সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ কত কী আবিষ্কার করে চলেছে! তার কোনোটি কাজের, কোনোটি হয়তো অকাজের। প্রাচীন কালের বহু আবিষ্কার দিনে দিনে উন্নত হয়ে আজও পৃথিবীতে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার এমন কিছু আবিষ্কার রয়েছে যা এক কালে ব্যবহৃত হতো কিন্তু ধীরে ধীরে তা কালের গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে। সেসব হারিয়ে যাওয়া আবিষ্কারের মধ্যে এমন কিছু আবিষ্কার রয়েছে যার সমতুল্য কিছু বর্তমান বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমেও বিজ্ঞানীরা এখনো তৈরি করতে পারেননি। চলুন আজকে জেনে নিই তেমন কিছু রহস্যময় ও চমকপ্রদ আবিষ্কার সম্পর্কে।
গ্রিক ফায়ার
সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর কথা। সেসময় বাইজেন্টাইনদের ছিল এক অদ্ভুত প্রাণঘাতী অস্ত্র। নাম তার গ্রিক ফায়ার। গ্রিক ফায়ার হলো নানা রাসায়নিক মিশ্রিত এমন একটি তরল যা কিনা যেকোনো বস্তুর উপর পড়লেই তাতে আগুন ধরে যেত। তবে যে বৈশিষ্ট্যটি একে সবার থেকে আলাদা করেছিল তা হলো, এটি পানিতে পড়লে পানির উপরেও এটি জ্বলতে থাকতো। এই কারণে বাইজেন্টাইনরা সামুদ্রিক যুদ্ধগুলোতে এটি ব্যবহার করতো। একটি বিশেষ কামান বা পিচকারীর সাহায্যে এটি শত্রু বাহিনীর নৌবহরের উপর ছুঁড়ে দেওয়া হতো। ফলে মুহূর্তেই আগুন ধরে যেতো শত্রু নৌবহরে। এটি এমনই মারাত্মক ছিল যে, কোনোভাবেই এটি নিভানো সম্ভব হতো না। কেবলমাত্র সিরকা, বালি ও মূত্র দিয়ে এই আগুন নিভানো যেতো, কিন্তু আগুন নিভানোর মতো বিশাল পরিমাণে এসব জিনিস পাওয়া যেত না তখন।
সেসময় গ্রিক ফায়ার ছিল এক আতঙ্কের নাম। আর এই গ্রিক ফায়ারের প্রস্তুতপ্রণালীও ছিল গোপন। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এটিকে সামরিকভাবে কঠিন গোপনীয়তার মধ্যে প্রস্তুত করতো। হাতে গোনা অল্প কয়েকজন শুধু এটির প্রস্তুতপ্রণালী জানতো। এছাড়া এটি অনেকগুলো ধাপের মাধ্যমে প্রস্তুত করতে হতো। ফলে যারা এটি প্রস্তুত করতে জানতো তারা যখন মারা যায় তখন তাদের সাথে সাথে গ্রিক ফায়ারের প্রস্তুতপ্রণালীটিও হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে বহুবার এটি তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে কেউই এটি তৈরি করতে সক্ষম হননি।
নমনীয় কাঁচ
ইতিহাসে তিনটি স্থানে রহস্যময় একটি বস্তুর উল্লেখ পাওয়া যায়। বস্তুটির নাম হলো ‘vitrum flexile’, যার অর্থ হলো ‘নমনীয় কাঁচ’। সর্বপ্রথম এর উল্লেখ পাওয়া যায় ৬৩ খ্রিস্টাব্দের রোমান রাজসভাসদ পেট্রোনিয়াসের বক্তব্যতে।
তার লেখায় তিনি এক কাঁচের সামগ্রী প্রস্তুতকারীর কথা উল্লেখ করেন, যিনি সম্রাট টিবেরিয়াসের দরবারে একটি কাঁচের পাত্র নিয়ে আসেন। পাত্রটি রাজাকে উপহার দেওয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি সেটি আবার তাকে ফেরত দিতে বলেন। রাজা কাঁচের পাত্রটি তাকে ফেরত দিলে তিনি সেটি নিয়ে মাটিতে আছাড় মারেন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কাঁচের পাত্রটি ভেঙ্গে না গিয়ে একটু বেঁকে যায়। তিনি তৎক্ষণাৎ সেটি আবার পিটিয়ে সমান করে দেন। এই ঘটনা দেখে রাজা টিবেরিয়াস অবাক হয়ে যান। এমন জিনিসের প্রচলন ঘটলে মূল্যবান ধাতুগুলোর মূল্যহ্রাস পাবে ভেবে তিনি সেই আবিষ্কারককে শিরচ্ছেদ করার আদেশ দেন। ফলে সেই আবিষ্কারকের সাথে তার নমনীয় কাঁচ তৈরির প্রণালীটিও হারিয়ে যায়।
রোমান লেখক প্লিনি দি এল্ডারও এই গল্পটি উল্লেখ করেন। তবে এই গল্পটির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এর কয়েক হাজার বছর পর রোমান ইতিহাসবিদ ডিও ক্যাসিয়াস এই ঘটনা বর্ণনা করেন, তবে একটু ভিন্নভাবে। তিনি সেই আবিষ্কারককে জাদুকর হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, জাদুকরটি কাঁচের পাত্রটি ফেলে দিলে তা ভেঙ্গে যায়। কিন্তু তিনি খালি হাতেই আবার তা জুড়ে দেন।
বর্তমানে অবশ্য ২০১২ সালে ‘কর্নিং’ নামে একটি কাচ প্রস্তুতকারী কোম্পানি ‘উইলো গ্লাস’ নামের নমনীয় একধরণের কাচ উদ্ভাবন করেছে, যা তাপ প্রতিরোধক ও নমনীয়। সৌর বিদ্যুতের প্যানেলগুলো তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। তবে সেই দূর্ভাগা রোমান আবিষ্কারক কয়েক হাজার বছর আগেই কিন্তু এটি আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন।
সকল বিষের প্রতিষেধক
জানা যায়, ‘ইউনিভার্সাল এন্টিডোট’ বা সার্বজনীন প্রতিষেধক নামে পরিচিত রাসায়নিকটি আবিষ্কার করেছিলেন পন্টাসের রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডেটস। পরবর্তীতে এটিকে আরো সংস্কার ও উন্নত করেন সম্রাট নিরোর এক ব্যক্তিগত চিকিৎসক। স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকাচারবিদ্যার প্রভাষক ও বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ অ্যাড্রিয়েন মেয়র ২০০৮ সালে প্রকাশিত একটি লেখায় এটি সম্পর্কে নানা তথ্য উল্লেখ করেন। তিনি জানান, এই প্রতিষেধকের আসল প্রস্তুতপ্রণালীটি হারিয়ে গিয়েছে। তবে প্রাচীন ইতিহাসবিদদের থেকে জানা যায়, এটি বানাতে আফিম, টুকরো করে কাটা সাপ ও অল্প অল্প করে নানারকম বিষ ও তাদের প্রতিষেধক ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো।
এই অতি মূল্যবান পদার্থটি রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডেটসের নাম অনুসারে মিথ্রিডেটিয়াম নামে পরিচিত ছিল। অ্যাডিয়েন মেয়র জানান, সার্গুই পপোভ নামের সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন প্রাক্তন জৈব অস্ত্র গবেষক মিথ্রিডেটিয়ামের আধুনিক সংস্করণ তৈরির প্রচেষ্টায় আছেন।
তাপ-রশ্মি অস্ত্র
গ্রিক গণিতবিদ আর্কিমিডিসের কথা আমরা প্রায় সবাই জানি। তিনি পাইয়ের মান হিসাব করার মতো গণিতে অনেক অবদান রেখেছিলেন। তবে তিনি গণিতের পাশাপাশি আরো অনেক যন্ত্রও আবিষ্কার করেন। রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি নানা অস্ত্র তৈরিতে সাহায্য করেন। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে তিনি তাপ-রশ্মি ব্যবহার করে এক অস্ত্র তৈরি করেন। এটি ‘আর্কিমিডিসের মৃত্যু রশ্মি’ নামেও পরিচিত ছিল।
এই যন্ত্রটিতে অসংখ্য আয়না এমনভাবে লাগানো থাকতো যাতে সূর্য রশ্মি একত্রিত হয়ে এতটাই তীব্রভাবে প্রতিফলিত হতো যে তা দিয়ে সমুদ্রতীর থেকে ১,০০০ ফুট দূরে অবস্থিত রোমান জাহাজে নিমিষেই আগুন ধরিয়ে দেওয়া যেত। প্রাচীন ইতিহাসবিদ গ্যালেনের জানান, এই মৃত্যু রশ্মি সাইরাকসের রোমান অবরোধের সময় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এর তীব্র ও অরোধ্য রশ্মির আঘাত ধ্বংস হয়ে যায় শত শত জাহাজ। কিন্তু কিভাবে এটি তৈরি করা হতো তার সমস্ত প্রণালীটি হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে।
দামেস্কোর ইস্পাত
মধ্যযুগে তরবারি তৈরির জন্য একটি ভিন্ন ধরনের ইস্পাত ব্যবহৃত হতো। দামেস্কোর ইস্পাত নামে পরিচিত ছিল এটি। এই ইস্পাত তৈরি হতো মধ্যপ্রাচ্যে। এটি তৈরি করতে ‘উটজ স্টিল’ নামে একটি বিশেষ কাঁচামাল ব্যবহৃত হতো যা আসতো এশিয়া থেকে। এই বিশেষ ইস্পাতের তৈরি অস্ত্রগুলো হতো অসম্ভব মজবুত ও দৃঢ়। দামেস্কোর ইস্পাত দিয়ে তৈরি অস্ত্রগুলোর পাতে থাকতো বিশেষ একধরনের প্যাটার্ন। রহস্যময় বিখ্যাত এই ইস্পাতের তৈরি অস্ত্রগুলো হতো মারাত্মক ধারালো। অন্য যেকোনো সাধারণ তরবারি এই ইস্পাতের তৈরি তরবারির আঘাতে দু’টুকরা হয়ে যেতো। বলা হতো, এই তরবারি এত ধারালো ছিল যে এর উপর মানুষের একটা চুল রাখলেও সেটি মাঝ থেকে কেটে দু’টুকরা হয়ে যেত। কারো কারো মতে, এ ইস্পাতে নির্মিত তরবারিগুলো আক্ষরিকভাবেই ভাঙ্গা অসম্ভব ছিল।
এই ইস্পাতের অসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে এটি ছিল খুব দুর্লভ। খুব কম সংখ্যক অস্ত্রের কারিগর এই ইস্পাত তৈরির নিয়ম জানতো। তৎকালীন সময়ে কড়া পাহারায় ও গোপনীয়তায় এই ইস্পাত তৈরি করা হতো। ফলে সেই কারিগরা যখন মারা যায় তখন দামেস্কোর ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়াটিও হারিয়ে যায়। তবে দামেস্কোর ইস্পাতের তৈরি কিছু অস্ত্র গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন। যা গবেষণা করে দেখা গিয়েছে বিশেষ এই ইস্পাত কয়েকটি বিশেষ গাছের ছাল, রস ও তার সাথে ভ্যানাডিয়াম, ক্রোমিয়াম, ম্যাংগানিজ, কোবাল্ট, নিকেল ও ভারত থেকে আগত দূর্লভ কিছু ধাতুর সংমিশ্রণে তৈরি করা হতো। তবে এত কিছুর পরও এখনো পর্যন্ত রহস্যময় সেই দামেস্কোর ইস্পাত পুনরায় তৈরি করতে সক্ষম হননি কেউই।
ফিচার ইমেজ – periklisdeligiannis.com