অতি সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় উঠে এসেছে সারাহ ইসলাম নামে এক তরুণীর খবর। দুরারোগ্য টিউবেরাস স্ক্লেরোসিসে আক্রান্ত সারাহ মারা গেছেন মাত্র বিশ বছর বয়সে, কিন্তু তার কর্মের জন্য হয়ে উঠেছেন চিরস্মরণীয়। তার এবং পরিবারের অনুমতিতে মৃত্যুর পর সারাহর দুটি কিডনি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দুজন রোগী ফিরে পেয়েছেন কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবন। তার কর্নিয়া চোখের আলো দেখিয়েছে আরো দুজনকে। তবে কিডনি প্রতিস্থাপনটিই বেশি উঠে এসেছে, কারণ বাংলাদেশে মৃত ব্যক্তি থেকে জীবিত ব্যক্তির দেহে কিডনি প্রতিস্থাপনের শুরু হলো সারাহ ইসলামকে দিয়েই।
একজন মানুষের অঙ্গ যখন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, তখন কখনো কখনো সেটি প্রতিস্থাপনের দরকার হয়। পশুর দেহ থেকে কিছু অঙ্গ নেয়া গেলেও সবচেয়ে ভালো হয় যদি অন্য কোনো মানুষের থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। ক্রনিক অথবা দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভোগা অনেক রোগীর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক জীবনযাপনের একমাত্র উপায় রোগযুক্ত অঙ্গটি প্রতিস্থাপন।
অঙ্গ প্রতিস্থাপনের রকমফের
অঙ্গ প্রতিস্থাপন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট হতে পারে পশু থেকে মানুষে বা মানুষ থেকে মানুষে। মানুষ থেকে মানুষে প্রতিস্থাপন আবার দু’রকম। জীবিত মানুষ তার একটি কিডনি দান করতে পারেন, দিতে পারেন ফুসফুস, অগ্ন্যাশয়, যকৃৎ অথবা পরিপাকতন্ত্রের অংশবিশেষ। একে বলা হয় লিভিং ডোনার ট্রান্সপ্ল্যান্ট।
মৃত ব্যক্তির থেকে নেয়া যেতে পারে দুটি কিডনিই, দুটি ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, অগ্ন্যাশয় আর পরিপাক্তন্ত্রের পুরোটাই, এবং কর্নিয়া। হৃদযন্ত্রের ভাল্ভ, চামড়া, টেন্ডন ইত্যাদিও মৃত ব্যক্তি থেকে জীবিত রোগীতে প্রতিস্থাপন করা যায়। মৃত ব্যক্তির থেকে অঙ্গ জীবিত মানুষের প্রতিস্থাপন করাকে বলা হয় ক্যাডেভারিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট (Cadaveric transplant)। উন্নত দেশগুলোতে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা অঙ্গের শতকরা ৮০-৯০ ভাগ এভাবেই আসে।
১৯৬৮ সালে জাপানের এক সার্জন হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করতে গিয়ে জীবিত দাতা ও গ্রহীতা উভয়েরই মৃত্যু ডেকে আনেন। এজন্য তাকে নরহত্যার অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। এরপর থেকেই ভাইটাল অর্গান, বা জীবনের জন্য অপরিহার্য অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য মৃত দাতাই সবচেয়ে সুবিধাজনক বলে প্রতীয়মান হয়, যাকে বলা হয় ‘Dead donor rule’। ফলে চিকিৎসক এবং আইনপ্রণেতাদের কাছে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে দেখা দেয় কখন একজন ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করা যায়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে মৃত্যুর মাপকাঠি
সাধারণভাবে, হৃদযন্ত্র থেমে যাওয়াকেই মানুষ মৃত্যু ধরে নিয়ে থাকে, একে বলা হয় কার্ডিয়াক ডেথ। এর ফলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায় বলে একে সার্কুলেটরি ডেথও বলা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানেও কার্ডিয়াক ডেথ স্বীকৃত। তবে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেলে ভাইটাল অর্গানগুলো দ্রুত মারা যায়, তাই সঞ্চালন চালু থাকা অবস্থায়, অর্থাৎ হৃদযন্ত্র যখনও পাম্প করে যাচ্ছে, তখন এসব অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য সরিয়ে নেয়াটা সফলতার হার বৃদ্ধি করে।
মূলত এই কারণেই ১৯৭০ ও ‘৮০-র দশকে ব্রেন ডেথ ধারণার প্রচলন হয়, যার দ্বারা মস্তিষ্কের কার্যক্রমের স্থায়ী পরিসমাপ্তি বোঝানো হয়। আইসিইউ-তে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে এধরণের রোগীর হৃদযন্ত্র আর ফুসফুস চালু রাখা হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের বেঁচে আসার সম্ভাবনা শুন্যের কোঠায়। তাই বিভিন্ন দেশে ব্রেন ডেথকে আইনগতভাবেই মৃত বলে স্বীকার করা হয়। ব্রেন ডেথ ঘোষণা করার জন্য চিকিৎসকের কিছু স্নায়ু পরীক্ষা করে থাকেন, যেগুলোর উৎপত্তি হয় ব্রেন স্টেম থেকে, যা কিনা স্নায়ুতন্ত্রের সেরেব্রাম, সেরেবেলাম এবং স্পাইনাল কর্ডের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে। ব্রেন স্টেম স্থায়ীভাবে অচল হয়ে গেলেই ব্রেন ডেথ হয়ে গেছে ধরে নেয়া হয়।
পশ্চিমা অনেক দেশে ক্লিনিক্যাল ডেথ বলতে ব্রেন ডেথকেই বোঝানো হয়। রোগী ও পরিবারের অনুমতিসাপেক্ষে এরপর দান করা অঙ্গগুলো সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। পুরো কাজ শেষ হবার আগপর্যন্ত কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রাখা হয় হৃদযন্ত্র এবং ফুসফুসকে। সুতরাং রোগীর কার্ডিয়াক ডেথ কিন্তু তখনও হয়নি। যেসব রোগীর কার্ডিয়াক ডেথ হয়ে গেছে তাদের থেকেই কিন্তু কিছু কিছু অঙ্গ নেয়া যায়, যেমন- কিডনি, যকৃৎ এবং অগ্ন্যাশয়।
বাংলাদেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বৃত্তান্ত
বর্তমান বিএসএমএমইউ-তে ১৯৮২ সালে প্রথম জীবিত দাতা থেকে রোগীর দেহে সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। ১৯৮৮ সাল থেকে মূলত কিডনি প্রতিস্থাপন বড় আকারে প্রচলিত হয়, তবে এর সবগুলোই ছিলো লিভিং ডোনার ট্রান্সপ্ল্যান্ট । মৃত দাতা থেকে কেবল নেয়া হতো কর্নিয়া, যার প্রচলন ১৯৮৪ সালে। এছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ নেয়া হতো না। ফলে অঙ্গ প্রতিস্থাপন দরকার এমন বহু রোগী থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় অঙ্গের সংস্থান করা সম্ভব হয়নি। তদুপরি সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুশাসন বিতর্কে পুরো বিষয়টি কিছুটা স্তিমিত হয়ে যায়।
১৯৯৯ সালের ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার দ্য হিউম্যান অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট প্রণয়ন করে, যেখানে জীবিত কোন কোন ব্যক্তি রোগীর জন্য অঙ্গ দান করতে পারবেন সেটা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। তবে এই তালিকা খুবই সীমিত থাকায় বিস্তার লাভ করে অবৈধ বেচাকেনা। ফলে ২০১৮ সালে আইনটি যুগোপযোগী করা হয়।
সারাহ ইসলামের কথায় ফিরে যাই আবার। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও দাতার অভাবে মরণোত্তর অঙ্গদান গতি পায়নি এতদিন। আশা করা যায় তার অবদানের ফলে আমাদের মধ্যে নতুন করে এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হবে, ব্যক্তি এবং পরিবার উদ্বুদ্ধ হবে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে। মনে রাখতে হবে, একসময় রক্তদান, কর্নিয়া দান ইত্যাদি ব্যাপারেও সামাজিক বাধা ছিল, তবে সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এখন আমরা এর উপকারিতা সম্পর্কে জানি। ক্যাডেভারিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের ব্যাপারেও দরকার এমন সামাজিক আন্দোলন, যাতে উপকৃত হতে পারেন ধুঁকতে থাকা বহু মানুষ।