এই যে নীল সমুদ্র, কত বিচিত্র প্রাণ, এর কতটুকু আসলে জানি আমরা? মুগ্ধ বিস্ময়ে নীল-সবুজের সৌন্দর্য তো আমরা নিয়ত দেখতে পাই, কিন্তু প্রকৃতির অদ্ভুত নির্মমতা কতটুকু দেখি? প্রকৃতির এই নির্মমতাই আসলে জীবনের পেছনের জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে বিগত সহস্র বছর ধরে। বুকে আকাশ বয়ে চলা সমুদ্রের মাঝের বিচিত্র দুটো প্রাণী নিয়ে আজকের এ আয়োজন।
সমুদ্রপোকা ওসেডাক্স
কখনো কি ভেবে দেখেছেন, সাগরের বুকে এই যে বিশাল তিমিদের দল মারা গেলে কী পরিণতি হয় এদের? যারা ভাবছেন, খুবই সহজ ব্যাপার, মরে গেলে সব কিছু তো পঁচেই যায়, এত বিশাল সব তিমি পঁচে যাওয়া কি খুব সহজ কথা? ভুলে গেলে চলবে না, সাগরের পানিতে সোডিয়াম ক্লোরাইড থাকে, কোনো কিছুর পচন রোধে যেটা বেশ সিদ্ধহস্ত! কী, দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন?
এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তাও নিতান্ত কম ছিল না। এজন্য তিমিরা সমুদ্রে যে পথ ধরে চলাফেরা করে, সেদিকে দীর্ঘদিন খেয়াল রেখেছেন তারা। এমন কিছু ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান তারা পেয়েছিলেন, যারা ‘কেমোট্রোফ’ (Chemotroph) পদ্ধতিতে তিমির হাড় থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। জারণ পদ্ধতি ব্যবহার করে জৈব বা অজৈব কোনো কিছু থেকে শক্তি সংগ্রহ করার প্রক্রিয়াকে বলে কেমোট্রোফ। যে ব্যাকটেরিয়ারা এ পদ্ধতিতে শক্তি সংগ্রহ করে, দেখা গেল, তারা শুধু তিমির হাড়ের উপরের দিকের সালফাইড সমৃদ্ধ আবরণের ব্যাপারেই আগ্রহী। তাহলে বাকি হাড়ের কী হয়?
এদেরকে সাবাড় করে জম্বি পোকারা!
Osedax worms নামে একধরনের সমুদ্রপোকা আছে, যাদের বিখ্যাত ডাকনাম হলো ‘জম্বি পোকা’! তাহলে এরাও কি আস্ত তিমিদেরকেই জম্বি বানিয়ে ফেলে নাকি? সায়েন্স ফিকশন মুভির গল্প হিসেবে চমৎকার হলেও বাস্তবে ব্যাপারটা আমাদের জন্য খুব সুখকর হতো না কিন্তু! জাহাজে চেপে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার কথা একেবারে ভুলে যেতে হতো।
না, এরা আসলে তিমিদেরকে জম্বি বানিয়ে ফেলে না। খাদ্য হিসেবে তিমির হাড়ের জন্য এরা বেশ বুভুক্ষু হয়ে থাকে দেখেই এমন নামকরণ। আসলে ল্যাটিন Osedax শব্দের মানেই হলো হাড়খেকো। তবে নাম শুনে যত জঘন্যই লাগুক, সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের জন্য এরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
কোনো তিমি মারা গেলে মৃতদেহ যখন সমুদ্রের তলদেশে আছড়ে পড়ে, তখন এই বুভুক্ষু সমুদ্রপোকারা ছুটে আসে। এদের দেহে মূলের মতো একটি অংশ আছে, যেটা ব্যবহার করে এরা তিমির হাড়ের উপর এসে স্থির হয়, তারপর পানিতে পাখার মতো ফুলকা ছড়িয়ে দিয়ে বসে যায়। দেখে মনে হবে চমৎকার কোনো ফুল ফুটেছে! এই সমুদ্রকীটদের কোনো মুখ বা পাকস্থলী নেই। আছে বিপুল পরিমাণে মিথোজীবি ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়ারা নিরাপদ আবাসের জন্য ওসেডাক্সের উপর নির্ভরশীল। কাজেই, ওসেডাক্স এদেরকে তিমির দেহে ছড়িয়ে দেয় এবং একধরনের এসিড ক্ষরণ করে। এই ব্যাকটেরিয়ারা এসিডের সাহায্যে ধীরে ধীরে তিমির হাড়কে ভেঙে গুঁড়ো করে ফেলে। ওসেডাক্স এই গুঁড়ো থেকে লিপিড শুষে নেয়।
মন্টেরি বে অ্যাকুরিয়াম রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (MBARI) মেরিন বায়োলজিস্ট শানা গোফ্রেডি এদেরকে নিয়ে বলেছেন,
মিথোজীবীতার দারুণ উদাহরণ এই ওসেডাক্সরা। মিথোজীবীতা এদের দেহে বিবর্তন ঘটিয়েছে, পরিবর্তন এনেছে, যাতে করে তারা আরো ভালোভাবে ব্যাকটেরিয়াদের সাথে মিলে থাকতে পারে।
শুরুর দিকে বিচিত্র দৈহিক গঠনের জন্য এদের প্রজাতি নির্ণয় করতে পারছিলেন না বিজ্ঞানীরা। পরবর্তীতে ডিএনএ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, বিশালদেহী টিউবওয়ার্মদের দূর-আত্মীয় এই ওসেডাক্সরা। প্রায় ৪২ মিলিয়ন বছর আগে এদের আবির্ভাব হয়েছে। মজার কথা হচ্ছে, বেশ কিছু সামুদ্রিক তিমির প্রজাতির আবির্ভাবও হয়েছে সেসময়ই।
এমবিআরআই- এর এক বিবর্তনবিজ্ঞানীর ভাষায়,
এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, এদের কথা আমরা কেবল জানতে পারলেও এরা কিন্তু নতুন কিছু না। অনেক আগে থেকেই তারা নিজেদের কাজ ঠিকঠাকভাবে করে যাচ্ছে।
এভাবেই ওসেডাক্স জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়, মিথোজীবি ব্যাকটেরিয়ারা পায় নিরাপদ আবাস। আর, বিশাল তিমির মৃতদেহ সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানে কোনো রকম সমস্যার সৃষ্টি না করেই বিলীন হয়ে যায় কালের গর্ভে।
ব্ল্যাক সোয়ালোয়ার: বিষ্ফোরক এক সমুদ্র দৈত্য
ব্ল্যাক সোয়ালোয়ার (Black Swallower) এই মাছটাকে এককথায় বলা যায় দুঃস্বপ্ন! আমাদের সৌভাগ্যই বলা যায়, এরা সমুদ্রের উপরিভাগে থাকে না। না হলে, এদের কাজকর্ম ঘুম হারাম করে দিত আমাদের।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা কিন্তু দৈর্ঘ্যে খুবই ছোট। সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্যই হয় এক ফুটের মতো, তবে বেশিরভাগের ক্ষেত্রে দৈঘ্যের পরিমাণ হয় ৬-৮ ইঞ্চি। কিন্তু মুখটা এদের প্রকান্ড। বিশাল সব শিকারকে অনায়াসে গিলে ফেলতে পারে। নিজেদের থেকে বিশাল কাউকে চট করে ঢুকিয়ে ফেলা তো সহজ কথা না। কাজেই, রেজর ব্লেডের মতো ধারালো দাঁত রয়েছে এদের। আর, একবার শিকার ঢুকে গেলে আর যেন বেরিয়ে আসতে না পারে, সেজন্য রয়েছে কাঁটাযুক্ত তালু। কিন্তু খালি গিললেই তো হবে না, জায়গাও তো দিতে হবে। ছোট্ট দেহের নিচে তাই একটি বেলুনের মতো পেট আছে এদের। দৈর্ঘ্যে প্রায় দ্বিগুণ এবং ভরের দিক থেকে নিজের দশগুণ যেকোনো মাছকে এরা আস্ত গিলে ফেলতে পারে! শিকারকে এরা ঠেসে পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে। একেবারে আস্ত আঁটানো চাই! আঁটানোর জন্য তীক্ষ্ণ দাঁত ব্যবহার করতে কোনো রকম কার্পণ্য করে না এরা।
শুনতে অদ্ভুতুড়ে মনে হলেও এদের কাজকর্মের পেছনের ব্যাপারটা আসলে খুব সরল। এরা থাকে আটলান্টিক মহাসাগরের ট্রপিক্যাল এবং সাবট্রপিক্যাল অংশে, সমুদ্রের ব্যাথিপেলাজিক অঞ্চলে (Bathypelagic zone: সমুদ্র পৃষ্ঠতল থেকে ৩,৩০০ থেকে ১৩,০০০ ফুট নিচে)। কালিগোলা এই গভীর পানিতে খুব সহজে শিকার পাওয়ার উপায় নেই। এরা তাই একবারে পুরোটুকু খেয়ে নিয়ে সেটাকে জমিয়ে রেখে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সংরক্ষণ করার চেষ্টা করে।
কিন্তু সবসময় ব্যাপারটা এত শান্তিপূর্ণ হয় না এদের জন্য। সবকিছুর একটা সীমা আছে তো! খাদ্যের পরিমাণ অতিরিক্ত বেশি হলে যথা সময়ে এরা পুরো খাবার হজম করতে পারে না। তখন এই খাবার পঁচতে শুরু করে, যার ফলে গ্যাস তৈরি হয়। এই গ্যাস পেটের মধ্যে চাপ দিতে থাকে। ফলাফল, ক্ষেত্রবিশেষে বিস্ফোরিতও হতে দেখা যায় ব্ল্যাক সোয়ালোয়ারকে! অনেক সময় বিস্ফোরণের ফলে ব্ল্যাক সোয়ালোয়ারের মৃতদেহ সমদ্রপৃষ্ঠে ভেসে ওঠে।
এই ভেসে ওঠা মৃতদেহ থেকেই এদের ব্যাপারে যা কিছুটা জানা গিয়েছে। যেমন- এদের ডিমের আকার হয় সাধারণত ১১ মি.মি. এর মতো। এবং জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝে পাওয়া মৃতদেহগুলোর পেটেই কেবল ডিম পাওয়া গেছে। তার মানে, এই সময়টাই তাদের প্রজননের সময়।
২০০৭ সালে তেমনি একটি মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল সমুদ্রপৃষ্ঠে। এর পেটে স্নেক ম্যাককেরেল নামে একটি মাছের দেহ পাওয়া গিয়েছিল, যার দৈর্ঘ্য ছিল ৩৪ ইঞ্চি, নিজের দৈর্ঘ্যের প্রায় সাড়ে চারগুণ!