এরা কোনো একটি প্রাণী কিংবা একটি উদ্ভিদ নয়, সামুদ্রিক ও মিঠা পানির জলাশয়ে এমন ক্ষুদ্র কিছু জীবের দেখা মিলে যারা জলাশয়ের স্রোতের উপর চলাচলের জন্য নির্ভরশীল। এতোটাই ক্ষুদ্র যে, স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতেও অক্ষম। প্ল্যাঙ্কটন নামটিও এসেছে তাদের এই বৈশিষ্ট্য থেকেই। দুই ধরনের প্ল্যাঙ্কটন রয়েছে জলাশয়গুলোতে; ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন ও জুপ্ল্যাঙ্কটন।
ছোটবেলায় স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে কিংবা স্লেটে আমরা চক ব্যবহার করে লিখতাম, সেই চকগুলো তৈরির কৃতিত্ব কিন্তু প্ল্যাঙ্কটনের দখলে। হোয়াইটবোর্ড আর মার্কারের দাপটে এখন যদিও চক-স্লেট হারাতে বসেছি আমরা।
মানবজীবনে উপকারী হিসেবে ব্যাকটেরিয়ার অবদানের কথা সর্বত্র বিশদ আলোচিত হলেও, প্ল্যাঙ্কটনের কথা তেমন একটা আলোচনায় আসে না আমাদের। এই পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখায় অবদানের জন্য সবথেকে বড় ধন্যবাদটা কিন্তু প্ল্যাঙ্কটনেরই প্রাপ্য, বিশেষ করে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন (গ্রীক ফাইটো শব্দের অর্থ উদ্ভিদ, অর্থাৎ এরা উদ্ভিদের মতো সালোকসংশ্লেষণে সক্ষম)। ব্যাকটেরিয়া ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের বহির্ভূত কিছু নয়, কিছু ব্যাকটেরিয়া প্রজাতিও ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের অন্তর্ভুক্ত।
আমাদের পাঠ্যক্রমে শুধুমাত্র এই নামগুলোই উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু এদের গুরুত্ব সম্পর্কে খুব কমই আলোচিত হয়। খাদ্য-শৃঙ্খলে প্ল্যাঙ্কটনের অবদান অনস্বীকার্য। এখানেও এদেরকে আলোচনার বাইরেই রেখে দেয়া হয়েছে। ভূ-পৃষ্ঠের স্থলজ অংশের খাদ্য-শৃঙ্খলের সাথে সাথে জলজ অংশের খাদ্য-শৃঙ্খলও যে সমান গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়েও আমাদের কারো মাথাব্যথা নেই। গবেষকদের ধারণা মতে, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকেরও বেশি সালোকসংশ্লেষণ হয়ে থাকে এই ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনগুলোর মাধ্যমে। তবে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। একে তো এমন ক্ষুদ্র, খালি চোখে দেখা যায় না; তার উপর পুরো পৃথিবীর সমস্ত জলাশয়ে সংগঠিত সালোকসংশ্লেষণ হিসেব করে বের করাটাও অনেকখানি জটিল। তবে বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে একমত, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ৫০-৮৫ শতাংশ অক্সিজেনের উৎস জলাশয়ের ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনই।
বিজ্ঞানীগণ এও বিশ্বাস করেন যে, প্রতিবার প্রশ্বাসে আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করছি, এতে সামুদ্রিক ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের প্রস্তুতকৃত অক্সিজেনও রয়েছে।
ফলস্বরূপ, পুকুর-নদী-সমুদ্রের মতো জলাশয়কে আমরা ইচ্ছামতো ব্যবহার করি। আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত সমস্তকিছু গিয়ে বর্তায় জলাশয়গুলোতে। রাস্তা-ঘাটে ময়লা ফেলতে আমাদের বাঁধে, আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পক্ষে আওয়াজ তুলি। কিন্তু সামুদ্রিক পরিচ্ছন্নতায় আমাদের ভূমিকা খুব কম। উন্নত বিশ্বে অনেক সংগঠন আওয়াজ তুললেও, আমাদের দেশে এই চর্চাটা সীমিত।
ব্যাপারটি এমন যে, আমরা ভুলেই গেছি, জলাশয়গুলোতেও একটি জীবন ব্যবস্থা রয়েছে। একটি জলাশয় কেবলমাত্র মাছের উৎসই নয়, আমাদের বেঁচে থাকবারও একটি বিশাল খোরাক। জলাশয়ে এই অবদানের শুরুটাই হয় প্ল্যাঙ্কটনকে দিয়ে।
সালোকসংশ্লেষণ ব্যবস্থায়, প্ল্যাঙ্কটন সূর্যের আলোকে ব্যবহার করে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও পানির সমন্বয়ে প্রস্তুত করে গ্লুকোজ আর অক্সিজেন। যদি পৃথিবীর অর্ধেক সালোকসংশ্লেষণের কথা বিবেচনায় আনা হয়, প্রতিবছর বায়ুমণ্ডলের ৫০ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহৃত হয়, তথা ১২৫ বিলিয়ন টন গ্লুকোজ উৎপাদিত হয়; যা মানবজাতিসহ সমস্ত প্রাণের একটি অপরিহার্য খাদ্য উৎস।
ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন যেহেতু গ্লুকোজ অর্থাৎ খাদ্য প্রস্তুত করে, সেহেতু জলাশয়ের খাদ্য-শৃঙ্খলের শুরুটা হয় এই ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনকে দিয়েই। সালোকসংশ্লেষণে অক্ষম অর্থাৎ প্রাণী প্ল্যাঙ্কটনগুলোকে ডাকা হয় জুপ্ল্যাঙ্কটন। জুপ্ল্যাঙ্কটন রয়েছে দুই ধরনের, হলোপ্ল্যাঙ্কটন আর মেরোপ্ল্যাঙ্কটন। হলোপ্ল্যাঙ্কটনগুলো তাদের সারাজীবনই প্ল্যাঙ্কটন হিসেবে জীবনযাপন করে। অপরদিকে, মেরোপ্ল্যাঙ্কটনগুলো তাদের জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময় কিংবা দশায় কেবল প্ল্যাঙ্কটন হিসেবে বিরাজমান; যেমন কিছু মৎস্য প্রজাতি কিংবা কাঁকড়ার লার্ভা দশাটি।
জুপ্ল্যাঙ্কটনের মধ্যে কিছু হলো তৃণভোজী, ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনগুলো এই তৃণভোজী জুপ্ল্যাঙ্কটনেরই খাদ্য। এভাবে করেই খাদ্য শৃঙ্খল উপরের দিকে ধাবিত, তৃণভোজী জুপ্ল্যাঙ্কটন আবার মাংসাশী জুপ্ল্যাঙ্কটন খাদ্য। সমস্ত প্ল্যাঙ্কটন আবার মাছগুলোর খাবারে পরিণত হয়। একে একে সব প্ল্যাঙ্কটনই জলাশয়ের সব জীবের খাদ্য উৎস হয়ে থাকে। খাদ্য-শৃঙ্খল গিয়ে শেষ হয় জলাশয়ের সবথেকে বড় জীবটির কাছে। মোদ্দাকথা এই যে, প্ল্যাঙ্কটন ছাড়া জলাশয়ে আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎস মাছের দেখাই পেতাম না আমরা। আর পুরো পৃথিবীজুড়ে যে জনগোষ্ঠীর জীবিকা মাছ ধরার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাদের কথাটা ভাবুন তো একটিবার।
সালোকসংশ্লেষণের জন্য ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনগুলোকে সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থান করতে হয়, যতটুকু পর্যন্ত সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারবে। অক্সিজেন উৎপাদন ছাড়াও, বায়ুমণ্ডলের কার্বন চক্রেও ভূমিকা রয়েছে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের। বায়ুমণ্ডল থেকে সমুদ্রে কার্বন-ডাই-অক্সাইড স্থানান্তরের সিংহভাগই সম্পন্ন হয় ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন দ্বারা। এর থেকেই বোঝা যায় যে, জলাশয়ে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের সংখ্যায় তারতম্য দেখা দিলে এর প্রভাব পৃথিবীর জলবায়ুতেও প্রতিফলিত হতে পারে।
সমুদ্রের খাদ্য-শৃঙ্খলের শীর্ষে অবস্থানকারী একটি নীল তিমি প্রতিদিন যে পরিমাণ বর্জ্য ত্যাগ করে, তাতে ৩ টনের মতো নাইট্রোজেন আর লৌহজাত বিভিন্ন খনিজ উপাদান বিদ্যমান। এই খনিজ উপাদানগুলোই পুনরায় ব্যবহার করে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন। পারতপক্ষে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন পুরো জীবকুলকে বাঁচিয়ে রাখছে। অতএব, সমুদ্রের খাদ্য-শৃঙ্খলকে অক্ষুণ্ণ রাখতে তিমি মাছগুলোর গুরুত্বও ফেলনা নয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে জনজীবনে প্ল্যাঙ্কটনের তাৎপর্য আলোচিত না হওয়াতে, এর প্রয়োজনীয়তা আমরা টের পাই না। জলাশয় দূষণের ফলস্বরূপ, প্ল্যাঙ্কটনের পরিমাণ নিম্নমুখী। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, ১৯৫০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত এ পরিমাণ ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
আমরা মানুষেরা আরো কীভাবে আমাদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে নিয়ে যাচ্ছি এই গল্পটিও শুনুন। প্রতিবছর প্রায় ৬৫ বিলিয়ন প্রাণী জবাই করা হয় যা মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত। সারাবছরে জলাশয় থেকে প্রাপ্ত মাছের ৪০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় এ বিশাল সংখ্যক প্রাণীর খাদ্য হিসেবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সমুদ্র দূষণে তাতে প্রাণের সংখ্যা বছরকে বছর কমছে। তাই স্বল্পমূল্যে স্থলজ প্রাণীদের খাদ্যের যোগান দিতে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো খাদ্য হিসেবে প্ল্যাঙ্কটনকে দিয়ে প্রতিস্থাপনের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে।
অথচ পৃথিবীর বুকে এই প্ল্যাঙ্কটনগুলো নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে গত তিন বিলিয়ন বছর ধরে।
বছর বছর প্ল্যাঙ্কটন ধরে নিয়ে স্থলজ প্রাণীদের খাইয়ে দিলে প্রাণিকুলের জন্য অক্সিজেন তৈরি করবে কারা! পূর্বেই বলা হয়েছে, সারা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সিংহভাগ অক্সিজেনের উৎসই হলো এই ক্ষুদে প্ল্যাঙ্কটনেরা।
আর প্ল্যাঙ্কটন যে কেবল, অক্সিজেন তৈরি, জলবায়ুর ভারসাম্য রেখেই নিজের দায়িত্ব শেষ করে নিচ্ছে তা নয়। এই এককোষী ক্ষুদে জীবগুলোর গত তিন বিলিয়ন বছরের পরিশ্রমের ফলেই আমরা এখন জ্বালানী হিসেবে খনিজ তেল আর গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছি। গাছ কেটে কাঠ পুড়িয়ে হয়তোবা রান্নার কাজ হয়ে যেতো, কিন্তু নিত্য ব্যবহার্য যানবাহনগুলো কীভাবে চালাতাম আমরা!
পৃথিবীজুড়ে বিলিয়ন ডলারের যে পোশাক শিল্প রয়েছে, এতেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরাই। পঞ্চাশের দশকের পর থেকে নাইলন, অ্যাক্রিলিক আর রেয়নের মতো সিন্থেটিক ফাইবার যখন পোশাকখাতে খ্যাতি অর্জন করতে শুরু করে, পোশাক ধৌত করা পানির সাথে সাথে সেসব পোশাক থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক গিয়ে মিশে যায় জলাশয়গুলোর পানিতে। আর এই মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো প্ল্যাঙ্কটনের খাদ্যে পরিণত হয়ে মাছের ভেতর করে আমাদেরই কাছে ফিরতে পারে। অ্যাক্রিলিক আর পলিএস্টারের মতো সিন্থেটিক ফাইবারের ব্যবসা পৃথিবীজুড়ে এখন বেড়েই চলেছে রমরমা হারে।
আমরা যদি সমুদ্রপ্রাণ রক্ষার্থে এখুনি সচেতন না হই, প্ল্যাঙ্কটনের পরিমাণ হ্রাস পেতেই থাকে, তবে এর প্রভাব দেখা যাবে সামুদ্রিক সকল প্রাণে। ভবিষ্যতে একসময় স্থলজ প্রাণিতেও এই প্রভাব প্রতিফলিত হতে শুরু করবে। ফলস্বরূপ, আমাদের জীবন নিয়েই হয়তো শুরু হবে টানাটানি। তখন আরো একবার মানবজাতি অসহায় হয়ে উঠবে প্রকৃতির কাছে। এর চেয়ে বরং প্রস্তুতির শুরুটা হোক এখনই।