ধরুন, আপনি একটি পারিবারিক প্রোগ্রামে আছেন। সেখানে খাবার দাবার দেওয়া হয়েছে। পেছনে বাজছে পুরনো দিনের গান। এই ধরুন নব্বই দশকের গান। গান শুনে কেউ একজন বলে উঠলো- নাহ, এখন আর আগের মতো ভাল গান হয় না। অন্য সবাই তার সাথে একমত হলো। আসলেই তো, আগে কতো ভালো ভালো গান শুনতাম। এখন সে রকম গান কই, আর গায়কই বা কই? সমবেত জনতা একসাথে শোকসভা করতে লাগল।
সাময়িক শোকসভা শেষে একজন বলে উঠলো, ব্যাপারটা যে একদমই নতুন এমন কিন্তু না। এটা আগেও হয়ে এসেছে। এখনো হচ্ছে। সবাই জিজ্ঞেস করলো, কোন ব্যাপারটা?
লোকটি তখন খানিক গলা পরিষ্কার করে বলা শুরু করলো, এই যে আপনারা বলছেন নব্বই দশকে ভালো গান হতো। এখন আর হয় না। আপনি নব্বই দশকের একজন মধ্য তিরিশের ব্যাক্তিকে এই প্রশ্নটাই করুন। তিনি বলবেন, আশির দশকে চমৎকার চমৎকার সব গান হত। নব্বই তো বাংলা গানের অন্ধকার দশক। আশির দশকে কাউকে এই প্রশ্ন করলে তিনি বলবেন, সত্যিকার গান হতো সত্তরের দশকে। এরপরে যা এসেছে তার সবই তো ভূষিমাল।
আপনি আসলে নব্বই দশকের সেই গানগুলোই শোনেন যেগুলো কালের ছাকনীতে টিকে গেছে। নব্বইয়ে প্রচুর এ্যালবাম বের হয়েছে, প্রচুর শিল্পী গান গেয়েছে যাদের কাউকেই আমরা মনে রাখিনি। তারা কোথায় থাকেন, কী করেন, তাদের গানের কোনো কপি কোথাও আছে কিনা- কিচ্ছু জানি না। আমরা শুধু সফল গায়কদের মনে রেখেছি। তাদের গান রেকর্ডে বাজিয়ে চলেছি।
আপনার প্লে-লিস্টে হয়তো সেই দশকের ১০০টা গান আছে যা আপনি নিয়মিত শোনেন। কিন্তু সে সময় কম করে হলেও ১০ হাজারের মতো গান বেরিয়েছে। তার মানে কম আর বেশ ১% এর মতো গান দুই দশকে টিকে থাকতে পেরেছে। অথচ আমরা ভাবছি, সে সময়ের সব গানেই বুঝি একটা ক্লাস ছিল। খুব ক্ষুদ্র একটা অংশের সফলতাকে আমরা যে এভাবে বিশেষায়িত করি আর ব্যর্থদের বিরাট একটা অংশকে যে অনায়াসে ভুলে যাই, এই ব্যাপারটাকেই বলা হয় সারভাইবারশিপ বায়াস (Survivorship Bias)।
সারা শহরে জেমসের বড় বড় বিলবোর্ড দেখে দেশের প্রতিটি কিশোর যদি ভাবে, আমিও একদিন জেমস হবো, কিংবা মাশরাফিকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই যদি বই-খাতা ফেলে ক্রিকেট খেলা শুরু করে, এদের সবাই কি জেমস কিংবা মাশরাফি হতে পারবে? সম্ভাব্য জেমসদের একটা বড় অংশই মাদকের নেশায় হারিয়ে যাবে। পাড়ায় মহল্লায় বিয়ে এলাকার প্রোগ্রামে গান করে বেড়াবে।
সম্ভাব্য মাশরাফিদের বড় দলটা গ্রামে গঞ্জে খ্যাপ খেলে বেড়াবে। দুই-চার-পাঁচশো টাকা নিয়ে আয়োজকদের সাথে ঝগড়া করে ফিরবে। মাশরাফি আর জেমসদের পেছনের এই যে দলটা, যেখানে গোরস্থানের অন্ধকার বিরাজ করে দিনরাত, এই জগৎটার কথা প্রচার মাধ্যম আমাদের সামনে খুব একটা আনে না। লোকে সেটা খাবে না। পত্রিকাতেও বিকোবে না।
আপনি হুমায়ূন আহমেদকে দেখে ভাবছেন, এই লোক কী এমন লেখে যে এতো জনপ্রিয়তা পেল? চাইলে আমিও এরকম হতে পারবো। খোঁজ নিলে দেখবেন, একজন সফল হুমায়ূন আহমদের পেছনে আরো ১০০ জন এমন লেখক আছেন যাদের বই কখনো বিক্রি হয় না। তাদের পেছনে আরো ১০০ জন আছেন যারা প্রকাশকের অভাবে বই ছাপাতেই পারে না। এদের পেছনে ১০০ জনের আরো একটি দল আছে যারা কোনো একদিন একটা বই লেখার স্বপ্নই শুধু দেখেছে, এর বেশি কিছু করতে পারেনি। এই তিন দলের পেছনে থেকে আপনি ভাবছেন লেখক হওয়া তো খুব সহজ। লিখে সাফল্য পাওয়া যে কত কঠিন- সেটাকে গুরুত্বই দিচ্ছেন না।
এই গুরুত্ব না দেওয়াটা আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে করি, আর্থিক ক্ষেত্রে করি, সব ক্ষেত্রে করি। আপনার এক বন্ধুর কথা ভাবুন। সে খুবই ইতিবাচক আর আশাবাদী মানুষ। বেশ কর্মতৎপরও বটে। একজন উদ্যোক্তা হবার জন্য যা যা গুণ থাকা দরকার, সবই তার আছে। সবার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে সে ঠিক করলো একটা স্টার্টআপ কোম্পানি খুলবে। মনে মনে আশা, ঠিকঠাক এগোলে এটাই হবে পরবর্তী গুগল। সবার স্বপ্ন হবে এইখানে চাকরি করা।
এখন আসি বাস্তবতায়। কত পার্সেন্ট সম্ভাবনা আছে যে এই স্টার্টআপই হবে পরবর্তী গুগল? প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হচ্ছে সে কোম্পানিটি যাত্রাই শুরু করতে পারবে না। ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া, স্পেস ভাড়া নেয়া, উপযুক্ত কর্মী নিয়োগ দেওয়া ইত্যাদি ঝামেলা করতে করতেই সে হতাশ হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেবে। এরকম বহু উদাহরণ আছে।
এই ধাপে উৎরে গেলে পরের দৃশ্য হচ্ছে, তিন বছরের মধ্যে কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে পড়বে। তিন বছর যদি তারা টিকেও যায়, বেশিরভাগ কোম্পানি আর বড় হতে পারে না। দশজন কর্মীর একটা কোম্পানিতে আটকা পড়ে যায় তারা। আর উন্নতি হয় না তাদের। তার মানে কি এই যে সে কখনো ঝুঁকি নেবে না? নতুন কোনো উদ্যোক্তা আসবে না আমাদের বাজারে? তা নয়। নতুন উদ্যোক্তাদের শুধু এটা মাথায় রাখতে হবে, আমরা আমাদের চারপাশে যে পরিমাণ সফল উদ্যোক্তা দেখি, শতকরায় হিসাব করলে তারা সমুদ্র সৈকতের অল্প কিছু ধুলিকণা।
ব্যর্থদের আমরা কেন দেখি না? কারণ, ব্যর্থরা সফলদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বক্তব্য দিতে আসে না। কোনো সাংবাদিক তাদের সাক্ষাৎকার নিতে যায় না। কোনো পত্রিকায় তাদের পাওয়া যায় না। তাই আমরা দেখি না, জানি না। ব্যার্থ সঙ্গীতজ্ঞদের নিয়ে আমরা সিনেমা হতে দেখি। কিন্তু সেটাও তারা একসময় সফল ছিলেন বলে। আগাগোড়া ব্যর্থ সঙ্গীতজ্ঞের উপর নির্মিত কোনো সিনেমার নাম মনে করতে পারেন কি?
সারভাইভারশিপ বায়াস কখন বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়? আপনি যখন ক্রমাগত সফল হতে থাকেন। আপনার সাফল্য হয়তো নেহাতই ভাগ্যচক্রে এসেছে। কিন্তু আমরা তো ভাগ্যকে আমাদের সাফল্যের কারিগর বলতে নারাজ। আমরা তখন নিজেদের পরিশ্রম আর মেধাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে ঘোষণা দিয়ে বেড়াই জনসমাজে। আশেপাশের অন্য যারা সফল, তাদের সাথে নিজেদের মিলগুলো খুঁজে বেড়াই। অতঃপর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, তারাও আমাদের মতো পরিশ্রমী আর মেধাবী বলে সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে তাদের।
কিন্তু আমরা যদি আমাদের খোঁজ অব্যাহত রাখি আর ব্যর্থ মানুষদের সভায় গিয়ে মিশি, দেখবো ব্যর্থদের মধ্যেও অনেকে তথাকথিত সফলদের মতোই পরিশ্রমী আর মেধাবী ছিল। আমাদের পরিশ্রম আর মেধার সাথে ভাগ্যের ব্যাটে-বলে সংযোগ ঘটেছে। তাদের ব্যাটে-বলে মেলেনি। পার্থক্য এই যা।
সারভাইভারশিপ বায়াস এর মূলকথা তাহলে কী দাঁড়াল? চারপাশে হরদম সফল মানুষদের দেখে আমরা নিজেদের সাফল্যের সম্ভাবনাকেও অতিরিক্ত গুরুত্ব দিই (ওভারএস্টিমেট করি)। এই বায়াস থেকে দূরে থাকার উপায় কী তাহলে? উপায় একটাই। সফল মানুষদের গল্প শোনার পাশাপাশি ব্যর্থ মানুষদের গল্পও শোনা। ব্যর্থ কোম্পানির গল্প শোনা, ব্যর্থ প্রজেক্টের গল্প শোনা। শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে, কিন্তু আপনার চিন্তাভাবনা অনেক পরিষ্কার হবে।