কোভিড-১৯ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনেকগুলো খাতকে আমূলে বদলে দিয়েছে, বিশেষ করে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে যে টিকা দরকার, তার গবেষণায় এসেছে প্রভূত পরিবর্তন। টিকা নিয়ে গবেষণা করা একদিকে সময়সাধ্য, অন্যদিকে লম্বা সময়ে ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এতে বিনিয়োগ করে লাভ তুলে আনাটা কঠিন। তাই দীর্ঘমেয়াদে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে বিনিয়োগ করে লাভ তুলে আনতে পারবে কিনা সেই চিন্তা করে আর অনেক কোম্পানিই সেখান থেকে সরে আসে।
শুধু তা-ই না, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে গবেষণা কাজ হয় সেখানেও অর্থের উৎস সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তারাও অর্থ ছাড়ের বিনিময়ে কাজের অগ্রগতি দেখতে চান, কিন্তু একটি টিকার গবেষণা কাজে দ্রুত অগ্রগতি দেখানো অনেকটা কঠিন। এছাড়া টিকা নিয়ে গবেষণা করে বিভিন্ন বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তা, এরাও শেয়ার বাজার, ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর বিনিয়োগের উপর সরাসরি নির্ভরশীল।
ভ্যাক্সিনে বিনিয়োগের ঝুঁকি
এই টিকা উদ্ভাবনের পেছনে লাগে বিশাল বিনিয়োগ আর তা তুলে আনতে দরকার লম্বা সময়। টিকা নিয়ে কাজ করা প্রজেক্টকে অনেকটা ছোট ভঙ্গুর চারা গাছের মতোই দেখভাল করে বড় করতে হয়। একটি কার্যকর টিকা উদ্ভাবন করতে পাড়ি দিতে হয় লম্বা পথ। শুরুতেই দরকার পড়ে ঐ রোগের উপর বিস্তর গবেষণা। এরপর টিকা হিসেবে কয়েকটি প্রতিনিধি বা ক্যান্ডিডেট ঠিক করা। এরপর ধাপে ধাপে প্রাণীতে এবং তারপর নিরাপত্তা বিবেচনা করে মানুষে ঐ সম্ভাব্য টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা। এরপর তার থেকে গবেষণাপত্র বের করেন অনেকেই, পাশাপাশি তার অনুমোদনের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা এবং তা পাওয়া গেলে বাজারে আনা। ব্যর্থ হলে বিশাল সময়ের জন্য বিনিয়োগ করে তা তুলে না আনতে পারার ঝুঁকি তো থেকেই যায়। তাই টিকার গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসে বড় ফার্মাসিউটিক্যালগুলো বেশিরভাগ সময়েই নিত্য এবং বহুল প্রচলিত কিংবা বাজারে ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন ওষুধ বাজারজাত করায় মনোযোগ দেয়।
কতটা পরিবর্তন এসেছে কোভিড-১৯ এর ফলে
বিভিন্ন রোগের ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাক্সিন নিয়ে কাজ করতে বিশ্বজুড়ে প্রসার ঘটছে বায়োটেকনোলজির উদ্যোক্তা কোম্পানিগুলো। তাতে কখনো বিনিয়োগ আসছে দাতা গোষ্ঠীর, কখনো তাদের কিনে নিচ্ছে বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটে বড় পরিবর্তনের রেশ পাওয়া যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মোকাবেলার শুরু থেকেই। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। যত দ্রুত ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন করা যাবে তত দ্রুত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাওয়া যাবে।
কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে রেকর্ড সময়ে সর্বপ্রথম যে কয়টি ভ্যাক্সিন বাজারে এসেছে এর মাঝে আরএনএ ভিত্তিক ভ্যাক্সিনের আছে প্রাধান্য, বিশ্বজুড়ে জীববিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তি নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছেন। মানবদেহে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হলে আরএনএ ভিত্তিক ভ্যাক্সিন প্রযুক্তি হয়ে উঠতে পারে আরো কয়েকটি দুর্লভ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রধান আশা। খুব অল্প সময়ে কোভিড-১৯ এর টিকার কাজ যতটা দ্রুত এগিয়েছে এটি আরএনএ ভিত্তিক প্রযুক্তির জন্য একটি মাইলফলক। এর ফলে নতুন করে এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা গবেষণাকারী দল, প্রতিষ্ঠান, উদ্যোক্তাদেরা পাচ্ছে বিনিয়োগ। সম্ভাবনা জাগছে ক্যান্সার, এইডস, মাসকুলার ডিস্ট্রফির প্রতিষেধক থেকে শুরু করে ডেঙ্গু, চিকঙ্গুনিয়ার টিকার।
কেমন ছিল আগের চিত্র?
শুরুটা এত মসৃণ ছিল না, ২০১৩ সালের মার্চে চীনে শনাক্ত হয় নতুন ধরনের এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা। তখন বিশ্বজুড়ে ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলো দৌড়ে নামে এর টিকা বানাতে। ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান নোভার্টিসের একটি দল তখন এর সাম্ভাব্য টিকা বানাতে কাজ শুরু করে আরএনএ ভিত্তিক প্রযুক্তি নিয়ে। ভাইরাসের আরএনএকে তারা প্যাকেজ করেন লিপিড ন্যানোপার্টিকেলের (LNP) মাঝে। এক সপ্তাহের মাঝেই একটি সাম্ভাব্য টিকার কাজ শুরু করেন তারা, ছোট পরিসরে এক সপ্তাহের মাঝেই ইঁদুরের মাঝে চালানো হয় পরীক্ষা। নোভারটিসের টিম এক বছরের টিকার কাজ প্রায় কয়েক মাসের মাঝেই শেষ করে ফেলে। কিন্তু সেই সময়ে ‘ক্লিনিক্যাল গ্রেডের আরএনএ’ তৈরি করা ছিল বেশ কঠিন কাজ এবং এর জন্য দরকার ছিল আরো বড় বিনিয়োগ। তাই সেই কাজটি দিয়ে বৃহৎ পরিসরে আর ট্রায়াল চালানো যায়নি। ২০১৫ সালে ফ্লু কমে আসার সাথে সাথে নোভারটিসের মনোযোগ সরে আসে। তাদের ভ্যাক্সিন তৈরির সেই অবকাঠামোটিও বিক্রি করে দেয় তারা।
শুরু হয়েছে তিন দশক আগে
পাঁচ বছর পরে বিশ্বজুড়ে প্রায় সব জীববিজ্ঞানের প্রখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বায়োটেকনোলজি উদ্যোক্তা, ছোটবড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি সবার আগ্রহের কেন্দ্রে এসে দাঁড়ায় আরএনএ ভিত্তিক টিকার ব্যাপারটি। এই প্রযুক্তির একদম শুরুর দিকে কাজগুলো হয়েছিল ১৯৯০ সালে, ফ্রান্সের কিছু গবেষণাগারে, এখন যারা ‘সানোফি পাস্তুর’ নামের ওষুধনির্মাতাদের অধীনে। সেখানে আরএনএ ভিত্তিক প্রযুক্তির সাহায্যে ইনফ্লুয়েঞ্জার এন্টিজেনকে ইঁদুরে ঢোকানো হবে। এর মাধ্যমে ইঁদুরে ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হবে। অর্থাৎ দেহ তৈরি থাকবে এন্টিবডির সুরক্ষা নিয়ে, যখন আসল ভাইরাস দেহে প্রবেশ করবে তখন সে প্রতিরোধ দেখাতে সক্ষম হবে। তবে প্রথমদিকের সেই টিকায় যে ‘ডেলিভারি মাধ্যম’, অর্থাৎ যাতে মুড়িয়ে আরএনএটি পাঠানো হবে সেই লিপিডটি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হওয়ায় কাজ বেশিদূর যায়নি।
এরপর থেকে বিভিন্ন গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে গেছেন, ২০১২ সালে উদ্ভাবিত হয় লিপিড-ন্যানোপার্টিকেলের আবরণে মুড়িয়ে মানবদেহে পাঠানো যেতে পারে এই টিকা। মূলনীতির দিক থেকে বর্তমান কোভিড-১৯ এর ফাইজার-বায়োন্টেক এবং মডার্নার আরএনএ ভিত্তিক টিকা দুইটি একইভাবে কাজ করে। এখানে মূলত ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের সিকোয়েন্স থেকে কাজ শুরু হয়, এরপরের দীর্ঘ যাত্রা পাড়ি দিয়ে কোভিড-১৯ লড়াইয়ের ভ্যাক্সিন হিসেবে মানুষে প্রয়োগ শুরু হয়েছে এই আরএনএ ভ্যাক্সিনগুলো।
আরো কিছু রোগের আরএনএ ভিত্তিক টিকা
২০১২ সালের পর থেকে আমেরিকার ডিফেন্স এডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি (DARPA) বড় কয়েকটি ফার্মাসিউটিক্যালের সাথে কাজ শুরু করে এ ধরনের টিকা নিয়ে। তবে বড় কোম্পানির বাজার বিবেচনা করে বারবার টিকাতে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করা থেকে সরে আসে। তবে DARPA-র সাথে কাজ করে গিয়েছিল দুইটি বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠান, একটি জার্মানির CureVac এবং আরেকটি আমেরিকার মডার্না।
কোভিডের ঢেউ লাগার আগেই ২০১৫ সালে মডার্না এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার আরএনএ ভিত্তিক টিকা নিয়ে পরীক্ষা করেছে। এরপর কোম্পানিটি সাইটোমেগালোভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকার কাজ শুরু করে। শুধু তাই নয় করোনা আসার আগেই চিকনগুনিয়া এবং ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে আরএনএ ভিত্তিক ভ্যাক্সিনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আসছিলো এই কোম্পানির গবেষকেরা। আর নোভারটিসের কাছ থেকে কিনে নেওয়া টিকা গবেষণার অবকাঠামোটি চলে যায় আরেক ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের কাছে। তারাও সেখানে আরআনএ ভিত্তিক র্যাবিস ভ্যাক্সিন নিয়ে কাজ শুরু করেছে ২০১৯ সাল থেকেই।
২০১৯ সালের মে মাসে বেলজিয়ামেও আরেকটি নতুন বায়োটেক উদ্যোগ ‘জিফিয়াস ভ্যাক্সিনস’ দাঁড়ায়। তারা ‘ডুশেনি মাসকুলার ডিস্ট্রফি’, ‘সিসট্রিক ফাইব্রোসিস’ এর মতো রোগের আরআএনএ ভিত্তিক প্রতিকার বের করার চেষ্টা করছিল। তারা এর মাঝেই কাজ শুরু করেছিল ‘সেলফ এম্পলিফায়িং আরএনএ’, যারা শরীরের ভেতরে ঢুকে নিজেই সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারবে। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি শুরুর পরে এই প্রতিষ্ঠানগুলো পেয়েছে আলো। কারণ এই প্রযুক্তি যদি করোনা টিকাতে ব্যবহার করা যায় তবে টিকার খুব অল্প ডোজেই বিশাল সুরক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই জিফিয়াস মনোযোগ দিয়েছে করোনার নতুন প্রকারের আরএনএ ভিত্তিক ভ্যাক্সিনের দিকে। যা মানবদেহে প্রবেশ করে নিজেই নিজের সংখ্যা বৃদ্ধি করবে, অনেকটা ভাইরাসের মতোই। এবং এর ফলে পাওয়া যাবে বেশি সুরক্ষা। এই কাজগুলোতে আগে খুব একটা বিনিয়োগ না পাওয়া গেলেও এখন পাওয়া যাচ্ছে। জিফিয়াসের প্রধান নির্বাহী জানিয়েছেন, তারা এই প্রযুক্তির টিকার কাজে ৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের আশা করছেন।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে বর্তমানের আরএনএ ভ্যাক্সিনের যত দূর্বল দিক আছে সেগুলো নিয়ে। এরমাঝে প্রধান একটি দিক হলো এই আরএনএ’র গাঠনিক বৈশিষ্ট্য যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সেজন্য একে সংরক্ষণ এবং পরিবহন করতে হয় অতি নিম্ন তাপমাত্রায়। এর জন্য বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ এবং গরীব দেশগুলোতে টিকা পৌঁছানো একটি প্রধান বাধা হয়ে গেছে। ‘কিউরভ্যাক’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে এই আরএনএকে একটি জটিল ত্রিমাত্রিক আকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করছে। যদি এই কাজ পুরোপুরি সম্ভব হয় তাহলে এই টিকাকে সাধারণ রেফ্রিজেরটরেই মাসখানেক সংরক্ষণ করা যাবে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গবেষণা এই আরএনএ টিকার বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ চলছে। একে কীভাবে আরো উন্নত করা যায়, দুর্বলতা কমিয়ে আনা যায়।
জটিল এবং দুরারোগ্য নানা রোগের জন্য টিকা বা প্রতিষেধক তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে আরএনএ প্রযুক্তি। কোভিড-১৯ শুধু আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বিশ্বজুড়ে শতশত বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠান, উদ্যোক্তারা তৈরি, এই প্রযুক্তিতে দরকার বিশাল বিনিয়োগ এবং বৈজ্ঞানিক সমাজের মাঝে পারস্পরিক যোগাযোগ। তাহলেই আগামী দিনে পথ দেখাবে আরএনএ ভিত্তিক ভ্যাক্সিন।