শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিনসমূহ

বলা হয়ে থাকে, এই পৃথিবীতে সবথেকে অসহায় হলো একটি শিশু। প্রকৃতি বরাবরই শিশুর প্রতি বিরূপ আচরণ প্রদর্শন করে থাকে। সবথেকে অনিরাপদ অবস্থায় পড়ে থাকে একটি শিশু। গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীর থেকে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অর্জিত হয়। এর জোরেই সন্তানটি পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়, সবকিছুতে জীবাণু রয়েছে আক্রমণ করার জন্য। আপনি যে ডিভাইসে হাত রেখে পড়ছেন এই লেখাটি, সেই ডিভাইসের পৃষ্ঠতলে অসংখ্য অণুজীব আছে। কিন্তু এরা আপনার শরীরে প্রবেশ করলেও কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, নাহয় এতক্ষণে ক্ষতি যা হবার হয়েই যেতো। আপনার শরীর এই অণুজীবের বিরুদ্ধে পেরে উঠছে। তবে শিশুটির বিরুদ্ধে কিন্তু বিজেতা হিসেবে আক্রমণ করেই বসবে। তাই একটি শিশুর জন্মের পর সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়, নিয়মানুযায়ী ভ্যাক্সিনেশনের ব্যবস্থা করতে হয়। কেবলমাত্র অজ্ঞতার দরুন আমাদের দেশে আজও মানুষকে নানা ভ্যাক্সিন দেয়া হয় না।

একজন ব্যক্তি একদিন আবিষ্কার করে যে, তার হেপাটাইটিস হয়েছে। হেপাটাইটিস হবার পর ভ্যাক্সিন কোনো কাজে আসবে না। যদি আক্রান্ত হবার আগে কোনো একসময়ে হেপাটাইটিস ভ্যাক্সিন দেয়া থাকতো, তাহলে আর হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হতে হতো না।

এই লেখাটির মূল উদ্দেশ্য ভ্যাক্সিনেশনের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে বলা। সেই সাথে একটি শিশুর কী কী ভ্যাক্সিন নিশ্চিত করতে হবে সেই ব্যাপারে জানানো। কখনো কখনো বাবা-মায়ের ভুলে যাবার কারণে একটি শিশুকে ঠিক সময়ে ভ্যাক্সিন দেয়া হয় না, কিংবা যথাসময়ে ভ্যাক্সিনের কোর্স পূর্ণ করা হয় না।

কিছু ভ্যাক্সিন রয়েছে যা একটি শিশুকে না দিলেই নয়, এই ভ্যাক্সিনগুলো হলো বিসিজি, ডিপিটি, হেপাটাইটিস বি, হিমোফিলিয়াস ইনফ্লুয়েঞ্জা বি, পিসিভি, ওপিভি, এমআর ও মিজেলস ভ্যাক্সিন। এই সবগুলো ভ্যাক্সিন প্রদানের মাধ্যমে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণ অণুজীবগুলোর বিরুদ্ধে একটি শিশুর দেহে সুন্দর প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশে সবগুলো ভ্যাক্সিন বিনামূল্যে প্রদান করা হয়, যেকোনো সরকারী হাসপাতাল কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আপনি এই ভ্যাক্সিনগুলো আপনার সন্তানকে দেয়াতে পারবেন। এমনকি বেসরকারী হাসপাতালেও আপনাকে এই ভ্যাক্সিনগুলো বিনামূল্যে দেয়া হবে, তবে ভ্যাক্সিন প্রদানের চার্জ রাখা হবে।

প্রধান ভ্যাক্সিনগুলোর সময়সীমা

বয়সকাল সুপারিশকৃত টিকা
জন্মের একমাসের মধ্যে BCG, OPV (শূন্যতম ডোজ)
৬ সপ্তাহ বয়সে DPT (প্রথম ডোজ), OPV (প্রথম ডোজ)
১০ সপ্তাহ বয়সে DPT (দ্বিতীয় ডোজ), OPV (দ্বিতীয় ডোজ)
১৪ সপ্তাহ বয়সে DPT (তৃতীয় ডোজ), OPV (তৃতীয় ডোজ)
৯ মাস বয়সে MR (বুস্টার ডোজ)
১৮ মাস বয়সে DPT (বুস্টার ডোজ), OPV (বুস্টার ডোজ)
৫-৬ বছর DT
১০-১৬ বছর TT

Source: aponjon.com.bd

এছাড়াও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে আরো কিছু ভ্যাক্সিন দেয়া যেতে পারে, যেগুলো পেতে হলে আপনাকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা গুণতে হবে। এগুলোর মাঝে রয়েছে রোটাভাইরাস, চিকেনপক্স, হেপাটাইটিস এ, টাইফয়েড এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাক্সিনগুলো।

Source: aponjon.com.bd

সময়মতো ভ্যাক্সিনগুলো না দেয়া হলে, আপনার সন্তানের দেহে এই রোগগুলো যেকোনো সময়েই আক্রমণ করতে সক্ষম। আর সংক্রমণ হবার পরপরই সন্তানকে কাবু করে ফেলবে যেকোনো অণুজীব। প্রথমেই বলা হয়েছে একটি শিশু প্রকৃতির মাঝে সবথেকে অনিরাপদ। সামান্য সর্দি হয়তো আপনার-আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, কিন্তু একটি শিশুকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছাড়বে। তাই আপনার সন্তানের ভ্যাক্সিনেশন নিয়ে দেরি করবেন না, সময়মতো ভ্যাক্সিনেশন নিশ্চিত করবেন। বেশ কিছু ভ্যাক্সিনের ডোজ বয়সভেদে বিভিন্ন সময়ে দিতে হয়। এই ব্যাপারেও ত্রুটি না করে নির্ধারিত বয়সে সবগুলো ডোজ প্রদানের চেষ্টা করবেন। সন্তান মোটামুটিভাবে সাত-আট বছর বয়সী হয়ে গেলে আমরা আর গুরুত্ব দিয়ে বাকি ডোজগুলো দিই না, ভুলে যাই। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে এমনটা করা অনুচিত।

বিনামূল্যে যে ভ্যাক্সিনগুলো নিশ্চিত করা হয়, সেগুলো সম্পর্কে এখন বিস্তারিত বলা যাক।

বিসিজি ভ্যাক্সিন

এই ভ্যাক্সিনটি যক্ষার বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে থাকে। যক্ষা রোগটি খুবই মারাত্মক এক ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়। প্রধানত ফুসফুসে এর সংক্রমণ ঘটে থাকে। এছাড়া শরীরের অন্যান্য অংশেও যক্ষার ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে বসতে পারে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই একটি শিশুকে বিসিজি ভ্যাক্সিন দিতে হয়। যদি কোনোভাবে দেয়া সম্ভব না-ও হয়, তবে যত দ্রুত সম্ভব, শিশুর ছয় সপ্তাহ পূর্ণ হবার পূর্বেই নিশ্চিত করা ভালো।

পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাক্সিন

ডিপথেরিয়ার জন্য দায়ী ব্যকটেরিয়া; Source: Keywordsuggest.org

পার্টাসিসের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া; Source: kbia.org

টিটেনাসের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া; Source: gettyimages.com

ডিপিটি (ডিপথেরিয়া, পার্টাসিস, টিটেনাস), হেপাটাইটিস বি ও হিমোফিলিয়াস ইনফ্লুয়েঞ্জা বি- এই পাঁচটি ভ্যাক্সিনকে একত্রে বলা হয় পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাক্সিন। ডিপথেরিয়া হয়ে থাকে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে। এই ব্যাকটেরিয়া মূলত নাক ও গলাতে আক্রমণ করে থাকে। পার্টাসিসকে আপনারা চেনেন হুপিং কাশি হিসেবে। হেপাটাইটিস বি এর ব্যাপারে আশা করি সকলেরই জানা আছে। এর প্রধান লক্ষণ হলো জন্ডিস। হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রধানত আক্রমণ করে লিভারে। আর হিমোফিলিয়াস ইনফ্লুয়েঞ্জা মূলত হয়েই থাকে শিশুদের। প্রাপ্তবয়স্কদের দেহে এই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারে না। রইলো বাকি টিটেনাস, এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো ধনুষ্টংকার। আপনারা সকলেই জানেন, ধনুষ্টংকার খুবই মারাত্মক এক রোগ। এই রোগে খিঁচুনী দেখা দেয় এবং মেরুদন্ডের হাড়গুলো ক্ষয়ে যেতে শুরু করে।

হেপাটাইটিস ভ্যাক্সিন কোর্স

হেপাটাইটিস বি ভাইরাস; Source: virology.wisc.edu

হেপাটাইটিস এ (শিশু) ১ থেকে ১৫ বছর বয়সের ভেতর ভ্যাক্সিনটি প্রদান করতে হয়, ভ্যাক্সিন প্রদানের ছয় মাস পর একটি বুস্টার ডোজ দিতে হয়।
হেপাটাইটিস এ (প্রাপ্তবয়স্ক) ১৫ বছর বয়সের পর যেকোনো সময় দেয়া যেতে পারে, ভ্যাক্সিন প্রদানের ৬-১২ মাস পর একটি বুস্টার ডোজ প্রদান করতে হয়।
হেপাটাইটিস বি (শিশু) ১ম ডোজ: শিশু অবস্থায় ছয় সপ্তাহ পূর্ণ হবার পর যেকোনো সময় দেয়া যাবে।

২য় ডোজ: প্রথম ডোজের ১ মাস পর।

৩য় ডোজ: প্রথম ডোজের ৬ মাস পর।

হেপাটাইটিস বি (প্রাপ্তবয়স্ক) ১ম ডোজ: যেকোনো সময় দেয়া যাবে।

২য় ডোজ: প্রথম ডোজের ১ মাস পর।

৩য় ডোজ: প্রথম ডোজের ২ মাস পর।

৪র্থ ডোজ: প্রথম ডোজের ১২ মাস পর।

হিমোফিলিয়াস ইনফ্লুয়েঞ্জা

১ম ডোজ ৬ সপ্তাহ থেকে ৬ মাস বয়সসীমার মাঝে দিতে হয় ১-২ মাসের ব্যবধানে মোট ৩টি ইঞ্জেকশন দিতে হয়। এগুলো শেষে এক বছর পর একটি বুস্টার ডোজ দিতে হয়।
২য় ডোজ ৬ মাস থেকে ১২ মাস বয়সসীমার মাঝে দিতে হয় ১-২ মাসের ব্যবধানে মোট ২টি ইঞ্জেকশন দিতে হয়। এগুলো শেষে এক বছর পর একটি বুস্টার ডোজ দিতে হয়।
৩য় ডোজ ১ বছর থেকে ৫ বছর বয়সসীমার মাঝে দিতে হয় এক বছর পূর্ণ হবার পর একটি ইঞ্জেকশন দিতে হয়।

পিসিভি

নিউমোনিয়ার পেছনে দায়ী ব্যাকটেরিয়া; Source: theindependent.sg

নিউমোকক্বাল কনজুগেট ভ্যাক্সিন; এই ভ্যাক্সিনটি দেয়া হয় শিশুদের নিউমোনিয়া প্রতিরোধে। লেখার মাঝে বলা হয়েছে যে আপনার-আমার সামান্য সর্দিটাও শিশুদেরকে একেবারে মৃত্যুর দুয়ারে নিয়ে যেতে পারে। আর এখানে নিউমোনিয়ার মতো প্রাণঘাতী রোগ থেকে শিশুকে বাঁচাতে হবে। নিউমোনিয়াতে একটি শিশুর পুরো শ্বসনতন্ত্র অকেজো হয়ে যেতে পারে।

বয়স যদি ২ বছরের উর্ধ্বে থাকে ২ থেকে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত একটি মাত্র ডোজ। ৬৫ বছর বয়সের পর প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর একটি করে বুস্টার ডোজ দিতে হয়।
বয়স যদি ২ বছরের কম থাকে ২-৬ মাস: দু’মাস অন্তর অন্তর তিনটি ডোজ এবং ১২-১৫ মাসের ভেতর একটি বুস্টার ডোজ

৭-১১ মাস: তিনটি ডোজ দিতে হয় মোট; প্রথম দু’টি ডোজ দিতে হয় ১ মাস অন্তর, তৃতীয়টি দিতে হয় দ্বিতীয় ডোজটি দেবার দু’মাস পর, যাতে এক বছর পূর্ণ হয়ে যায়

১২-২৩ মাস: ২ মাসের ব্যবধানে দুটি ডোজ দিতে হয়

≥ ২৪ মাস: একটি ডোজ

ওপিভি

পোলিও ভাইরাস; Source: virology.wisc.edu

ওরাল পোলিও ভ্যাক্সিন; পোলিও ভাইরাসের সংক্রমণে মাংসপেশি দুর্বল হয়ে গিয়ে শিশুর দেহে প্যারালাইসিস তৈরি করে, বিশেষ করে পায়ের মাংসপেশিতে আক্রমণ করে। ফলে সারা জীবনের জন্য হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে বসে একটি শিশু।

এমআর

এই ভ্যাক্সিনটি মিজেলস ও রুবেলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করে থাকে। এ দুটোই মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে এই দুটো ভাইরাস। তাই এর বিরুদ্ধেও একটি শিশুর দেহে অতিসত্ত্বর প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে হয়।

আরেকটি ভ্যাক্সিন কোর্সের ব্যাপারে বলা যাক। ভ্যাক্সিনটি হলো টিটেনাস টক্সোয়েড (টিটি)। ১৫-৪৯ বছর বয়স পর্যন্ত এই ভ্যাক্সিনটির পাঁচটি ডোজ মহিলাদের দেয়া হয়। পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাক্সিনে যে টিটেনাস ভ্যাক্সিন ছিলো সেটি মহিলাদের নিজ শরীরের জন্যে। পরবর্তীতে ১৫-৪৯ বছর বয়সসীমার মাঝে দেয়া হয় গর্ভাবস্থার সন্তানের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে। গর্ভাবস্থায় সন্তান টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে এটি নিয়েই জন্মগ্রহণ করতে পারে। ৪৯ বছর বয়সে মোটামুটিভাবে একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মহিলার মেনোপজ এসে যায়, যার দরুণ এরপর আর প্রয়োজন পড়ে না। এই বয়সসীমার মাঝে মোট পাঁচটি ডোজ প্রদান করতে হয়, যা সচেতনতার অভাবে আমাদের দেশে অনেকেই গুরুত্বের সাথে নেন না। একজন গাইনোকোলজিস্টের সাথে পরামর্শ করে এই বয়সসীমার মাঝে সকলেরই টিটেনাস টক্সোয়েড ভ্যাক্সিন গ্রহণ করা উচিত।

টিটেনাস টক্সোয়েড

প্রথম ডোজ ১৫ বছর বয়সের পর যেকোনো সময় দেয়া যায়
দ্বিতীয় ডোজ প্রথম ডোজের ২৮ দিন পর দিতে হয়
তৃতীয় ডোজ দ্বিতীয় ডোজের ৬ মাস পর দিতে হয়
চতুর্থ ডোজ তৃতীয় ডোজের এক বছর পর দিতে হয়
পঞ্চম ডোজ চতুর্থ ডোজের একবছর পর দিতে হয়

দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মজবুত করে তুলতে ভ্যাক্সিনেশনের বিকল্প নেই। তাই নিজে সচেতন হোন, মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করুন। সচেতনতার অভাবে দেরী হয়ে গেলে তখন কোটি টাকা খরচ করেও হয়তো আপনার সন্তানকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন না।

ফিচার ইমেজ: youtube.com

Related Articles

Exit mobile version