এ কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অনেক সময় কেবলমাত্র খোলা জুতো থেকে বেরোনো তীব্র গন্ধে ঘর একেবারে ভরে যায়। লক্ষ্য করেছেন কি, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে সারাদিন পর আপনার অনেকক্ষণ পরে থাকা জুতো মোজা খুললে তা থেকে মাঝেমধ্যে এই অদ্ভুত ধরনের বিবমিষা জাগানিয়া গন্ধটি বের হয়? কেন এই গন্ধ বের হয় তা কি জানেন? চলুন জেনে নিই তাহলে!
এই গন্ধের মূল কারণ ঘাম। এমনিতে ঘাম নিজে কিন্তু বর্ণ-গন্ধহীন। কিন্তু এটি এক বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়াকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। আপনি যখন জুতা-মোজা পরে অনেকক্ষণ থাকেন, তখন এই ব্যাকটেরিয়াগুলো আপনার পায়ের আবদ্ধ পরিবেশে ভীষণ গরমে পা থেকে বের হওয়া ঘামের পরিবেশ কাজে লাগিয়ে এই গন্ধের সৃষ্টি করে।
ব্যাকটেরিয়াগুলো ব্রেভিব্যাক্টেরিয়াম গণের অন্তর্ভুক্ত। এরা এমনিতে আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে স্বাভাবিকভাবেই সহাবস্থান করে। কিন্তু শরীরে যখন ঘাম হয়, তখন পায়ের পাতার সামনের দিকে ঘামের ঘনত্ব বেশি থাকে। কারণ শরীরের অন্য অংশ বায়ুর সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা থাকলেও পায়ের পাতার এই অংশটুকু সাধারণত বায়ুর সংস্পর্শে আসে না। ফলে পায়ের পাতায় গরমের ফলে তৈরি হয় ঘাম এবং বিভিন্ন মরা কোষ। পায়ের আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে বেশি ঘনত্বের মরা কোষগুলোকে লক্ষ্য করে ব্যাকটেরিয়াগুলো এই অংশগুলোতে বেশি মাত্রায় উপস্থিত থাকে। এরা একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এখানে দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে।
ব্রেভিব্যাক্টেরিয়াগুলো গামা লাইয়েজ (γ-lyase) এনজাইমটি ধারণ করে। এই এনজাইমটি ঘাম এবং মরা কোষস্তরে মিশে থাকা মিথিওনিনকে মিথেনথায়োলে পরিণত করতে সাহায্য করে। এই মিথেনথায়োল নামক রাসায়নিকটির সালফারের ন্যায় দুর্গন্ধ রয়েছে।
অন্যদিকে প্রোপিনোব্যাক্টেরিয়া গণের ব্যাকটেরিয়াগুলোও দুর্গন্ধ সৃষ্টির জন্য দায়ী। বিভিন্ন মানুষের পায়ের দুর্গন্ধ পরীক্ষার স্যাম্পলে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো পাওয়া যায়। এরা ত্বকের স্বেদগ্রন্থি থেকে এমিনো এসিডের বিপাক ঘটিয়ে প্রোপানয়িক এসিডের সৃষ্টি করে
স্ট্যাফাইলোকক্কাস গণের একশ্রেণীর ব্যাকটেরিয়া (Staphylococcus epidermidis) ও আইসোভ্যালেরিক এসিড তৈরির মাধ্যমে বেশ কড়া ধরনের দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে পায়ে। এই ব্যাকটেরিয়াটি লিউসিন নামক এমিনো এসিড থেকে বিভিন্ন জটিল ধাপ পেরিয়ে আইসো ভ্যালেরিক এসিড তৈরি করে। এই চিত্রটিতে এমিনো এসিড থেকে লিউসিন তৈরির বিভিন্ন পর্যায়ক্রমিক ধাপ চিত্রিত হয়েছে।
মজার ব্যাপার কি জানেন? ব্যাকটেরিয়ার এই বিশেষ ধরনের গন্ধের সাথে মিল রয়েছে পনির কিংবা ভিনেগারের মতো খাদ্যদ্রব্যের। তাছাড়া এই গন্ধের সাথে সামান্য এমোনিয়ারও মিল রয়েছে। পায়ের গন্ধের জন্যে দায়ী প্রথম যে ব্রেভিব্যাকটেরিয়ার কথা বলা হলো, সেটি লিমবার্গার, বেল পাসে, পোর সাল্যু, পালপুসৎতাই, মেনসশ্চতেরকাসের মতো বিভিন্ন বিখ্যাত ব্রান্ডের পনিরের গন্ধ সৃষ্টির জন্যও ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি প্রোপিনোব্যাকটেরিয়াগুলো যে প্রোপানয়িক এসিড তৈরি করে সেগুলোর সাথে ভিনেগারে ব্যবহৃত এসিটিক এসিডের গাঠনিক সাদৃশ্য থাকবার ফলে পায়ের এই গন্ধের সাথে ভিনেগারের গন্ধের মিলও রয়েছে।
পায়ের এই বিশেষ ধরণের গন্ধ আবার মশাদের খুব প্রিয়। তানজানিয়ার ইফাকারা হেলথ ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানী ফ্রেদ্রোস ওকুমু তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন মশাদের (বিশেষ করে ম্যালেরিয়া বাহক মশাদের) এই গন্ধের প্রতি আকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে ফাঁদে ফেলে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।
ওয়াজেনিঙ্গেন এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী বার্ট নলস ২০০৬ সালে এই গন্ধ ও মশার আকর্ষণ সম্পর্কিত গবেষণার জন্য ইগ নোবেল পুরস্কারও অর্জন করেন! প্রতি বছর ম্যালেরিয়াতে যে প্রচুর মানুষ মারা যায় এটা নলসকে খুব ভাবিয়ে তোলে। সেই ভাবনার জায়গা থেকেই তিনি চিন্তা করতে শুরু করলেন এই ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের উপায়। এজন্যে তিনি প্রথমে খোঁজা শুরু করলেন মশা কেন মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়। বিশেষত, ম্যালেরিয়ার মশা কেন মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয় আর কীভাবে এই আকর্ষণের প্রক্রিয়াটি ঘটে থাকে। গবেষণার একপর্যায়ে এসে তিনি লক্ষ্য করলেন, শরীরের ঘামের গন্ধ, বিশেষ করে পায়ের ঘামের গন্ধ মশাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। কারণ গবেষণাগারের পায়ের ঘামে ভেজা প্যাডে মশার ঘনত্ব ছিল উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি। কিন্তু যেহেতু সবসময় পায়ের ঘামে ভেজা প্যাড তৈরি করা বেশ সমস্যার, তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন প্রায় একই রকম গন্ধবিশিষ্ট অন্য কোনো পদার্থ নেবেন, যেটি ছিল বিখ্যাত লিমবার্গার পনির। লিমবার্গার পনিরের ঘ্রাণ মশাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে- এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পর তিনি আস্তে আস্তে তার মশা ফাঁদে ফেলার যন্ত্র তৈরির কাজে মনোনিবেশ করলেন। তাই এবার তিনি লিমবার্গার পনিরের তীব্র ঘ্রাণের জন্যে দায়ী ব্যাকটেরিয়াটিকে আলাদা করে সেটির গন্ধ সৃষ্টি করবার প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে মশার ফাঁদ তৈরির কথা চিন্তা করলেন।
বিজ্ঞানী বার্ট নলসের তৈরি মশা ফাঁদে ফেলার যন্ত্রটি এখন আফ্রিকায় খুব কার্যকরী উপায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই মশার ফাঁদটি একটি গোলাকৃতির চোঙের মধ্যে বসানো থাকে। এই চোঙ আবার বসানো থাকে ঘরের চালা ও মূল বাড়ির দেয়ালের উপরের ফাঁকা ভেন্টিলেটরের অংশে। চোঙের মধ্যে মশা প্রতিরোধী বিষ মাখানো জাল স্থাপন করা থাকে। এই জালের একদিক থাকে চোঙের খোলা মুখে। এদিক থেকে মশারা ভেতরে প্রবেশ করতে চায়। অপরদিকে ব্যাকটেরিয়া কর্তৃক একটি আবদ্ধ স্থানে এই তীব্র গন্ধ সৃষ্টি হতে থাকে। এই গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে যখন মশা ভেতরে প্রবেশ করতে চায়, তখন বিষমাখানো জালের স্পর্শে মশার মৃত্যু হয়।
বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যাকটেরিয়াপ্রসূত এই গন্ধ অনেক সময় আমাদের বিরক্তি সৃষ্টি করেছে কিংবা অনেক সময় আমাদেরকে অন্যদের কাছে করেছে অপ্রস্তুত। কিন্তু এই সামান্য বিষয়টিও মানুষের কল্যাণে প্রবল ভূমিকা রাখছে। সুতরাং, দেখতেই পাচ্ছেন, আপাতদৃষ্টিতে একেবারে সাধারণ ঘটনার পেছনেও বিজ্ঞানের কী অদ্ভুত খেলা লুকিয়ে আছে! বিজ্ঞানের সৌন্দর্য তো এখানেই।