ্ল্যান্ড থেকে যে বিষ নির্গত হয়, তা ব্যবহৃত হয় সাপের শিকারী থেকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে, এবং শিকারকে ধরাশায়ী করতে। কিন্তু বিবর্তনের প্রয়োজনে এই প্রাণঘাতী সাপের বিষের প্রতি সহনশীলতা অর্জন করতে পেরেছে বেশ কিছু প্রাণী। তাই আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু সাজানো হয়েছে সাপের বিষের প্রতি রেজিস্ট্যান্স এবং ইমিউনিটির ধারণা, সাপের বিষ কী কী উপায়ে ক্ষতিসাধন করতে পারে, বিষের প্রতি সহনশীলতার উপায়, ও সব শেষে কিছু প্রাণীর উদাহরণ যারা এই সহনশীলতা লাভ করতে পেরেছে।

রেজিস্ট্যান্স এন্ড ইমিউনিটি

প্রথমেই আসা যাক বিষের প্রতি সহনশীলতা বলতে কী বোঝায় সেই আলাপে। খুব সহজ ভাষায়, কোনো ক্ষতিকর বস্তুর প্রভাব উত্তরণের ক্ষমতা অর্জনকে সেই বস্তুর প্রতি সহনশীলতা বলে, যাকে ইংরেজিতে রেজিট্যান্স বা ইমিউনিটি এই দুইটি শব্দ প্রয়োগে সমার্থক অর্থে ব্যবহার করা হয়। তবে এই দুই শব্দে কিছু তফাত আছে বৈকি!

Image Courtesy: Good Fon

প্রথমত, রেজিস্ট্যান্স বলতে মূলত এমন সহনশীলতাকে বোঝায় যেখানে বিষের উপস্থিতি কোনো নির্দিষ্ট প্রাণীকে কিছুটা ক্ষতি করবে বটে, কিন্তু এই ক্ষতির পরিমাণ হবে আর দশটা প্রাণীর চেয়ে অনেক কম। তাই এই ক্ষতি খুব সহজেই সেই প্রাণী কাটিয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে, ইমিউনিটি বলতে সেরূপ প্রতিরক্ষাকে বোঝায় যেখানে বিষ নির্দিষ্ট প্রাণীকে কোনো ক্ষতিই করতে পারে না, অন্য প্রাণীর মতোই সে স্বাভাবিক থাকবে। অর্থাৎ, সর্বোচ্চ রেজিস্ট্যান্সকেই ইমিউনিটি হিসেবে ধরা হয়।

সাপের বিষের প্রভাব

মোট চার ধরনের বিষের প্রভাব দেখা যায়। যেমন:

১) প্রথমে আসি টিস্যুকে গলিয়ে দেওয়া যে বিষ মাসল প্যারালাইসিস ঘটায়। সাধারণত এই ধরনের বিষে প্রোটিওলাইটিক এনজাইম থাকে যা মাসল টিস্যুকে নষ্ট করে দেয়, তাতে মাসল মুভমেন্ট কষ্টকর হয়ে যায়। উদাহরণ: র‍্যাটেল স্নেকের বিষ।

২) রক্ত জমাট বাঁধানো বা জমাট বাঁধতে বাধা দেওয়া- এই দুই কাজ করতে পারে হেমোটোক্সিক বিষ, যা মূলত লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস করে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত সংঘটিত হয়। উদাহরণ: রাসেল ভাইপারের বিষ।

৩) নার্ভাস সিস্টেম নষ্ট করে দেওয়া আরেকপ্রকার বিষ হলো নিওরোটক্সিক বিষ। এই বিষ স্নায়ু সংকেত প্রেরণকারী পদার্থ (নিউরোট্রান্সমিটার) অকেজো করে দেয়। ব্রেইন এবং মাসল প্যারালাইসিসের মাধ্যমে ক্ষতিসাধন করা এই বিষের আরেক বিশেষত্ব, বেশিরভাগ সময় আক্রান্ত প্রাণী বুঝতেই পারে না যে তাকে সাপে কেটেছে। উদাহরণ: ব্ল্যাক মাম্বার বিষ।

৪) সাইটোটক্সিক বিষ উল্লেখিত বিষগুলোর তুলনায় কম ক্ষতিকর। এটি কোষীয় পর্যায়ে ক্ষতি করে, কোষের মৃত্যু ঘটায়। যেমন: কোবরার বিষ।

কীভাবে এই প্রভাব অতিক্রম করলো?

একটি প্রাণী মূলত তিনভাবে সাপের বিষের ক্ষতিকর প্রভাব টেক্কা দিতে পারে।

প্রথমত আসি, এন্টিভেনম ব্লাড প্রসংগে, যাকে মূলত বলা হয় এন্টিভেনিন। এন্টিভেনিন শব্দটির প্রবক্তা একজন ফরাসি বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট কালমেট, যিনি একটি খরগোশের উপর পরীক্ষা করেন। প্রথমে তিনি খুব অল্প পরিমাণ (০.০৩ মিলিগ্রাম) কোবরার বিষ একটি সুস্থ খরগোশের দেহে প্রবেশ করান। ধীরে ধীরে প্রতি সপ্তাহে তিনি ডোজের মাত্রা বাড়াতে থাকেন, এবং আট মাস পর তিনি ৩৫ মিলিগ্রাম কোবরার বিষ প্রবেশ করান, যা একটি স্বাভাবিক খরগোশকে মারতে যে বিষ প্রয়োজন তার চেয়ে ১৫ গুণ বেশি! কিন্তু তবুও তার পরীক্ষিত খরগোশের কিচ্ছু হয়নি! পরবর্তীতে তিনি সেই খরগোশের সিরাম নিয়ে সেটি প্রবেশ করান আরেক খরগোশের দেহে, যাকে তখনও কোনো কোবরার বিষের সংস্পর্শে আনা হয়নি। দেখা গেল, নতুন খরগোশের ক্ষেত্রেও পূর্বে পরীক্ষিত খরগোশের সিরাম থেকে পাওয়া এন্টিবডির কারণে তার শরীরেও বিষের আঁচ লাগেনি।

অ্যালবার্ট কালমেট; Image Courtesy: Wikimedia Commons

মূলত, উক্ত পরীক্ষার মতোই প্রাকৃতিকভাবেই কিছু কিছু প্রাণীর রক্তে এমন এন্টিবডি থাকে যা সেই বিষ বা ভেনমের প্রভাব নালিফাই বা অসাড় করে দেয়। স্বাভাবিকভাবে, সাপ যখন বিষ প্রয়োগ করে, তখন সেই বিষ বাহিকার মাধ্যমে শরীরে অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই বিষের প্রভাব নষ্ট করার জন্য বিবর্তনের প্রয়োজনে উক্ত প্রাণীর শরীরে এই এন্টিবডি তৈরি হয়। এখানে আরেকটি বিষয় যোগ করা দরকার। মানুষের জন্য যে এন্টিভেনম তৈরি হয়, তা মূলত এই পরীক্ষারই সাহায্য নিয়ে করা, তফাত কেবল- খরগোশের পরিবর্তে ঘোড়াকে বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গে বলা যায় সেল মিউটেশনের কথা। মিউটেশন শব্দের অর্থ পরিবর্তন। প্রাণ আছে এমন সকল অস্তিত্বের ক্ষেত্রে প্রোটিন একটি অবশ্যম্ভাবী উপাদান। কোষের আবরণে এমন কিছু প্রোটিন থাকে যারা কেমিক্যাল সিগন্যাল বাইরে থেকে কোষের ভেতর প্রবেশ করায়। এদের বলা হয় রিসেপ্টর প্রোটিন। কিছু প্রাণী, উদাহরণস্বরূপ- নেউল, তাদের এসিটাইলকোলিন রিসেপ্টর প্রোটিন অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের মতো নয়। বরং সেটি কিছুটা পরিবর্তিত (অনেকটা সাপের এসিটাইলকোলিন রিসেপ্টরের মতো, যে কারণে সাপ নিজের বিষে আক্রান্ত হয় না), যার ফলে ভেনোম কোষে ধাক্কা খেয়ে অন্যত্র সরে যায়। এতে নেউল সম্ভাব্য আশংকা থেকে রেহাই পায়।

তৃতীয়ত, শক্ত চামড়ার কারণে প্রতিরক্ষার কথাও বলা যায়। কিছু প্রাণীর রয়েছে খুব দৃঢ় চামড়া, যার কারণ সাপের বিষদাঁত সেই চামড়া ভেদ করতে পারে না। ফলে বিষ শরীরের ভেতরে যেতে পারে না। যেমন: হানি ব্যাজার।

বিষ থেকে যারা রেহাই পেল

উডর‍্যাট

১৯৭৬ সালে ন্যাশনাল ন্যাচারাল টক্সিন্স রিসার্চ সেন্টারের এক ছাত্র সাপদের খাবার দিতে গিয়ে সাপের খাচায় ছেড়ে দেয় উডর‍্যাটকে। সে ভেবেছিল, আর দশটা রোডেন্টের মতোই তার পরিণতিও একই হবে- মৃত্যু। কিন্তু অবাক হয়ে সে লক্ষ্য করে, দিব্যি বেঁচে আছে রোডেন্ট গোত্রের এই ছোট্ট উডর‍্যাট। দেখা যায়, উডর‍্যাটের সিরামে রয়েছে এন্টিবডি, যা এন্টিভেনম হিসেবে কাজ করে।

woodrat
উডর‍্যাট; Image Courtesy: Freepik

হানি ব্যাজার

বেজির মতো দেখতে প্রাণীটি সাপ শিকারীও বটে। সচরাচর ফলমূল খেয়ে বেঁচে থাকলেও মাঝেমধ্যেই বড় শিকারের আশায় ইঁদুর, সাপ তাড়া করে বেড়ায়। এদের রক্তে যেমন এন্টিভেনম রয়েছে, তেমনই শক্ত চামড়াও তাদের বাড়তি সুবিধা প্রদান করে।

Honeybadger
হানি ব্যাজার; Image Courtesy: Phil Bird/Deposit Photos

শজারু

শজারু বা কাটাচুয়ার কাঁটা শিকারী সাপকে ধরাশায়ী করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি শজারুর রয়েছে Erinacine নামে প্রোটিন, যা এন্টিভেনম হিসেবে অল্প পরিমাণ ভেনম নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম।

Hdgehog
শজারু; Image Courtesy: Andrey Maximenko/iStock

নেউল

সাপের শত্রু বলে বিবেচিত এই প্রাণীর রিসেপ্টর প্রোটিন হিসেবে কিছু গ্লাইকোপ্রোটিন থাকে যা অন্য স্তন্যপায়ীদের মতো নয়। যেখানে অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর রিসেপ্টর প্রোটিন নিউরোটক্সিনের সংস্পর্শে আসে, সেখানে নেউলের মিউটেটেড (পরিবর্তিত) রিসেপ্টর প্রোটিন নিউরোটক্সিনকে কোষের সংস্পর্শে আসতে দেয় না। অনেকটা এমন প্রতিরক্ষা দেখা যায় গৃহপালিত শূকরের মাঝেও, যা তাদের নিউরোটক্সিক সাপের বিষ থেকে ইমিউনিটি প্রদান করে।

Mongoose
নেউল; Image Courtesy: Freepik

সাপ নিজেই

Kobra
কিং কোবরা; Image Courtesy: Freepik

নিজের পায়ে কুড়াল মারা ঘটনা শুধু মানুষই ঘটাবে তা তো নয়! ভুলবশত শিকারের গায়ে ছোবল বসাতে গিয়ে কখনো সাপ নিজেই নিজেকে আক্রমণ করে বসে। কিন্তু তাদের নিজেদের বিষ নিজেদের সেল রিসেপ্টরে বাইন্ড করে না। এভাবে তারা আত্মহননের পথ থেকে নিজেদের রক্ষা করে।

Related Articles

Exit mobile version