কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গিয়ে পানিতে নেমেছেন, অথচ সেই লোনা পানিতে হাবুডুবু খাননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। সমুদ্রের কাছে গেলেই সমুদ্র যেন নিজ থেকে ডাকতে শুরু করে ওর মাঝে বিচরণ করবার জন্য। এই অদ্ভুত এক ভালোলাগাকে নির্ভর করেই মানুষ বছর বছর সমুদ্রে যান, সামর্থ্যবানেরা দেশের বাইরের সমুদ্রগুলোতেও বিচরণ করেন এই অসামান্য ভালোলাগাকে কেন্দ্র করেই। পৃথিবীর চারভাগের তিনভাগ পানি। পানিই যদি মানুষকে উল্লাসিত করতে না পারে তাহলে আর কোন জিনিসটি করবে?
সমুদ্রের এই লোনা পানিতে হাবুডুবু খেয়ে কেমন অনুভূতি তৈরি হয়েছিলো একবার ভাবুন তো? মুহূর্তের মাঝে তৃষ্ণায় আপনার বুকের ছাঁতি ফেঁটে যাবার অবস্থা হবে, সেই সাথে সাধারণ পানির জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষাও তৈরি হবে। বিরক্তিতে এমনও মনে হতে পারে, সমুদ্রের পানি এত লবণাক্ত হতে হলো কেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী হয়তোবা আপনি বিরক্ত। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, লবণের মতো উপকারী পদার্থ দ্বিতীয় কোনোটি আছে কিনা।
বৈজ্ঞানিক ভাষায়, সাধারণ খাদ্য লবণ হলো সোডিয়াম ক্লোরাইড; সোডিয়াম ও ক্লোরিন দুটোই বিষাক্ত পদার্থ, অথচ দুই বিষ মিলে তৈরি করছে অতি প্রয়োজনীয় লবণ। লবণ ছাড়া তরকারী কিংবা খাবারের কথা যেমন কল্পনা করা যায় না, সমুদ্রকেও লবণ ছাড়া কল্পনা করা যায় না। সমুদ্রের পানিতে লবণ আছে বলেই সমুদ্র এত সৌন্দর্য ধারণ করে আছে যে বারে বারে আমাদেরকে কাছে টেনে নিতে পারে। একটি কথাতে আমরা সবাই নিশ্চয়ই একমত যে, পৃথিবীর যতসব ময়লা-আবর্জনা রয়েছে, সবকিছু নদীঘুরে সমুদ্রেই পতিত হয়, তাই না? মানবজাতির শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত ভাবুন তো, ময়লার পরিমাণ নিশ্চয় কম নয়, এত এত আবর্জনা সমুদ্রে গিয়ে পতিত হয়, সমুদ্র কীভাবে তার সৌন্দর্য ধরে রাখে? কেন দূষিত হয়ে যায় না সমুদ্র, যেমনটি হয় নদী কিংবা খালের পানি? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে সমুদ্রের পানিতে উপস্থিত লবণের মাঝে। লবণের উপস্থিতির কারণেই সমুদ্রে ময়লা-আবর্জনা জমে না থেকে সমুদ্রকে দূষণমুক্ত রাখে।
যা-ই হোক, আজকের আলোচনার বিষয় হলো, সমুদ্রের লোনা পানি পানে কেন আমাদের এত তৃষ্ণা পায়? অতিরিক্ত লবণাক্ত সমুদ্রের পানি খেয়ে নিলে আমাদের শরীরে প্রধানত যা ঘটে সেটি হলো ডিহাইড্রেশন অর্থাৎ পানিশূন্যতা।
সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে হঠাৎ করে কয়েক ঢোঁক পানি গিলে ফেললেন, সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়ে গেলো আপনার। লবণাক্ত স্বাদের কারণ তো আছেই, সেই সাথে দেহের অতিরিক্ত লবণকে ছেঁকে বের করবার দায়িত্ব পেয়ে যায় শরীরের বৃক্কদ্বয়। অতিরিক্ত লবণকে বের করে দিতে হলে পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় বের করতে হবে, সেক্ষেত্রে শরীরে পানির পরিমাণ কমে আসে। তাই মস্তিষ্কের প্ররোচনায় আমাদের এমন দৈত্যাকার তৃষ্ণা পায় লবণাক্ত পানি পানের পর।
মানবদেহের কোষগুলো একটি পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে যাকে সেল মেমব্রেন অথবা কোষঝিল্লী বলা হয়। দেহে যখন লবণ প্রবেশ করে তখন সেই লবণ যাতে কোষের অভ্যন্তরে ঢুকতে না পারে সেই ব্যাপারটি নিশ্চিত করে কোষঝিল্লী। এমন নয় যে, আমাদের শরীরে লবণ উপস্থিত নয়, একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত লবণ আয়নিত অবস্থায় বিরাজ করে। শরীরের হোমিওস্ট্যাসিস ব্যবস্থা সর্বদা সাধারণ অবস্থা বজায় রাখতে চেষ্টা করে ফিডব্যাক মেকানিজমের মাধ্যমে। কিন্তু শরীরে যখন লবণের উপস্থিতি বেড়ে যায়, তখন আর সেটা সামলানো সম্ভব হয় না। কোষঝিল্লী অর্ধভেদ্য পদার্থের হওয়াতে যদিও যুগপৎভাবে কোষের ভেতরে এবং বাইরে সহজেই কোনোকিছু যাতায়াত করতে পারে না, কিন্তু কোষের বাইরে থেকে ভেতরে পানি প্রবেশ করতে পারে সহজেই। কোষের বাইরে যখন লবণের ঘনত্ব বেড়ে যাবে, সেই ঘনত্ব কমিয়ে আনতে শরীর যখন পর্যাপ্ত পানি পাবে না, তখন কোষঝিল্লী ভেদ করে কোষের সাইটোপ্লাজমে উপস্থিত পানি বেরিয়ে আসতে শুরু করবে যা আমাদের শরীরের জন্য খুব একটা সুখকর ঘটনা নয়। এমনটি হলে কোষগুলো পানি হারিয়ে ধীরে ধীরে চুপসে গিয়ে কোষের জৈবিক কার্যাবলী ব্যাহত হবে। স্কুলে থাকাকালীন সময়ে লবণাক্ত পানিতে আঙুর রেখে আঙুরের চুপসে যাওয়ার এক্সপেরিমেন্টটি পর্যবেক্ষণ করেছেন নিশ্চয়ই।
পুরো ঘটনাটি ঘটছে কোষের বাইরে লবণ-পানির ঘনত্ব কোষের ভেতর থেকে বেড়ে যাওয়ায়। অর্ধভেদ্য কোষঝিল্লী দিয়ে কম ঘনত্ব থেকে বেশি ঘনত্বের দিকে অসমোসিস প্রক্রিয়ায় ছুটে আসছে পানি, দুই পাশের ঘনত্বকে সমান করতে। এই অবস্থা এড়াতে হলে অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে মিঠাপানি পান করতে হবে আপনাকে। তাহলেই সঙ্গে সঙ্গে দেহে লবণের ঘনত্ব স্বাভাবিক হয়ে এসে কোষের অভ্যন্তরীণ ঘনত্বের তুলনায় কমে যাবে। আর আমরা যখন মিঠাপানি পান না করি, শরীর নিজেই তখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে বৃক্কের মাধ্যমে পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় আয়নিত লবণকে বের করে দিতে শুরু করে। আমরা যেটুকু পানি পান করি, তার থেকে অধিক পরিমাণ পানি শরীর থেকে মূত্রের মাধ্যমে বেরিয়ে যায় তখন। ফলে শরীরে দেখা দেয় পানিশূন্যতা কিংবা ডিহাইড্রেশন।
সামান্য লবণাক্ত পানি পানে হয়তো মারাত্মক কোনো অবস্থার সৃষ্টি হবে না, কিন্তু সেই পানকৃত পানির পরিমাণ যদি অত্যধিক হয় যা শরীরের পক্ষে সামলে ওঠা ভার, আর আপনিও যদি মিঠাপানি পানের মাধ্যমে তৃষ্ণা নিবারণ না করেন, তাহলে শরীরে স্বাভাবিক কার্যাবলীতে বড় ধরনের এক পরিবর্তন আসে। শরীরের অতিরিক্ত পানিশূন্যতাকে সামাল দিতে শরীর তখন হৃৎপিন্ডের গতিকে ত্বরান্বিত করে তোলে। সেই সাথে রক্তনালিগুলোকে তুলনামূলক ছোট করে ফেলে, যার দরুণ রক্তচাপ এবং প্রধান প্রধান অঙ্গগুলোতে রক্তের প্রবাহ কমে যায়। এই অবস্থা যদি বিরাজমান থাকে তবে বিষয়টি আর সহজ পর্যায়ে থাকবে না। অন্য অঙ্গগুলোর কথা বাদ দিয়ে কেবলমাত্র মস্তিষ্কের কথা বলি। মস্তিষ্কে যদি অক্সিজেন না পৌঁছায়, খুব দ্রুতই মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটতে পারে। মস্তিষ্ক নিজের জন্য যে পরিমাণ অক্সিজেন জমা রাখে তা দিয়ে প্রায় ৮ সেকেন্ড চালানো সম্ভব। অক্সিজেন যদি পরিমিত পরিমাণে না পায় মস্তিষ্ক, একজন মানুষ খুব দ্রুতই কোমায় চলে যেতে পারে। ফলে শরীরের অন্য সব অঙ্গের কার্যাবলী ব্যাহত হতে পারে।
ফিচার ইমেজ: howstuffworks.com