ক্রমবর্ধমান পানি সমস্যার সমাধান খুঁজতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে বিশ্ববাসী। কোথাও বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির সংকট, কোথাও নেই পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ। বাংলাদেশেরই অনেক অঞ্চলে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির অভাবে নানা রকম পানিবাহিত রোগে ভুগছে মানুষজন। এরই মাঝে নতুন মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছে করোনাভাইরাস।
যেখানে পর্যাপ্ত খাওয়ার পানিরই সন্ধান মিলছে না, সেখানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে দেশবাসীর উপর। কারণ করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকার প্রধান প্রতিরোধক হলো নিয়মিত পরিষ্কার থাকা, যার জন্য দরকার পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ। কিন্তু দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন শহরাঞ্চলের মানুষদের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা অনেকক্ষেত্রে কষ্টসাধ্য ও ব্যয়সাপেক্ষ।
এরকম পরিস্থিতিতে স্বল্প খরচে বিশুদ্ধ পানি উৎপাদনের কথা মাথায় রেখে শুরু থেকেই কাজ করে যাচ্ছিলো বাংলাদেশ স্টকহোম জুনিয়র ওয়াটার প্রাইজ। ২০২০ সালের এই আয়োজন বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেকটা বাধার সম্মুখীন হলেও, সীমিত পরিসরে আয়োজনের মধ্য দিয়ে ঠিকই বের করে আনা সম্ভব হয়েছে এবারের ক্ষুদে পানি বিজ্ঞানীর।
প্রতিবছর মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে হাউজ অফ ভলান্টিয়ার্স এবং ওয়াটার এইড বাংলাদেশ যৌথভাবে আয়োজন করে থাকে বাংলাদেশ স্টকহোম জুনিয়র ওয়াটার প্রাইজ। এবারের ষষ্ঠতম সংস্করণে আয়োজনে পেয়েছিলো ভিন্নমাত্রা। এবারই প্রথমবারের মতো বিভিন্ন স্কুল এবং কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ‘শিক্ষার্থী প্রতিনিধি’ নির্বাচন করা হয়। তাদের বিভিন্ন প্রচারণামূলক কার্যক্রম ক্ষুদে বিজ্ঞানী সন্ধানের কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাউজ অব ভলান্টিয়ার্সের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা এবং স্কুল ও কলেজ থেকে নির্বাচিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা মিলে সারা বাংলাদেশের মোট ৪৫টি স্কুল ও কলেজে প্রচারণা কার্যক্রম চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় জানুয়ারি ২০২০ এ বাংলাদেশ স্টকহোম জুনিয়র ওয়াটার প্রাইজের প্রথম মেন্টরিং সেশনে মোট ৯৫ জন আগ্রহী ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা উপস্থিত হয়।
এ সকল আগ্রহী ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় এবারের আসরে উঠে আসে মোট ২৩টি দারুণ প্রজেক্ট, যার মধ্য থেকে ৮টি প্রজেক্ট নির্বাচিত হয় ফাইনাল রাউন্ডে প্রতিযোগিতা করার জন্য। করোনা পরিস্থিতির কারণে এবারের ফাইনাল রাউন্ডের আয়োজন অনলাইন মাধ্যমে। ২৪ এপ্রিল ফাইনাল রাউন্ড অনুষ্ঠিত হওয়ার পর উঠে আসে এবারে আসরে বিজয়ীদের নাম।
দারুণ সব প্রজেক্টকে পিছনে ফেলে এবারের আসরে বিজয়ী হয় মাস্টারমাইন্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের আদিত্য কুমার চৌধুরী এবং ইফতেখার খালেদ। তাদের প্রজেক্টের বিষয় ছিল পানি বিশুদ্ধকরণে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত পলি গ্লুটামিক অ্যাসিড ব্যবহার। এই প্রজেক্টের মূল বিষয়বস্তু হলো প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত পলি গ্লুটামিক অ্যাসিড এর সাথে মরিঙ্গা ওলিফেরা (সজনে বীজ) মিশিয়ে পাউডার তৈরি করা হয় যা অল্প খরচে পানির ময়লা এবং ব্যাক্টেরিয়া হ্রাস করতে সহযোগিতা করে।
সেই সাথে স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ের ১৫ জন শিক্ষার্থী প্রতিনিধির মাঝে সেরা প্রতিনিধি নির্বাচিত হয় রংপুরের পুলিশ লাইন্স স্কুল এবং কলেজের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সোহেদুজ্জামান বসুনিয়া।
ফাইনাল রাউন্ডে বিচারকমণ্ডলীর মাঝে উপস্থিতি ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তানভির আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক ড. ফেরদৌস সারওয়ার, সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহিদুস সামাদ খান, সহযোগী অধ্যাপক ড. শেখ মখলেসুর রহমান, ESOLVE International এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ড. আসিফ এম জামান, ওয়াটার এইড বাংলাদেশের টেকনিক্যাল পরামর্শক মোহাম্মদ গোলাম মুক্তাদির এবং ইউনিসেফের ওয়াশ স্পেশালিস্ট মনিরুল আলম।
এবারের বিজয়ী প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ কার্যকারিতা নিশ্চিতে তাদের সাথে কাজ করে যাবে টেক্সটাইল শিল্পবিষয়ক গবেষণা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ESTex। সেইসাথে ৮টি ফাইনালিস্ট দলকে সাথে নিয়ে এবারই প্রথমবারের মতো একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুর হবে, যার পুরো দেখভাল করবে ESTex। অবশ্য এর জন্য আগে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া জরুরি।
সীমিত পরিসরেই এবার বাংলাদেশ স্টকহোম জুনিয়র ওয়াটার প্রাইজের জাতীয় রাউন্ডের আয়োজন শেষ হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিশ্বের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে আগস্টের বিশ্ব পানি সপ্তাহে সুইডেনে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে আদিত্য কুমার চৌধুরী এবং ইফতেখার খালেদ। তাদের জন্য রইলো শুভকামনা।