একটা চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে শুরু করা যাক, তিমির গান এতটাই অদ্ভুত যে নাসা ১৯৯৭ সালে এদের একটি প্রজাতি ‘হাম্পব্যাক’ এর শব্দের একটি রেকর্ড তৈরি করে এবং তা পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের অরবিটে পাঠায়। ‘ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড’ নামের ঐ রেকর্ডিংয়ে তিমির শব্দ ছাড়াও আরো ৫৪ ধরনের শব্দ ছিল যা পাঠানো হয় এলিয়েনদের সাথে পৃথিবীকে পরিচিত করতে!
তিমির গানের খোঁজ মিলল যেভাবে
তিমির শব্দ তৈরির ব্যাপারটির সাথে মানুষ পরিচিত হয়েছে এই অল্প কিছুদিন আগে। সর্বপ্রথম এ সম্পর্কে মানুষ জানতে পারে ফ্রাংক ওয়াটলিংটন নামের এর বারমুডিয়ান ভদ্রলোকের কল্যাণে। ফ্রাংক মার্কিন নেভির সোফার স্টেশনে হাইড্রোফোন সেকশনে কাজ করতেন। রাশিয়ান সাবমেরিনের আওয়াজ ভেবে তিনি একটি অদ্ভুত শব্দের সন্ধান পান যা পরবর্তীতে গবেষক রজার পেইন এবং স্কট ম্যাকভের দৃষ্টিগোচর হয়। পেইন ১৯৭০-এ তাদের সংগ্রহগুলো একত্র করে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেন যা বিশ্বজুড়ে ১ লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়। এরপর থেকে মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে তিমিদের ব্যাপারে।
তিমিদের জন্য শব্দ তৈরি কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ!
পানির উপর আর নিচের জগত সম্পূর্ণ আলাদা। আলো এবং গন্ধ যেখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না, শব্দই সেখানে মূল ভরসা। শব্দ বাতাসের তুলনায় পানিতে প্রায় ৪ গুণ বেশি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য প্রাণের অরণ্য এই সাগরতল তাই মূলত শব্দের এক প্রকান্ড ভান্ডার। তবে এই সুর বা শব্দ তৈরির দৌড়ে তিমিদের ধারে-কাছে কেউ নেই। পুরো প্রাণী জগতে তিমিদের এই যোগাযোগ ব্যবস্থা সবচেয়ে দুর্বোধ্য এবং ব্যতিক্রম। তবে শব্দ তৈরি করতে পারলেও খুব অল্প কিছু তিমির প্রজাতিই গান বাধতে জানে।
গায়ক তিমিদের প্রকারভেদ
গান বাধতে জানে এমন তিমিরা মূলত ‘বেলিন’ গোত্রভুক্ত। এদের মূল বৈশিষ্ট হচ্ছে এরা দাঁতের বদলে বিশালাকার বেলিন প্লেট ব্যাবহার করে যার উপাদান কেরাটিন। মানুষের চুল এবং নখের ও মূল উপাদান কিন্তু এই কেরাটিন। বেলিন গোত্রের উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হচ্ছে-
- ব্লু
- ফিন
- বোহেড
- মিঙ্কি
- হাম্পব্যাক
এরা বাদে অন্য প্রজাতির তিমিরাও শব্দ তৈরি করতে পারে। কিন্তু গান বাধবার মতো জটিল প্রক্রিয়া কেবল উপরের তালিকার তিমিদের দ্বারাই সম্ভব।
পানির নিচে শব্দ তৈরির রহস্য
স্থলজ আদি মেরুদন্ডীরা (মানে আমরা আর কী!) শব্দ তৈরি করতে ভোকাল কর্ড ব্যবহার করে। কিন্তু পানির নিচে শব্দ তৈরি মোটেও সহজ কাজ নয়। বেলিন প্রজাতির তিমিরা এই কাজটি করার জন্য ব্যবহার করে তাদের ‘U’ আকৃতির বিশেষায়িত টিস্যুকে। এটা তাদের ফুসফুস এবং লরেঞ্জেল স্যাকস নামক ফাপা প্রত্যঙ্গের মাঝে সংযোগ তৈরি করে।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, ফুসফুসের বাতাস এই ‘U’ আকৃতির ভালভে প্রবেশ যখন করে তখন শব্দ তৈরি হয়। বাতাস এই অংশ পার হয়ে যখন লরেঞ্জেল স্যাকসে প্রবেশ করে, তখন এর ভেতরের গঠনের জন্য সেই শব্দ অনুরণিত হয়ে বহু গুণে বাড়িয়ে দেয়। এই শব্দ এতই প্রবল যে প্রায় হাজার কিলোমিটার দূর থেকেও অন্য তিমিরা তা স্পষ্ট শুনতে পায়। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো- প্রতিবার এ রকমের সুর তৈরি করতে এদের বার বার শ্বাস নিতে হয় না, বরং লরেঞ্জেল স্যাকসের বাতাস আবার ভালভ হয়ে ফুসফুসে ফিরে আসে এবং এই ফিরে আসার সময়ও আবার মৃদু কিন্তু গম্ভীর শব্দ তৈরি করে।
সুর থেকে গান হয় যেভাবে
এই যে তিমির গান এতটা বিচিত্র, এর কারণ এর জটিল বিন্যাস। আমরা যদি এদের কান্না, চিৎকার, আর্তনাদ, হাসি এগুলোকে একেকটা শব্দ ধরে নেই, তিমিরা এসবের সমন্বয়ে একেকটা প্যাটার্ন তৈরি করে। আমরা একে বোঝার স্বার্থে বাক্য বলে ধরে নিতে পারি। এই বাক্যগুলো বিভিন্নভাবে সাজালে একটা কলি/বাক্যগুচ্ছের মতো তৈরি হয়। এরকম অনেকগুলো গুচ্ছের সম্মেলনে তৈরি হয় গান। হাম্পব্যাক প্রজাতির তিমি এ ধরনের গান প্রায় টানা ২২ ঘন্টা গাইতে পারে!
হাম্পব্যাক তিমির গানের বিন্যাস
তিমি কেন গান গায়!
পুরুষ তিমিরা প্রজনন মৌসুমে এ ধরনের গান গেয়ে বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করে থাকে। এছাড়াও অন্য পুরুষদের তাদের এলাকার বাইরে রাখতে এবং তথ্যের আদান-প্রদানেও এরা গানের সাহায্য নেয়। বিশেষ আনন্দ উদযাপনে কিংবা সামনে বিপদের আভাস পেলে দলের সব তিমিকে একত্রিত করতেও এটি ব্যবহৃত হয়। নারী তিমিরা এই গানের বুনন এবং শব্দবিন্যাস শুনে পুরুষদের আলাদা করতে পারে। ফ্রেজার এবং মারকেডো ২০০০ সালে একটি ‘হাইপোথিসিস’ প্রদান করেন কীভাবে তিমি তাদের গানকে ‘বায়োসোনার’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
তিমিদের সংস্কৃতি
তিমিদের সত্যিকার অর্থে বৈশ্বিক প্রাণী বলা চলে, কারণ এই প্রাণীটি পৃথিবীর প্রায় সব সাগরে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিচরণ করে থাকে। কিন্তু প্রজনন এবং সন্তান পালনের জন্য প্রতিটি প্রজাতি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় তাদের নির্দিষ্ট এলাকায় একত্রিত হয়। একই প্রজাতির বিভিন্ন পরিবারে গানের ধরন এবং দৈর্ঘ্য আলাদা হয়ে থাকে, এবং যখন এ রকম দুই বা ততোধিক পরিবার কাছাকাছি আসে, তখন এদের মধ্যে সুরের বিনিময় হয়। এই সুরের বিনিময়কে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত এবং কার্যকর সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান বলা যায়। এই আদান-প্রদান নতুন কোনো জলরাশিতে তাদের আচার-ব্যবহার, শিকারের কৌশল এবং টিকে থাকার উপায়ও বাতলে দেয়। তবে অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় এদের এই যোগাযোগ এতটাই শক্তিশালী এবং জটিল যে মানুষের পক্ষে এখন পর্যন্ত এর পূর্ণ পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি।
অতি বুদ্ধিমান এই প্রাণীর ভবিষ্যৎ
তিমির এই অপার্থিব সুর এবং এর থেকে মানুষের পাঠোদ্ধারের সম্ভাবনা দিনকে দিন ফিকে হয়ে আসছে আশংকাজনক হারে তিমির সংখ্যা কমে যাওয়াতে। এছাড়াও সাগরে মানুষের সৃষ্ট শব্দদূষণ তিমির স্বাভাবিক চারণক্ষেত্রগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে। তিমির ঝাঁক জাহাজ চলাচল বা সামরিক গবেষণা অথবা তেলসন্ধানী জাহাজগুলো থেকে অন্তত ১,২০০ মি. দূরে থাকতেই গান থামিয়ে দেয় এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে আবার গাইতে শুরু করে না। প্রচন্ড শব্দের কারণে এরা ভিন্ন পথে যাওয়ার চেষ্টা করে। আর এভাবেই এদের প্রাকৃতিক বিচরণ দিন দিন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এর থেকে উত্তরণের একমাত্র পাথেয় সমুদ্রে মানবসৃষ্ট দূষণ কমানো।