তার জ্ঞানের ভাণ্ডার যেমন সুবিশাল, অজ্ঞানতাও ঠিক তেমনই সুগভীর — দুটোই সমান আশ্চর্যজনক। সমসাময়িক সাহিত্য, দর্শন এবং রাজনীতি সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানে না সে। আমার মুখে টমাস কারলাইলের কথা শুনে সে অত্যন্ত সাধাসিধেভাবে জিজ্ঞেস করেছিল, কারলাইল কে, এবং সে কী করেছে। তবে আমার বিস্ময়বোধ চরমে উপনীত হলো সেদিন, যেদিন আমি দুর্ঘটনাক্রমে আবিষ্কার করলাম কোপার্নিকান থিওরি এবং সৌরজগতের গঠন সম্পর্কেও সে একদমই অবিদিত। এই উনবিংশ শতকে এসেও যে কোনো সভ্য সমাজে বসবাসরত মানুষ জানে না পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে, এ বিষয়টি এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে, আমার পক্ষে হজম করা সম্ভব হচ্ছিল না।
আমার মুখে বিস্ময়চিহ্ন দেখতে পেয়ে সে মুচকি হেসে বলল, “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব অবাক হয়েছ। এখন যেহেতু আমি জেনেই ফেলেছি, আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব বিষয়টি ফের ভুলে যেতে।”
“ভুলে যেতে!”
“দেখো,” সে ব্যাখ্যা করতে শুরু করল, “আমি মনে করি একজন মানুষের মস্তিষ্ক হলো প্রকৃতপক্ষে একটি খালি কুঠুরির মতো, এবং তোমাকে তোমার মনমতো আসবাব দিয়ে কুঠুরিটিকে সাজাতে হবে। একজন বোকা মানুষ সামনে যা পায় তাই দিয়েই তার কুঠুরিটিকে ভরিয়ে তোলে, যেন সেটি একটি গুদাম ঘর। এভাবে হাবিজাবি, অপ্রয়োজনীয় জিনিসে কুঠুরিটি এতটাই পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে যে, প্রয়োজনের সময় সেখান থেকে দরকারি জিনিসগুলো বের করে আনাই মুশকিল হয়ে পড়ে। কিন্তু একজন দক্ষ কারিগর এ ব্যাপারে খুব হুঁশিয়ার যে সে তার মগজ-কুঠুরিতে কী কী জিনিস নেবে। সে শুধু সেসব যন্ত্রই তার কুঠুরিতে নেয়, যেগুলো তার কাজে লাগবে, এবং সেগুলোকে সে খুব সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে। এমনটি ভাবা খুবই ভুল যে একটি ছোট মগজ-কুঠুরির গায়ে রয়েছে ইলাস্টিকের দেয়াল, যাকে চাইলেই যত খুশি ফাঁপানো যাবে। এভাবে বাজে জিনিস ঠাসতে গিয়ে এমন একটা সময় আসবে, যখন প্রতিটি নতুন জ্ঞানের বিপরীতে তুমি এমন একটি কিছু ভুলে যাবে, যা তুমি আগে জানতে। সুতরাং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যেন অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান কখনো আমাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞানগুলোর সামনে চলে না আসে।”
“কিন্তু তাই বলে সৌরজগৎ!” আমি আবারো প্রতিবাদ করলাম।
“তা জেনে আমার লাভটা কী!” এবার যেন একটু অসহিষ্ণুতাই ঝরে পড়ল তার কণ্ঠে। “তুমি বলছ আমরা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করি। কিন্তু আমরা যদি চাঁদকেও প্রদক্ষিণ করতাম, তাতেও আমার বা আমার কাজের দুই পয়সা লাভ হতো না।”
আমি এবার প্রায় জিজ্ঞেসই করে বসছিলাম যে কোন কাজের কথা সে বলছে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সংযত করলাম, কারণ তার আচরণের মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যা জানিয়ে দিচ্ছিল আমার এ প্রশ্নকে সে ভালোভাবে নেবে না। তাই আমি আমাদের সংক্ষিপ্ত আলাপনটি নিয়ে নিজ মনেই ভাবতে থাকলাম, এবং সেখান থেকে নিজের মতো করে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাইলাম। সে বলছে, এমন কোনো জ্ঞান সে লাভ করবে না, যেগুলো তার কোনো কাজে আসে না। তার মানে যেসব জ্ঞান তার দখলে রয়েছে সেগুলো সবই তার কাছে প্রয়োজনীয়।
অনেকের কাছেই হয়তো উপরের অংশটুকু খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। কেউ কেউ হয়তো এ-ও ধরে ফেলেছেন যে এখানে অপ্রয়োজনীয় জ্ঞানের প্রতি তীব্র অনীহা থাকা ব্যক্তিটি আর কেউ নয়, আমাদের সকলের প্রিয় গোয়েন্দা শার্লক হোমস। আর যার কাছে সে তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করছে, সে হলো ড. ওয়াটসন। তাই আর রহস্য না করে জানিয়েই দিই, এ অংশটুকু নেয়া হয়েছে শার্লক হোমসের অন্যতম সেরা কাহিনী “আ স্টাডি ইন স্কারলেট” থেকে।
যুগে যুগে শার্লক হোমসের চিন্তাধারা নিয়ে কাজ করেছেন বহু গবেষক, এবং সেসব গবেষণার উপর ভিত্তি করে বিশাল বিশাল সব বইও রচনা করেছেন তারা। সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত সেরকমই একটি বই হলো “Mastermind: How to Think Like Sherlock Holmes”. বইটির রচয়িতা রাশিয়ান-আমেরিকান লেখক ও মনোবিদ মারিয়া কোনিকোভা। বইটিতে তিনি উপরোক্ত ‘মগজ-কুঠুরি’ তত্ত্বটিকে অভিহিত করেছেন শার্লক হোমস থেকে প্রাপ্ত মানব চিন্তাধারার সম্পর্কিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে।
শার্লক হোমস কী বোঝাতে চেয়েছে ‘মগজ-কুঠুরি’ তত্ত্বের মাধ্যমে? এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন কোনিকোভা। তার মতে, শার্লক এখানে কুঠুরিকে একটি রূপকার্থে ব্যবহার করেছে, যার মাধ্যমে সে বোঝাতে চেয়েছে কীভাবে আমরা কোনো তথ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করি। শার্লক বোঝাতে চেয়েছে, আমাদের পারিপার্শ্বিক পৃথিবী থেকে কীভাবে আমরা বিভিন্ন তথ্য গ্রহণ করি, এবং তারপর সেগুলোকে চিরস্থায়ী স্মৃতিতে রূপান্তরিত করি, যা পরবর্তীতে আমাদের কাজে লাগবে ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত, ভবিষ্যৎ চিন্তা, এবং ভবিষ্যৎ জ্ঞানের চাবিকাঠি হিসেবে।
মূলত দুইটি কারণে শার্লক কুঠুরিকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছে। প্রথমত, একটি কুঠুরি হলো খুবই সীমাবদ্ধ আয়তনের জায়গা। আপনি আশা করতে পারেন না যে আপনি সেখানে যত খুশি জিনিস ঠেসে রাখবেন, কিন্তু সেটির জায়গা কখনো শেষ হবে না। একই কথা আমাদের মনের ক্ষেত্রেও কিন্তু সত্য। মানবমন হয়তো একটি কুঠুরির চেয়ে বেশি বিস্তৃত, কিন্তু তারপরও সেখানে কাজ চালানোর মতো জ্ঞান সংরক্ষণের জায়গা খুবই সীমিত।
শার্লকের দ্বিতীয় যুক্তি, যে কারণে এ উপমাটি এতটা কার্যকর, তা হলো: এটি খুব বেশি পার্থক্য গড়ে দেয় না যে আপনি কী মজুদ করছেন, বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি কীভাবে তা করছেন। সুতরাং আপনি যদি এখন কোনো পুরনো বাড়ির কুঠুরির কথা ভাবেন, যেখানে আবর্জনার মধ্যে অজস্র বাক্স ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কিন্তু কোনোটির গায়েই লেবেল সাঁটা নেই, তাহলে আপনি কোনো নির্দিষ্ট বাক্সই সহজে খুঁজে পাবেন না।
শার্লক তার বক্তব্যের মাধ্যমে আপনাকে বলছে সাবধান হতে, সবকিছুতে লেবেল সেঁটে রাখতে, নিশ্চিত করতে যেন সবকিছু সাজানো-গোছানো থাকে এবং চাইলেই হাতের কাছে পাওয়া যায়। এর ফলে আপনি কোনো কিছু চাইলে শুধু খুঁজেই পাবেন না, আরো ভালোভাবে মনেও রাখতে পারবেন। আসলে যেকোনো আকস্মিক মুহূর্তে আমাদের সরাসরি কোনো কিছুই মনে থাকে না। আমরা শুধু জানি যে একটি তথ্য আমাদের পূর্ব-পরিচিত কি না।
তথ্যটি আপনার মুখস্ত কি না তাতে কিছু যায় আসে না, কারণ এই মুহূর্তে সেটি আপনার মগজ-কুঠুরির ভিতর কোনো এক জায়গায় ঘাপটি মেরে আছে। যদি প্রয়োজনের সময় আপনি আপনার মগজ-কুঠুরি ঘেঁটে তথ্যটি বের করে আনতে না পারেন, তাহলে ওই তথ্য বা জ্ঞান আপনার কোনো কাজেই আসবে না। কিংবা কে জানে, ওই জ্ঞানটি বোধহয় আপনার দখলে আসেইনি কখনো!
কোনিকোভার এ ব্যাখ্যা থেকে আমরা কয়েকটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো, জ্ঞান অর্জনও অনেকটা স্বাধীনতা অর্জনের মতোই। অর্থাৎ, জ্ঞান অর্জন যতটা কঠিন, তার থেকে ঢের বেশি কঠিন সেই জ্ঞান রক্ষা করা। নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই আপনি বিষয়টি আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। একবার ভেবে দেখুন, ছোটবেলায় পরীক্ষায় ভালো করার জন্য যেসব পড়া ঝেড়ে মুখস্ত করেছিলেন, তার কতটুকু আজো মনে আছে, আর কতটুকু ভুলে বসে আছেন। দেখবেন, ভুলে যাওয়ার পরিমাণই বেশি।
কিন্তু এই ভুলে যাওয়ার মাঝেও কিন্তু কিছু তফাৎ রয়েছে। প্রথম শ্রেণীতে থাকতে আপনি যেসব পড়া মুখস্ত করেছিলেন, সেগুলো আপনার যতটা মনে আছে, তার তুলনায় অনেক কম মনে আছে দশম শ্রেণীতে, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ সেমিস্টারে মুখস্ত করা পড়াগুলো। এর কারণ কিন্তু শুধু এ-ই নয় যে প্রথম শ্রেণীর পড়া অপেক্ষা শেষোক্ত পড়াগুলো বেশি কঠিন। তার থেকেও জরুরি বিষয় হলো, প্রথম শ্রেণীতে পাঠকালে আপনার মগজ-কুঠুরি অনেকটাই ফাঁকা ছিল। তাই সে সময়ে মুখস্ত করা পড়াগুলো প্রক্রিয়াজাত হয়েছিল অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে। মাঝে এতগুলো দিন কেটে যাওয়ার পরও সেজন্য সেগুলো মোটামুটি মনে আছে। কিন্তু এরপর থেকে প্রতি বছর আপনার মগজ-কুঠুরি একটু একটু করে পরিপূর্ণ হতে শুরু করেছে, এবং এখন প্রায় অনেকটা জায়গাই অপ্রয়োজনীয় তথ্যে ভরে আছে, যে কারণে সেখান থেকে জরুরি তথ্য টেনে বের করে আনা খুবই কষ্টসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মগজ-কুঠুরির উপমাকে আমরা বর্তমান সময়ে কম্পিউটারে ব্যবহৃত এসএসডি কার্ডের সাথেও তুলনা করতে পারি। কম্পিউটারে নতুন এসএসডি কার্ড লাগানোর পর যখন সিংহভাগ জায়গাই খালি থাকে, তখন দেখবেন আপনার কম্পিউটার কী দ্রুতগতিতেই না কাজ করছে। কারণ তখন ওই এসএসডি কার্ডের মগজ-কুঠুরিও ফাঁকা ও তরতাজা থাকে, যে কারণে যেকোনো তথ্য সে দ্রুতবেগে প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। কিন্তু কয়েক মাস পর যখন এসএসডি কার্ডটি জাঙ্ক ফাইলসহ বিভিন্ন তথ্যে ভরে যাবে, তখন ক্রমান্বয়ে তার তথ্য প্রক্রিয়াজাত এবং পুরনো তথ্য বের করে আনার গতিও হ্রাস পাবে।
কোনিকোভার ব্যাখ্যার পরবর্তী বিচার্য এই যে, কোনো তথ্য কতটুকু বা কী পরিমাণে গ্রহণ করা হচ্ছে, তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটি কীভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ আপনি স্রেফ ঝেড়ে কোনো পড়া মুখস্ত করলেন, তাতে কোনো লাভই হবে না, যদি না আসল সময়ে গিয়ে সেগুলো মনে করতে না পারেন। এ কারণে ছোটবেলায় আমরা অনেকেই বিভিন্ন ছড়া বা সূত্রের মাধ্যমে পড়া মুখস্ত করেছি। সেগুলোর উদ্দেশ্য শুধু তাড়াতাড়ি ও সহজে মুখস্ত করাই ছিল না। পাশাপাশি আরো উদ্দেশ্য ছিল একটি শব্দ বা বাক্য মাথায় আসামাত্রই যেন তরতর করে বাকি তথ্যগুলোও মনে পড়ে যায়।
এখন যেহেতু আমাদের মস্তিষ্কের অনেকখানি অংশই নানা প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় তথ্যে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে, এবং এখন আর আমাদের ছড়া আকারে কোনো তথ্য মনে রাখার বয়স নেই, তাই আমরা অন্য একটি পন্থা অবলম্বন করতে পারি। সেটি হলো: নতুন অর্জিত কোনো জ্ঞানকে একদম নতুন ও বিচ্ছিন্ন হিসেবে বিবেচনা না করে, অতীতে অর্জিত ও জ্ঞাত কোনো জ্ঞানের সাথে সেটির যোগসূত্র স্থাপন করা। এতে হবে কী, মগজ-কুঠুরিতে অতীতে ভালোভাবে গচ্ছিত তথ্যটির সুবাদেই নতুন তথ্যটিও আমাদের মনে পড়ে যাবে।
সহজ করে বলতে গেলে, কম্পিউটারে যেমন প্রতিটি ফাইলের জন্য নতুন ফোল্ডার খুললে এক সময় প্রয়োজনীয় ফাইল খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায় বলে আমরা ক্যাটাগরি ভাগ করে স্ব স্ব ক্যাটাগরিতে স্ব স্ব বিষয়ভিত্তিক ফাইল সেভ করি, ঠিক একইভাবে নতুন অর্জিত জ্ঞানকে পৃথকভাবে মনে রাখার বৃথা চেষ্টা না করে মগজ-কুঠুরিতে নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে মজুদ রাখতে হবে। কোনিকোভা যেটিকে অভিহিত করেছেন ‘লেবেল সেঁটে রাখা’ হিসেবে। এছাড়া কোনো তথ্য সহজে মনে রাখার আরেকটি চমৎকার উপায় হতে পারে মুখস্তবিদ্যার বদলে ব্যবহারিক জ্ঞান। শার্লক সবসময় পর্যবেক্ষণশক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছে। আমরাও যদি নিজস্ব পর্যবেক্ষণশক্তির মাধ্যমে কোনো তথ্য সম্পর্কে জানি বা জ্ঞান লাভ করি, সেটির স্থায়িত্ব আমাদের মস্তিষ্কে দীর্ঘস্থায়ী হবে। নিজেদের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকার ফলেই সহজে আমরা বিষয়টি ভুলতে পারব না, এমনকি ভোলার চেষ্টা করলেও না!
সবশেষে চলুন আলোচনা করা যাক শার্লক হোমসের সেই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে, যা তার সুহৃদ ওয়াটসনকে বিস্মিত করেছিল। আসলেই কি পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে জাতীয় তথ্য মনে রাখা অপ্রয়োজনীয়? বিষয়টি আসলে আপেক্ষিক। কেউ কেউ শার্লকের সাথে ঐক্যমত পোষণ করে বলতেই পারেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, কী হবে এসব অপ্রয়োজনীয় তথ্য জেনে!” কিন্তু একটু বাস্তবসম্মতভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, বর্তমান সমাজে গুটিকতক ব্যক্তি ছাড়া আর সবাইকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গরাও একটি পর্যায় পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করেছেন। সুতরাং নিজের দক্ষতা ও মেধাকে পূর্ণাঙ্গ বিকশিত করে তোলার আগ পর্যন্ত আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে অস্বীকার করতে পারি না। সে পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমাদের অর্জন করতেই হবে, এবং সেজন্য এমন অনেক তথ্যও নিজেদের মস্তিষ্কে ধারণ করতে হবে, যেগুলো না করলেই নয়।
কিন্তু হ্যাঁ, কলেজের চৌকাঠ ডিঙানোর পর, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও কি কার বাবার নাম কী, কার জন্মদিন কবে জাতীয় তথ্য দিয়ে নিজের সীমিত মস্তিষ্কের অমূল্য ফাঁকা জায়গা নষ্ট করা সমীচীন? কখনোই না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমাদের কাজ হলো বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করা, নিজেদের আগ্রহের বিষয়ে নিজেদেরকে আরো সমৃদ্ধ করে তোলা, যাতে করে পরবর্তীতে ওই বিষয় সংশ্লিষ্ট কর্মজীবনে গিয়ে নিজেদের কাজে আমরা সর্বোচ্চ যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারি। কিন্তু এই যে বিসিএস সহ তথাকথিত চাকরি ও নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে অপ্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে নিজেদের মস্তিষ্ককে বোঝাই করা, যা প্রকৃত কর্মজীবনে কোনো কাজেই আসবে না, সেটি খুবই অবাস্তবসম্মত একটি বিষয়। এ ধরনের দিকনির্দেশনা বিহীন শিক্ষাব্যবস্থা কখনোই কোনো জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। বরং যারা প্রকৃত অর্থেই মেধাবী, তারাও চাকরি লাভের আশায় অহেতুক ও অপ্রাসঙ্গিক জ্ঞান অর্জন করতে গিয়ে নিজেদের মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতাকে এতটাই কমিয়ে দিচ্ছে যে, মূল কর্মজীবনে গিয়ে তাদের সৃজনশীল বা নতুন কিছু করার ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে। এভাবেই তারাও একটি জং ধরা সিস্টেমের অধীনে বৈচিত্র্যহীন ক্রীড়নকে পরিণত হচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা চাকরিজীবনে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়েও যে উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য অর্জন করে দেখাতে পারছে না, এর পেছনে আমরা অপরিকল্পিত ‘মগজ-কুঠুরিকে বোঝাই করা’ শিক্ষাব্যবস্থাকেই দায়ী করব।
শিক্ষাজীবন তো হলো, এবার একটু চোখ ফেরানো যাক ব্যক্তিজীবনের দিকেও। নিজেদের জীবনের যতটুকু ক্ষমতা আমাদের নিজেদের হাতে, সেটুকুরও কি আমরা সদ্ব্যবহার করছি? করছি না। নিজেদের অজ্ঞাতেই সীমিত মগজ-কুঠুরির অধিকাংশ আমরা বোঝাই করে ফেলছি অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান দ্বারা। একটু ভেবে দেখুন, চটকদার ম্যাগাজিন পড়ে কিংবা ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রলের সুবাদে আমরা জেনে যাচ্ছি কোন নায়িকা কার সাথে প্রেম করছে, কিংবা কোন চলচ্চিত্রকে পেছনে ফেলে কোন চলচ্চিত্র বক্স অফিসের শীর্ষে পৌঁছে গেল জাতীয় অবান্তর সব তথ্য। অবান্তর এই অর্থে যে, এসব জেনে আমাদের ব্যক্তিজীবনে কোনো লাভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার অফলাইনের গসিপ ও গীবতেও নিজেদের সময়ের একটা বড় অংশ আমরা ব্যয় করি। কার চাকরি গেছে, কে বসকে তেল দিয়ে প্রমোশন পেয়েছে এসব আলোচনায় আমাদের খুব বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহ। এতে করে নিজেদের মূল্যবান সময় তো নষ্ট হচ্ছেই, পাশাপাশি মগজ-কুঠুরির সীমিত জায়গারও অপচয় হচ্ছে। অথচ ওই সময়ে ফলদায়ক (productive) কোনো কাজ করে সময়ের সদ্ব্যবহার যেমন আমরা করতে পারি, তেমনই কোনো বই পড়ে বা তথ্যচিত্র দেখে নিজেদের মগজ-কুঠুরিতেও এমন সব তথ্য প্রবেশ করাতে পারি, যেগুলো বাস্তবিকই আমাদের কাজে আসবে। কিন্তু কেন আমরা তা করছি না, সেটি ভেবে দেখার এখনই সময়।
বিজ্ঞানের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/