সঙ্গীত বা মিউজিক শব্দটির প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক বেশি। যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট ছন্দময় শব্দগুচ্ছ, যা আমাদের মাঝে নান্দনিকতা ও অনুভূতির সঞ্চার করে, তাকেই সঙ্গীত বলা যায়। বিগত ৫৫ হাজার বছরের সঙ্গী হিসেবে সঙ্গীত আমাদের সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেকোনো শিল্পের মতোই সঙ্গীতের প্রাথমিক কাজ হলো আমাদের মন-মস্তিস্কে অনুভূতির সঞ্চার করা। যেকোনো বিষয়বস্তু, যা আমাদের মস্তিস্কে আনন্দ-অনুভূতির কেন্দ্র- ডোপামিন ক্ষরণের মাধ্যমে সেই কেন্দ্রকে সঙ্গীত সক্রিয় করে তোলে। ফলে জৈব-রাসায়নিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা ইতিবাচক উদ্দীপনার স্বাদ পাই।
সঙ্গীতের প্রধান তিনটি উপাদানের সাথে আমরা সকলেই কম বেশি পরিচিত- সুর, তাল এবং লয়। ‘লয়’ ব্যাপারটিকে উল্লেখ করা হয় একক সময়ে শব্দ বা তালের পরিমাপক হিসেবে, যা প্রতি সেকেন্ড (হার্জ) বা প্রতি মিনিট (বিপিএম) হিসেবে গণনা করা হয়ে থাকে। মজার বিষয় হলো, এই লয়ের পরিমাপের একটি সুস্পষ্ট প্রভাব মানুষের মনস্তাত্ত্বিক আচরণের মাঝে লক্ষ্য করা যায়। হৃদস্পন্দনের গতিবিধির উপরও এর প্রভাব লক্ষণীয়।
সাধারণত বিটা তরঙ্গের সঙ্গীত (১৪-৪০ হার্জ) আমাদের মন-মস্তিষ্ককে দৈনন্দিন কাজের জন্য সর্বোচ্চ সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে, যার মধ্যে রয়েছে আধুনিক পপ ও রক সঙ্গীত। অপরদিকে আলফা তরঙ্গের সঙ্গীত (৮-১৪ হার্জ) আমাদের মাঝে প্রশান্তির অনুভূতি জাগ্রত করে। ব্লুজ, কান্ট্রি ও ফোক সঙ্গীত এই দলভুক্ত। ৪-৮ হার্জভুক্ত থিটা তরঙ্গের সঙ্গীত মস্তিষ্ককে মেডিটেশন, শান্ত ও স্বপ্নময় অনুভূতি প্রদান করে, অন্যদিকে ৪ হার্জের নিচের সীমায় অবস্থান করা ডেল্টা তরঙ্গের সঙ্গীত আমাদের ঘুমের জন্য সহায়ক অনুভূতি যোগায়। [১]
সঙ্গীতের প্রভাব আমাদের ইন্দ্রিয়ের উপর দারূণ ইতিবাচক, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যেকোনো ধরনের সঙ্গীত বা যেকোনো ধরনের গান শুনলে তা সরাসরি আমাদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার উপর সক্রিয় প্রভাব বিস্তার করে, যা আমাদের আবেগ ও মৌলিক আচরণসমূহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমরা কোন ধরনের সঙ্গীত শুনে অভ্যস্ত, তার উপর সঙ্গীতের প্রভাব নির্ভর করে না। সঙ্গীতের প্রভাব নির্ভর করে মূলত আমরা কীভাবে তার সাথে আমাদের আবেগকে সংযুক্ত করতে পারছি, তার উপর।
২০১৬ সালে শ্যাখস ও তার পরিচালিত গবেষকদলের এক গবেষণা মতে, যে সকল মানুষ কোনো একটি গানের সাথে নিজের আবেগকে কোনোভাবে সংযুক্ত করতে পারে, তাদের মস্তিস্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণ অংশগুলোর সাথে অডিটরি কর্টেক্সের মধ্যবর্তী সংযোজক হোয়াইট ম্যাটারের কার্যকারিতা অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়, যা মস্তিষ্ককে পূর্বের চেয়ে বেশি সচল করে তোলে [২]।
US National Library of Medicine-এ ২০১৩ সালে প্রকাশিত তথ্যমতে, সঙ্গীত বিষয়ে প্রশিক্ষিত শিশুদের শ্রবণশক্তি সাধারণ শিশুদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়, ফলে তাদের দৈনন্দিন মনোযোগ, শ্রবণ বিষয়ক স্মৃতি ও কার্যক্ষমতা অনেক বেশি ভালো ফলাফল প্রদর্শন করে। [৩]
লিডস্কগের ২০১৬ এর গবেষণা মতে, সঙ্গীত মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সঙ্গীতপ্রেমীরা অনুসরণ বা অনুকরণের বদলে তার প্রিয় শিল্পীদের মতোই নিজেদের অব্যক্ত কথা তুলে ধরতে ও নিজের আলাদা পরিচয় তৈরি করতে বেশি আগ্রহী হয়। [২]
২০১১ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়, যেখানে একদল মানুষকে একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে বলা হয়, এবং তারা তাদের কাজ সন্তোষজনকভাবে করতে পারেননি বলে পরবর্তীতে জানানো হয়। এরপর তাদের দুটি গ্রুপে বিভক্ত করে দুটি আলাদা কক্ষে রাখা হয়। একটি কক্ষ সম্পূর্ণ শান্ত ছিল, আরেকটি কক্ষে মৃদু সঙ্গীত চালু রাখা হয়। পরবর্তীতে দেখা যায়, শান্ত কক্ষের চেয়ে সঙ্গীত চালু রাখা কক্ষে থাকা ব্যক্তিগণ পরবর্তীতে এই কাজ আরও ভালোভাবে করার ব্যাপারে বেশি আশাবাদী ও ইতিবাচক ছিলেন। [৩]
সঙ্গীত মানুষের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং যুক্তিবাদী মস্তিস্ককে সক্রিয় করে তোলে। ইউনিভার্সিটি অফ ইলেনয় এর অধ্যাপক রবি মেহতার মতে [৪], ৭০ ডেসিবেল বা তার কম তীব্রতার সঙ্গীত মস্তিস্কের উপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে, যা সৃজনশীল কাজকর্মে মানুষকে আগ্রহী ও সক্রিয় করে তোলে। এই তীব্রতার যেকোনো সঙ্গীত মানুষকে চিরাচরিত ভাবনা থেকে অনেকটাই নিজস্বতার দিকে ধাবিত করে এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে, যা যেকোনো সৃজনশীল কাজকর্মের জন্য সহায়ক মনস্তত্ত্ব তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সঙ্গীতের অন্যতম ইতিবাচক দিক হলো, সঙ্গীত যেকোনো ব্যক্তির শারীরিক ব্যথা-বেদনা, মানসিক পরিশ্রান্তি দূরীকরণ ও সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ১১টি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, যেসকল শারীরিক আঘাতপ্রাপ্ত রোগী হাসপাতালে মৃদু সঙ্গীতময় পরিবেশে অবস্থান করেন, তারা অন্যদের চেয়ে বেদনা অনেক কম অনুভব করেন, কারণ সঙ্গীত তাদের মাঝে স্বাচ্ছন্দ্য, শক্তি এবং ক্লান্তি দূর হবার অনুভূতি সঞ্চার করে। [৪]
২০০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, ডেভিস এর অধ্যাপক পিটার জ্যানাটা পরিচালিত এক গবেষণা মতে [১], মস্তিস্কের একটি অংশ রয়েছে, যা সঙ্গীতের সাথে সরাসরি জড়িত থাকে। পূর্বের জীবনের সাথে আবেগের সংযোগ ঘটায়, বা অতীতের যেকোনো ব্যক্তি, বস্তু বা স্থানের সাথে জড়িত এমন কোনো গান অ্যালঝেইমার্স রোগীদের ক্ষেত্রে অতীত স্মৃতির সাথে নিজেকে সংযুক্ত করতে কার্যকারিতা প্রদর্শন করে।
স্মৃতিশক্তির উপর সঙ্গীতের প্রভাবের অন্যতম উদাহরণ হিসেবে সাবেক মার্কিন কংগ্রেস সদস্য গ্যাব্রিয়েলে জিফোর্ডসের নাম উল্লেখ করা যায়। ২০১১ সালে তার মাথায় গুলি লাগায় তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। তার মস্তিস্কের ভাষা সংক্রান্ত স্মৃতি ও কার্যকেন্দ্র ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি কথা বলার ক্ষমতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু পরবর্তীতে মিউজিক্যাল থেরাপি, গান গাওয়া ও সঙ্গীতের মাঝে থাকার মাধ্যমে তিনি মস্তিস্কের ভাষা কেন্দ্র পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতে সমর্থ হন, যা তাকে পুনরায় ভাষা শিখতে ও কথা বলতে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছে। [১]
ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কস্তাস কারাজিওরঘিসের মতে, ১২৫-১৪০ বিপিএম এর যেকোনো গান শারীরিক ব্যায়াম জাতীয় কাজকর্মে মানুষের মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে [৫]। ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার অধ্যাপক কিম ইনেস এর ২০১৬ সালের এক গবেষণা মতে, বয়স্ক মানুষদের মস্তিস্কের যুক্তিবাদী ও গাণিতিক অংশের উন্নয়নে সঙ্গীত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গান শুনলে আমাদের ঘুম ভালো হয় এবং ধৈর্যশক্তি বৃদ্ধি পায় বলেও বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে। শারীরিক আর মানসিকক্ষেত্রে সঙ্গীতের অবদান তাই উল্লেখযোগ্য বলেই মেনে নেয়া যায়।
যেকোনো শিল্পকলাই আমাদের সভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুর ও ভাষার মিশেলে তৈরি হওয়া ‘সঙ্গীত’ নামের এই শিল্পটিও আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দৈনন্দিন ব্যস্ততা, ক্লান্তি, একাকিত্বে সঙ্গীত যেন আমাদের অদৃশ্য বন্ধু। আর তাই এই ‘আনসাং হিরো’র ইতিবাচক অবদানসমূহের প্রতি রইলো কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা। যতদিন বেঁচে থাকবে পৃথিবী, বেঁচে থাকুক সঙ্গীত ও শিল্পকলার মহিমা।