বিগ ব্যাংয়ের উত্তপ্ত চুল্লি থেকে থেকে শুরু করে আপনার চায়ের কেতলিতে পানি এসে পড়ার আগে কেটে গেছে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর। কম করে হলেও পৃথিবীর ৭০ শতাংশ পানি, মানবদেহেরও সিংহভাগ পানি। সাগর-মহাসাগরগুলো পানির সবচেয়ে বড় আধার। পৃথিবীর পানির ৯০ শতাংশ সঞ্চিত আছে সেখানেই। সাগর ছাড়াও বরফ আকারে, ভূগর্ভ, লেক আর নদীতেও আছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পানি। এছাড়াও পানির অন্যতম আধার এই জীবজগৎ। শুধু মানুষই নয়, জীবিত সকল প্রাণীর দেহেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পানি বিদ্যমান। নিঃসন্দেহে বলাই যায়, আমাদের চারপাশে থাকা অন্য যেকোনো পদার্থের চেয়ে পানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। জীবনধারণের অন্যতম এই উপাদান পানির আণবিক ভর, আকার আকৃতি কিংবা যেকোনো গুণাগুণের ব্যাপারে পৃথিবীতে থাকা মানুষের ধারণা একদম পানির মতোই স্বচ্ছ।
কিন্তু নীল এই গ্রহে বিপুল পরিমাণ পানির উৎপত্তি নিয়ে এখনো আছে অনেক ধোঁয়াশা। চলছে পৃথিবীতে পানির উৎপত্তি নিয়ে হাজারো গবেষণা। পৃথিবীর সৃষ্টির শুরু থেকেই উত্তপ্ত এই পৃথিবীতে পানি ছিলো নাকি পৃথিবীতে পানির সৃষ্টি হয়েছে অন্য কোনো কারণে এই নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। তবে সাম্প্রতিকতম কিছু গবেষণায় পৃথিবীতে পানির উৎপত্তি নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে কিছু ব্যাপারে।
বিগ ব্যাং সংগঠিত হওয়ার পরে এর শক্তি ক্রমান্বয়ে চারদিকে ছড়িয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের সূক্ষ্ম হিসেবানুযায়ী, বৃহৎ এই বিস্ফোরণের পরে প্রথম যে আণবিক নিউক্লিয়াসটি তৈরি হয় সেটি হলো হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস। হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সবচেয়ে সরল নিউক্লিয়াস এবং পানির অন্যতম একটি উপাদান।
তবে বিগ ব্যাং সংগঠিত হওয়ার পরের সময়ে হাইড্রোজেন ছাড়া শুধুমাত্র অল্প পরিমাণ হিলিয়াম আর যৎসামান্য লিথিয়াম তৈরি হয়েছিলো বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই সময় তৈরি হওয়া বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন পানি তৈরির পথে মহাবিশ্বকে একধাপ এগিয়ে দেয়। কিন্তু পানি তৈরির অন্য উপাদান অক্সিজেন তখনও মঞ্চে উপস্থিত হয়নি।অক্সিজেনের তখনো অনেক রাস্তা পাড়ি দেওয়া বাকি।
বিগ ব্যাং এর বিলিয়নখানেক বছর পরে আবির্ভাব ঘটে নক্ষত্রদেরর। সেই নক্ষত্রের অভ্যন্তরে থাকা চুল্লিতে ঘটতে থাকে ফিউশন বিক্রিয়া। এই ধরনের বিক্রিয়ার মাধ্যমে ছোট নিউক্লিয়াসগুলো উচ্চতাপে জোড়া লেগে বড় নিউক্লিয়াস তৈরি করে। সূর্যের ভেতরেও একই পদ্ধতিতে শক্তি উৎপন্ন হয়। এই ফিউশন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন নক্ষত্রের ভেতরে চলতে থাকা চুল্লিতে ছোট নিউক্লিয়াসগুলো জোড়া লেগে তৈরি হতে থাকে কার্বন, নাইট্রোজেন অক্সিজেন কিংবা এর চেয়ে বড় আকারের নিউক্লিয়াস।
আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, নির্দিষ্ট জীবনকাল শেষে নক্ষত্রদেরও একদিন মৃত্যু হয়। তবে একেক নক্ষত্রের মৃত্যুর প্রক্রিয়া আলাদা। কিছু নক্ষত্রের মৃত্যুতে ঘটে অতিকায় সুপারনোভা বিস্ফোরণ। সেই বিস্ফোরণে অক্সিজেন সহ যাবতীয় সবকিছুই বেরিয়ে আসে মৃত নক্ষত্রের হৃদয় থেকে।
মুক্ত হয়ে হাইড্রোজেনের সাথে অক্সিজেন মিলে তৈরি হয় পানি। মহাবিশ্বে পানির যাত্রা শুরু হয়েছে এভাবেই। কিন্তু পৃথিবী তখনো তৈরি হয়নি। বিগ ব্যাং এর বিস্ফোরণ থেকে পেরিয়ে গেছে নয় বিলিয়ন বছর। ইতোমধ্যেই পানির অণু আরো অনেক মহাজাগতিক কণার সাথে মিশে সূর্য আর আর তার চারপাশের গ্রহ তৈরির কাজেও লেগে পড়েছে। কিন্তু পৃথিবীর উত্থানের দীর্ঘ ইতিহাস বলে, শুরুতে তাপমাত্রা এত বেশি ছিলো যে সেখানে জলীয় পানি থাকা প্রায় অসম্ভব, বায়ুমণ্ডল গড়ে না ওঠায় বাষ্প হিসেবে বন্দী থাকাও সম্ভব নয়। তৈরি হওয়ার সময় পৃথিবীপৃষ্ঠে থাকা পানির পুরোটাই মহাশূন্যে পাড়ি জমায়।
তাই আমরা পৃথিবীতে এখন যে পানির শীতল স্পর্শ নিই তার আবির্ভাব হয়েছে আরো অনেক দেরিতে। জ্যোতির্বিদদের মতে, পৃথিবীতে বর্তমানে যে পানি দেখা যায় তার মূল উৎস হতে পারে দুটি মহাজাগতিক বস্তু। একটি হলো ধূমকেতু, অন্যটি গ্রহাণু। উভয়ের গঠন উপাদানেই পানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। এই দুটি বস্তুর মধ্যে প্রাথমিক যে পার্থক্যটি বিদ্যমান তা হলো, ধূমকেতুতে থাকে উচ্চ ঘনমাত্রার উপাদান, যেটি উচ্চতাপে ধূমায়িত হয় এবং এর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গ্যাসীয় লেজটি চোখে পড়ার মতো।
গ্রহাণু হলো মহাজগতে ঘুরে বেড়ানো পাথরখন্ডের ন্যায়। সময়ে-অসময়ে এরা আছড়ে পড়তে পারে পৃথিবী কিংবা অন্য কোনো গ্রহের বুকে। এর গঠনেও ধূমকেতুর সাথে বেশ মিল বিদ্যমান। তবে এই দুইয়ের মধ্যে কে আসলে পৃথিবী উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পানি বয়ে এনেছে তা বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের গবেষণার বিষয়।
গ্রহাণুর রাসায়নিক গঠন নিয়ে সাম্প্রতিকতম গবেষণা আর হিসাবনিকাশ ইঙ্গিত করছে, গ্রহাণুতেই লুকিয়ে থাকতে পারে পৃথিবীতে পানি নিয়ে আসার রহস্য। সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবীর বুকে নানা আকারের গ্রহাণু আঘাত হেনেছে। ছোট থেকে বড় আকারের এই গ্রহাণু কোনো সময় হাজারে হাজারে অনেকটা মহাজাগতিক বোমার মতোই আঘাত করেছে পৃথিবীতে। ৪.১ থেকে ৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই মহাজাগতিক বোমাবাজিকে বিজ্ঞানীরা তাই নামকরণ করেছেন ‘Late Heavy Bombardment (LHB)’ নামে। তবে বোমার মতো ধেয়ে আসা এই হাজারো ধরনের গ্রহাণুর মধ্যে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি ‘carbonaceous chondrites’ নিয়ে। এই ধরনের গ্রহাণুর মধ্যে পাওয়া যায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পানি।
তবে গবেষকদের দীর্ঘদিন ধরে ধারণা ছিলো গ্রহাণু পৃথিবীপৃষ্ঠে আঘাত করার ফলে যে বিপুল পরিমাণ উত্তাপের সৃষ্টি হয়, তার ফলে পানি আবার মহাশূন্যে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়। এই বিষয়টিও বিজ্ঞানীদের অনেকদিন ভুগিয়েছে। অবশেষে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যার গবেষক টেরিক ডালি এবং ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পিটার শুলজ পুরো ঘটনাকে ল্যাবে ছোট আকারে রেপ্লিকা করে দেখেছেন। সেখানেই তারা প্রমাণ পেয়েছেন পৃথিবীতে আঘাত করার সময় সৃষ্ট উত্তাপে কিছু পরিমাণ পানি মহাশূন্যে হারিয়ে যায়, তবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পানি পৃথিবীপৃষ্ঠ কর্তৃক গৃহীত হয়। ডক্টর পিটার শুলজ পৃথিবীর পানির উৎসের রহস্য অনুসন্ধানে প্রায় আটত্রিশ বছর ধরে কাজ করে গেছেন। তার মতে, পৃথিবীর আদিম পরিস্থিতি নিয়ে ল্যাবে কাজ করা মোটেই সহজসাধ্য ব্যাপার না, এই ব্যাপারে কাজ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং।
এই পরীক্ষার করার জন্য নাসার তৈরি প্রায় তিন তলা উঁচু একপ্রকারের নিক্ষেপক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। যেটি পৃথিবীপৃষ্ঠে ‘Late Heavy Bombardment (LHB)’ এর সময়ের গ্রহাণু আছড়ে পড়ার পরিস্থিতির তৈরি করবে। আর গ্রহাণুর মডেল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে মটরশুঁটি আকারের বিশেষ ধরনের ‘antigorite’ নামক পাথর। এই পাথরের গঠন উপাদানের সাথে গ্রহাণুর সাথে যথেষ্ঠ মিল বিদ্যমান। আদি পৃথিবীর মাটির রেপ্লিকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ‘ঝামাপাথর’ ধরনের শুষ্ক আগ্নেয়গিরিজাত মাটি। পরীক্ষায় এগারো হাজার মাইল/ঘন্টা বেগে নিক্ষেপ করা হয় মাটির উপরে।
ফলে দেখা যায় গ্রহাণুতে থাকা পানির প্রায় ত্রিশ শতাংশই শোষিত হয়েছে ঝামাপাথর দিয়ে। তাই এই গবেষণার ফলাফল থেকে ডক্টর পিটার শুলজের মতামত, বর্তমান পৃথিবীতে পানির উৎস হিসেবে গ্রহাণুর বোমাবাজিকেই অনেকাংশে দায়ী করা যেতে পারে।
Feature image source: Getty Images