১১ আলোক বর্ষ দূরেই আছে বাসযোগ্য আরেক পৃথিবী

অবিরাম পৃথিবীসদৃশ গ্রহ খুঁজে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। বহির্জাগতিক বুদ্ধিমান সভ্যতার অনুসন্ধান কিংবা ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষের বসবাসের বিকল্প গ্রহ নির্বাচন করতে হলে পৃথিবীর মতো গ্রহই খুঁজতে হবে সবার আগে। ভবিষ্যতের মানব সভ্যতার জন্য কেন দূরের গ্রহে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত, পৃথিবী অসীম নয়, কোনো না কোনো একসময় এটি তার ধারণক্ষমতার চূড়ান্ত অবস্থানে পৌঁছে যাবে। এ অবস্থার পর পৃথিবী আর স্বাভাবিকভাবে ক্রমবর্ধনশীল মানব ও মানব সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির গ্রহণ করতে পারবে না।

দ্বিতীয়ত, সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে শক্তির উৎসের প্রয়োজন হয়। এখন পর্যন্ত আমরা যত কিছু করছি তার পেছনে ব্যয় করা সমস্ত শক্তি আসে সূর্য থেকে। ভাত খাচ্ছি, ঘর বানাচ্ছি, দালান তৈরি করছি, বই পড়ছি, মোবাইল ব্যবহার করছি- এসবের সবকিছুর শক্তির উৎসই কোনো না কোনো এক দিক থেকে সূর্য থেকে এসেছে। কিন্তু সূর্যের বয়স অসীম নয়, কোটি বছর পরের একসময় এটি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। সূর্য মরে গেলে পৃথিবীতে সভ্যতা টিকিয়ে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তার উপর আরো একটি ঝুঁকি আছে। সূর্য যখন মরার কালে পৌঁছাবে তখন সেটি ধীরে ধীরে বেলুনের মতো ফুলতে থাকবে। প্রসারিত হতে হতে একদম পৃথিবীর কক্ষপথকেও ছাড়িয়ে যাবে। এমতাবস্থায় সকল প্রাণ ও সভ্যতা তো ধ্বংস হবেই, তার উপর স্বয়ং পৃথিবীর অস্তিত্বই শেষ হয়ে যেতে পারে। এমতাবস্থায় বিকল্প গ্রহের অনুসন্ধানের কোনো বিকল্প নেই।

সূর্যের জীবনচক্রের একপর্যায়ে সূর্য প্রসারিত হয়ে যাবে: Source: Science Vault

মহাকাশে গ্রহ অনেকই আছে, কিন্তু তাদের সবগুলোই মানুষের জন্য উপযুক্ত নয়। গ্রহ অহরহই আবিষ্কৃত হয়, সবগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ থাকার সম্ভাবনা যেসব নব-আবিষ্কৃত গ্রহের থাকে, তাদের নিয়ে আলোড়ন পড়ে যায় বিজ্ঞানীপাড়ায়। সম্প্রতি এরকম উপযুক্ত একটি গ্রহ খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গ্রহটির নাম Ross 128 b এবং এটি পৃথিবী থেকে ১০.৮৯ (প্রায় ১১) আলোক বর্ষ দূরে অবস্থিত। এটি তার সূর্যকে প্রায় ১০ দিনে একবার করে প্রদক্ষিণ করে।

এত দূরের গ্রহ কতদিনে একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে তা জানার জন্য ব্যবহার করা হয় পদার্থবিজ্ঞানের কিছু কৌশল। কৌশল ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এমনকি এত দূরের গ্রহে না গিয়েও, তার তাপমাত্রা ও আবহাওয়া সম্বন্ধে ধারণা নিতে পারেন। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, নব-আবিষ্কৃত এই গ্রহটির তাপমাত্রা স্থান বিশেষে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বিদ্যমান থাকে।

শিল্পীর কল্পনায় রস ১২৮ বি: Source: M. Kornmesser/ESO

দূরত্বের হিসেবে এটি পৃথিবীর নিকটবর্তী গ্রহের মাঝে দ্বিতীয়। সবচেয়ে কাছের প্রাণবান্ধব গ্রহটি হলো প্রক্সিমা সেন্টারি বি। এটি ২০১৬ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল। প্রক্সিমা সেন্টারির দূরত্ব মাত্র ৪ আলোক বর্ষ। প্রক্সিমা সেন্টারি থেকে দূরে অবস্থান করা সত্ত্বেও বহির্জগতে প্রাণের অনুসন্ধান কিংবা মানুষের বিকল্প ঠিকানা অনুসন্ধানের জন্য এখন পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় গ্রহ। কারণ, প্রক্সিমা সেন্টারির নক্ষত্র থেকে প্রচুর পরিমাণে এক্স-রে ও অতিবেগুনী রশ্মি নির্গত হয়। তীব্র ক্ষতিকর এই রশ্মির কারণে এর অধীনে থাকা গ্রহগুলো বিরান ও নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে। সে হিসেবে নতুন আবিষ্কৃত রস ১২৮ বি যথেষ্ট আশা প্রদান করে। এর পৃষ্ঠে প্রক্সিমা সেন্টারির মতো বেশি পরিমাণে ক্ষতিকর আলোক রশ্মি পড়ে না।

বহির্জাগতিক কোনো গ্রহ আবিষ্কৃত হলে সেটি পৃথিবীর মতো কিনা তা খুব গুরুত্বের সাথে যাচাই করা হয়। উন্নত প্রাণ কিংবা মানুষের বিকল্প ঠিকানার জন্য কোনো গ্রহকে কেন পৃথিবীর মতো হতে হবে, তার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা এমন একটি চমৎকার অবস্থানে আছে যে, এখানের পরিবেশ খুব বেশি গরমও না আবার খুব বেশি ঠাণ্ডাও না। পানি একইসাথে কঠিন, তরল ও গ্যাসীয়- এই তিন অবস্থায় থাকতে পারে। প্রাণের উৎপত্তি ও বিকাশের জন্য এমন একটি পরিবেশ খুবই উপযুক্ত। এরপর আছে পৃথিবীর ভর। এটিও সব দিক থেকে অনুকূলে। গ্রহের ভর খুব বেশি হলে নিজের অভিকর্ষের টানেই মারা যাবে মানুষ। ভর খুব হালকা হলে নিজের বায়ুমণ্ডল ধরে রাখতে পারতো না, যার ফলে পৃথিবী হতো বিস্তৃত এক বিরানভূমি। গ্রহের আবর্তনকারী নক্ষত্র থেকে গ্রহের দূরত্ব কত, তা-ও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দূরত্ব খুব বেশি হলে যথেষ্ট উত্তাপ পৌঁছাবে না, ফলে গ্রহের পরিবেশ খুব শীতল হয়ে যাবে। আবার দূরত্ব খুব কম হলে অধিক উত্তাপের ফলে বসবাসের উপযোগী কোনো পরিবেশই থাকবে না। এসব দিক থেকে বিবেচনা করলে পৃথিবী একদম উপযুক্ত অবস্থানে আছে। সেজন্য প্রাণ ধারণের উপযুক্ত গ্রহ অনুসন্ধান করতে গেলে সেটি পৃথিবী সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কিনা, তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।

কোনো গ্রহ পৃথিবীর মতো কিনা, তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়: Source: Fox Searchlight Pictures

Ross 128b বেশ কয়েকটি দিক থেকে পৃথিবীর মতো। পুরোপুরি পৃথিবীর মতো না হলেও এখানকার প্রাণবান্ধব পরিবেশ সেখানে আছে। যেমন- এটি তার নক্ষত্রের খুব কাছ থেকে প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবী থেকে সূর্যের যে দূরত্ব, নিজের নক্ষত্র থেকে তার ২০ ভাগের একভাগ দূরত্বে থাকে এ গ্রহটি। এ পরিমাণ দূরে থেকে পৃথিবী যদি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতো, তাহলে পৃথিবীতে নরক নেমে আসতো নিশ্চিত। কিন্তু রস ১২৮ বি এর বেলায় হিসেব একটু অন্যরকম। এর আবর্তনকারী নক্ষত্রটি খুব বেশি ক্ষমতাবান নয়। নক্ষত্রটি বর্তমানে লোহিত দানব পর্যায়ে আছে। এর উত্তাপ সূর্যের তুলনায় অনেক কম। সেজন্য গ্রহটি নক্ষত্রের খুব কাছে অবস্থান করা সত্ত্বেও প্রাণ ধারণের পরিবেশ বহন করতে পারছে। পৃথিবী পৃষ্ঠে যেরকম তাপমাত্রা আছে ঐ গ্রহতেও প্রায় সেরকম তাপমাত্রা আছে।

ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরি ও যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী এই গ্রহটি আবিষ্কার করেছেন। গ্রহ সংক্রান্ত গবেষণা তারা এস্ট্রোনমি অ্যান্ড এস্ট্রোফিজিক্স জার্নালে প্রকাশ করেছেন। এগুলোই চূড়ান্ত গবেষণা নয়। আরো সূক্ষ্ম ও বিস্তারিতভাবে গবেষণা করতে হবে সম্ভাবনাময় এই গ্রহটি নিয়ে। সেজন্য পরিকল্পনাও করে রেখেছেন বিজ্ঞানীরা। ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরি কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে European Extremely Large Telescope (E-ELT) নামে খুব বড় ও খুব ক্ষমতাসম্পন্ন একটি টেলিস্কোপ স্থাপন করা হবে। এর প্রতিফলক দর্পণ হবে ৪০ মিটার লম্বা, যা অন্য যেকোনো টেলিস্কোপ থেকে বড়।

ইউরোপিয়ান এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপের তুলনামূলক আকৃতি: Source: Astronomy Now/ESO

মহাকাশের ছবি তথা দূরের গ্রহ নক্ষত্রের ছবি তোলার জন্য হাবল টেলিস্কোপ অনেক বিখ্যাত। হাবলের তোলা ছবি বেশ নিখুঁত হয়। ইউরোপিয়ান এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে, এর তোলা ছবি হাবল টেলিস্কোপের ছবির চেয়েও ১৬ গুণ নিখুঁত হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এটি চালু হবে ২০২৪ সালে। এটি চালু হলে এর মাধ্যমে দূরের ঐ গ্রহের তথ্য উপাত্ত আরো নিখুঁত ও সূক্ষ্মভাবে জানা যাবে।

ফিচার ছবি- European Southern Observatory

Related Articles

Exit mobile version