প্রতি বছরই ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক সেই বছরে স্বাস্থ্যখাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করে। কিন্তু এই ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের তালিকা এত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় কেন? কারণ, ২০০টি স্থানে ৬৫,০০০ সেবাদানকারীর মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষকে সার্ভিস প্রদান করা এই সেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অত্যন্ত নামকরা। ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টের বার্ষিক সেরা হাসপাতালের তালিকাতেও তাদের স্থান নিয়মিতই উপরের সারিতে থাকে। এহেন ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক যখন কোনো কিছুকে বড় মাপের অগ্রগতি হিসেবে আখ্যা দেয় তখন সেটা আসলেই বড় বটে!
ঠিক কীভাবে তালিকা ঠিক করে তারা? এজন্য কাজ করেন বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি। কমিটির বর্তমান প্রধান ড. জিওফ্রে ভিন্সের মতে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নতুন অগ্রগতির ব্যাপারে তীক্ষ্ণ নজর থাকে তাদের, এবং যদি মনে হয় সেটা ভবিষ্যতে চিকিৎসার ব্যাপারে বড় রকম পরিবর্তন আনতে চলেছে, তাহলেই কেল্লাফতে!
ঠিক কোন জিনিসগুলো স্থান পেয়েছে ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের তালিকায়? চলুন একটু নজর বুলিয়ে আসি।
এমআরএনএ ভ্যাক্সিন
এমআরএনএ ভ্যাক্সিন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছিল আগে থেকেই, কোভিড অতিমারি একে ত্বরান্বিত করেছে মাত্র। কোভিডের সময় দরকার ছিল দ্রুত ভ্যাক্সিন বাজারজাতকরণের। প্রচলিত নিয়মে ভ্যাক্সিন তৈরি করা বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ, সেখানে এমআরএনএ টিকা তুলনামূলক সহজে ও দ্রুততার সাথে উৎপাদন করা যায়। কোভিড নিয়ন্ত্রণে সফলতার পর ভবিষ্যতে এই ধরনের টিকার ব্যবহার যে আরো বৃদ্ধি পাবে সেটা বলাই বাহুল্য।
প্রোস্টেট ক্যান্সারের নতুন চিকিৎসা
পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যান্সার একটি বড় সমস্যা। ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে একে নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। জিন থেরাপি (PSMA-targeted therapy) এক্ষেত্রে আশার আলো দেখাচ্ছে। নিউক্লিয়ার মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে- গবেষণার অংশ হিসেবে যাদের এই চিকিৎসা দেয়া হয়েছে তাদের রোগ শতকরা ৯০ ভাগ ইতিবাচক ফলাফল দেখিয়েছে। প্রিটোরিয়া ইউনিভার্সিটির নিউক্লিয়ার মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের প্রধান ড. মাইকের (Mike Sathekge) মতে, প্রোস্টেট ক্যান্সার রোগীদের জন্য এই চিকিৎসা নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ
রক্তে কোলেস্টেরল অনেক বেশি? প্রতিদিন একটি/দুটি করে ট্যাবলেট গিলতে হয়? তাহলে মাঝেমধ্যে ওষুধ খেতে ভুলে যাননি এমন মানুষ পাওয়া দুর্লভ! তাদের জন্য সমাধান হতে পারে নোভার্টিসের ইনক্লিসিরান (inclisiran) নামে একটি ওষুধ। ডিসেম্বর মাসেই ইউএস এফডিএ এর অনুমোদন দিয়েছে। জিন সাইলেন্সিং (সমস্যার জন্য দায়ী জিনকে দমিয়ে দেয়া) করে কাজ করে এমন ওষুধের মধ্যে সম্ভবত সর্বপ্রথম অনুমোদন পেলো এই ইনক্লিসিরান’ই। বছরে দু’বার নিতে হবে এই ওষুধ, তাহলেই নিয়ন্ত্রণে থাকবে কোলেস্টেরল। নোভার্টিসের সিইও ভাস নারাসিমহানের (Vas Narasimhan) মতে, হৃদযন্ত্রের অসুখের ঝুঁকি কমাতে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে ইনক্লিসিরান।
ডায়াবেটিসের নতুন ওষুধ
ইউএস এফডিএ টাইপ-টু ডায়াবেটিসের জন্য টিরজেপাটাইড (tirzepatide) অনুমোদন করেছে। এই ইঞ্জেকশন চামড়ার নিচে নিতে হবে সপ্তাহে একবার করে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এর ফলে রক্তে শর্করা তো কমবেই, এছাড়াও ওজনও ঠিক থাকবে। যেসব রোগীর ক্ষেত্রে কেবল খাবার এবং ব্যায়াম দ্বারা অসুখ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে (SURPASS-1) তাদের উপর টিরজেপাটাইডে’র কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে।
প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা
এই বিষয় নিয়ে অনেক সময়েই ব্যাপক আকারে আলোচনা হয়না, অথচ নতুন মা হয়েছেন এমন মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা মারাত্মক হতে পারে। এখন পর্যন্ত এর জন্য মনোচিকিৎসাই প্রধান অবলম্বন, তবে এখানে নতুন একটি ওষুধও যুক্ত হতে চলেছে। ব্রেক্সানোলোন নামে একধরনের ইঞ্জেকশনের অনুমোদন দিয়েছে ইউএস এফডিএ প্রায় দুই বছর আগে, যা কিনা কেবল চিকিৎসকের অধীনে থেকে দেয়া যাবে। সীমিত আকারে এর ব্যবহার চালু হয়েছে এই বছর, এবং আশাব্যঞ্জক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে।
হাইপারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি
এই রোগে হৃদপিণ্ডের মাংসপেশী স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি মোটা হয়ে যায়, ফলে ব্যহত হয় রক্ত সঞ্চালন। অনেকদিন এর চিকিৎসায় খুব কার্যকর কোনো ওষুধ ছিল না। ব্রিস্টল-মেয়ার-স্কুইবের আবিষ্কৃত ম্যাভাক্যামটেন (mavacamten) সেই পরিস্থিত পাল্টে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ইতোমধ্যে এর ভালো ফলাফলও মিলেছে। অন্যতম গবেষক ড. জন এ. স্পার্টাসের মতে, ম্যাভাক্যামটেন গ্রহণে রোগীদের মধ্যে অত্যন্ত ইতিবাচক উন্নতি আশা করা যায়।
পক্ষাগাতগ্রস্ত রোগীদের জন্য ইমপ্ল্যান্ট
স্পাইনাল কর্ডের আঘাতে শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেক। দীর্ঘদিন ফিজিক্যাল থেরাপির পর কেউ কেউ নিজেদের চলৎশক্তি কিছুটা ফিরে পান বটে, তবে অধিকাংশই পড়ে থাকেন বিছানায়। অনওয়ার্ড (ONWARD ) নামে একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান তাদের জন্য তৈরি করেছে একধরনের ডিভাইস। রোগীর শরীরে ইলেক্ট্রোড বসিয়ে এর দ্বারা অবশ হয়ে যাওয়া মাংসপেশীকে নতুন করে স্নায়ু সংকেত পৌঁছানো যায়। ন্যাচার মেডিসিনে প্রকাশিত প্রবন্ধে তিনজন এমন রোগীর ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে যারা এই ডিভাইস বসানোর একদিনের মধ্যে হাঁটতে পেরেছেন, মায়ো ক্লিনিকের ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট ডঃ মেগান গিলের মতে যা অভূতপূর্ব। এখনো বড় আকারে বাজারজাতকরণের জন্য প্রস্তুত না হলেও এফডিএ একে ব্রেকথ্রু ডিভাইস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০২৪ সালে বড় আকারে এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কথা রয়েছে।
সেপ্সিস নির্ণয়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার
সেপ্সিস মূলত রক্তে বিপুল পরিমাণে সংক্রমণ, যা কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের সেপ্সিসের ঝুঁকি বেশি, এবং একবার আক্রান্ত হলে এই রোগ জীবননাশের কারণ হতে পারে। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে যদি সেপ্সিস নির্ণয় করা যায় তাহলে চিকিৎসার সফলতার হার বেশি। এজন্য এআই ভিত্তিক অ্যালগরিদম ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রাথমিক ফলাফল কিন্তু বেশ আশাব্যঞ্জক।
মেনোপজের চিকিৎসা
নির্দিষ্ট বয়সের পর মহিলাদের মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে নানা রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যার জন্য চিকিৎসা নিতে হয়। এখন অবধি হরমোন দিয়ে চিকিৎসা করা হলেও সবার জন্য এই থেরাপি দেয়া যায় না, আবার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াও উপেক্ষা করার মতো নয়। এজন্য NK3R antagonists নামে নতুন কিছু ওষুধ ট্রায়াল দেয়া হয়েছে, যা বেশ ভালো ফল দিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এগুলো বাজারে এলে বহু মানুষের উপকার হবে।
উচ্চ রক্তচাপের জন্য আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স
উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনের রোগীদের জন্য ঠিক ওষুধ নির্ণয়ে প্রায়ই লম্বা সময়ের দরকার হতে পারে। বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করার পর দেখা যায় ঠিক কোনটি সেই রোগীর জন্য ভালো হবে সেটা বোঝা যায়। এক্ষেত্রে এআই ব্যবহার আরম্ভ হয়েছে, যার মাধ্যমে চিকিৎসক রোগীর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত চিকিৎসাপদ্ধতি ঠিক করতে পারেন। কেবল তা-ই নয়, এই রোগীর ভবিষ্যতে রক্তচাপ থেকে অন্যান্য আর কী কী সমস্যা হতে পারে সেটারও একটি পূর্বাভাস পাওয়া যায় এআই থেকে, ফলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব।