আসুন প্রথমেই আমরা তিনটি অবস্থা কল্পনা করি।
কল্পনা ১
ধরুন, আপনি একটি চলচ্চিত্র উপভোগ করছেন। সেই চলচ্চিত্রে একটি দৃশ্য হচ্ছে একটি চরিত্র একটি ডিম খোসা ভেঙে ফ্রাই প্যানে তেলে ভেজে অমলেট করছেন। আপনার হঠাৎ ইচ্ছা হলো আপনি সেই দৃশ্যটি রিওয়াইন্ড করে দেখবেন। তাই আপনি রিওয়াইন্ড বাটনে চাপলেন এবং সেই দৃশ্যটির উল্টো দৃশ্য আপনি দেখলেন। অর্থাৎ ডিমটি অমলেট থেকে আস্তে আস্তে আগের আকার ফিরে পেলো এবং শেষে খোসাটা জোড়া লেগে গেলো এবং ডিমের কুসুম সহ সাদা অংশ সেই খোসার ভিতরে ঢুকে গেলো।
কল্পনা ২
ধরুন, আপনি কোনো মেকানিক্যাল ল্যাবে কাজ করছেন। গোছানো একটি কন্টেইনার থেকে অনেকগুলো মাপের বোল্ট থেকে একটি নির্দিষ্ট মাপের বোল্ট বের করে কাজে লাগাতে চান। নেয়ার সময়ে হাতের ধাক্কায় কন্টেইনারটি নিচে পড়ে গেলো এবং সমস্ত বোল্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো। আপনি চিন্তা করলেন, ইশ! যদি এখন সময়কে পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে বোল্টগুলো সহ কন্টেইনারটি আগের অবস্থায় উঠিয়ে আনা যেতো! তাহলে এখন সব খুঁজে খুঁজে বের করে নিজের হাতে সাজানো লাগতো না।
কল্পনা ৩
ধরুন, এই কল্পনার পৃথিবীতে সময় এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা সামনে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে যাচ্ছে। মানুষেরা সামনে যাওয়ার পরিবর্তে পিছনে যাচ্ছে। তখন বয়স না বেড়ে বরং কমে যাচ্ছে। মানুষ বয়স্ক অবস্থায় জন্ম নিচ্ছে এবং আস্তে আস্তে তাদের বয়স কমে তারা ছোট হয়ে যাচ্ছে, সমস্ত জানা জিনিস ভুলে যাচ্ছে এবং একটা সময় একদম ছোট্ট অবস্থায় বাবা মায়ের কোলে শুয়ে চোখ শেষবারের জন্য বন্ধ করে নিচ্ছে।
উপরের তিনটি দৃশ্যকল্পের মাঝে প্রথমটি সম্ভব, দ্বিতীয়টি অসম্ভব এবং তৃতীয়টি একেবারে অবাস্তব! কারণ আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বাস করি যেখানে সময় কখনো পিছিয়ে যায় না। কিন্তু কেন সময় কখনো পিছনে যায় না? কেন সময় শুধু সামনেই এগিয়ে যায়? কেন ডিমের সাদা অংশ সহ কুসুম আমরা আবার ফেরত পাই না? কেন ভাঙা হাড় যেভাবে ভেঙেছে তার উল্টোভাবে আবার ঠিক হয়ে যায় না? কেন আমরা শুধু অতীতকালের কথাই মনে করতে পারি, ভবিষ্যতের কথা কেন মনে করতে পারি না? ভেবেছেন কখনো? যদি ভেবে থাকেন তবে আজকের এই আয়োজন শুধুই আপনার জন্য!
কেন সময় শুধুই সামনে এগিয়ে যায়? কেন পিছনে যায় না? পদার্থবিদ্যার প্রতিটি সূত্র সময়ের সঙ্গে প্রতিসম। অর্থাৎ সূত্রগুলো সময় সামনে এগোলো নাকি পিছনে গেলো এর উপর নির্ভর করে না। যেমন, স্যার আইজাক নিউটনের গতি এবং মহাকর্ষজনিত সূত্রগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন সাধারণ-অসাধারণ ঘটনাবলিকে খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে। আমরা জানি, প্রতিটি ক্রিয়ার সমান এবং বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আমরা জানি, কেন আপেল নিচে পড়ে এবং পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরে। কিন্তু একটু চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাবো এই সূত্রগুলো সময় এগিয়ে যাওয়া বা পিছিয়ে যাওয়া– উভয়ক্ষেত্রেই খুব নিখুঁতভাবে কাজ করে। তাই আমরা যদি গুঁড়া দুধের সঙ্গে চিনি মিশাই, উল্টোভাবে চিনি কি আলাদা করা সম্ভব? না, সম্ভব নয়। কারণ একটু আগেই বলেছি প্রায় প্রতিটি সূত্র, সব সূত্র নয়।
একটি সূত্র আছে যা দ্বারা সময়ের একটি দিক আমরা পেতে পারি, যা বলছে সবসময় পিছনে যাওয়া সম্ভব নয়। এটি হচ্ছে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র। অনেক বিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে এই সূত্রটি বিবৃত করেছেন। সহজ ভাষায় সূত্রটি বলছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কিছু একটা স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় যাচ্ছে। এই একটিমাত্র সূত্র যা কোন কিছুর পিছনে যাওয়াকে সমর্থন করে না। এই সূত্রটির জন্য আমরা পিছনে গিয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারি না। যখন আমরা গুঁড়া দুধের সঙ্গে চিনি মিশাই নি তখন তারা একটি সুশৃঙ্খল অবস্থায় ছিলো। যখনই আমরা এই দুটো একত্রে মিশালাম, তারা সুশৃঙ্খল অবস্থায় আর রইলো না। এই বিশৃঙ্খল অবস্থাকে বোঝানোর জন্য পদার্থবিদ্যায় যে শব্দটি ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে এনট্রপি।
সহজভাবে বলতে গেলে, যদি আমরা কোনো সিস্টেমে যেকোনো শক্তিকে ব্যবহার করে কাজে রূপান্তরিত করতে চাই, তাহলে আমরা পুরো শক্তিকে রূপান্তরিত করতে পারবো না। কিছু অংশ পরিবেশ বা সিস্টেম কর্তৃক শোষিত হবে বা হারিয়ে যাবে। এই শোষিত বা হারিয়ে যাওয়া শক্তির পরিমাণ হচ্ছে এনট্রপি। অর্থাৎ এটি যেহেতু একটি বিশৃঙ্খলতা তাই অন্যভাবে এই বিশৃঙ্খল অবস্থার পরিমাপই হচ্ছে এনট্রপি। বিশ্বে প্রতিনিয়ত এনট্রপি বাড়ছে অর্থাৎ সমস্ত কিছু স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বিশৃঙ্খল অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যেহেতু সময়ের সাথে এনট্রপি আমাদের বিশৃঙ্খলতার একটি পরিমাপ বা বিশৃঙ্খলতার তথ্য দিচ্ছে তাই উল্টোভাবে বলা যায়, এনট্রপি আসলে সময়ের তীরের দিক নির্দেশনাই দিচ্ছে!
ধরুন, আমরা একটি বাক্সের ভিতরে কোনো নির্দিষ্ট প্রকার গ্যাস রাখতে চাই। প্রথমেই সেই বাক্সের এক কোণায় বিশেষভাবে গ্যাসটির সব কণাগুলো রাখা হলো। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি, বাক্সের ভিতরে প্রথম অবস্থায় সুশৃঙ্খল অবস্থা বিদ্যমান। এখন যদি এটিকে এভাবেই রেখে দিই তবে গ্যাসের স্বাভাবিক ধর্ম অনুযায়ী, সময়ের সাথে কণাগুলো আস্তে আস্তে সমগ্র বাক্সটি দখল করবে, অর্থাৎ তা বিশৃঙ্খল অবস্থার দিকে ধাবিত হবে। আমরা যদি আবার কণাগুলোকে সেই কোণায় নিয়ে যেতে চাই তবে বাহির থেকে আমাদের শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া আবার সুশৃঙ্খল অবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। অর্থাৎ সময়ের সাথে সমস্ত কিছু সুশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বিশৃঙ্খল অবস্থার দিকে যায়, বা এনট্রপি বৃদ্ধি পায়। একই অবস্থা এই বিশ্বজগতেরও!
তাহলে দেখা যাচ্ছে, সময়ের দিক ব্যাখ্যার জন্য এনট্রপি খুব ভালো একটি ধারণা। আমরা এখন জানি সময় কেন সামনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা এখন বুঝতে পারি যে, সার্বজনীন একটি সময় আছে। কিন্তু একইসাথে একটি প্রশ্ন উঠে আসে। এই সার্বজনীন সময়ের শুরু আসলে কখন থেকে বা কোন ঘটনা থেকে। এই প্রশ্নের জবাবও এখন আমরা এনট্রপির ধারণা যদি ভালোভাবে বুঝে থাকি তবে খুব সহজেই দিতে পারি। যখন এনট্রপি আসলে শূন্য ছিলো অর্থাৎ সৃষ্টির শুরুতেই যখন বিগ ব্যাং (এক মহাবিষ্ফোরণ) হলো, ঠিক তখন থেকেই সময়ের বয়ে চলা শুরু হয়েছে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সময় সামনের দিকেই বয়ে চলেছে আর সময়ের সাথে সাথে বিশ্বজগতও সম্প্রসারিত হয়েই যাচ্ছে। বলুন তো, এই সার্বজনীন সময়ের অগ্রযাত্রা আসলে কত বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে? উত্তরটা হচ্ছে, ১৩.৮ বিলিয়ন বছর! অর্থাৎ ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
প্রতিটি জিনিসের শুরু এবং শেষ উভয়ই যদি থাকে, তাহলেও প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে– সময়ের শেষ কবে? অর্থাৎ কবে সময়ের সামনের দিকে বয়ে চলা শেষ হবে? সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি, যখন এনট্রপি একদম চূড়ান্ত মান গ্রহণ করবে অর্থাৎ বিশ্বজগত সর্বোচ্চ বিশৃঙ্খল অবস্থায় পৌঁছাবে। এই অবস্থা কিছু বিশেষ ব্যাপারের উপর নির্ভর করছে। আমাদের গ্যালাক্সির প্রধান একটি গাঠনিক উপাদান হচ্ছে ডার্ক এনার্জি। এই ডার্ক এনার্জি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এই হারে বাড়তে থাকলে হয়তো সুদূর ভবিষ্যতে একদিন বিশ্বজগত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে বিগ রিপ বিষ্ফোরণে। আবার ডার্ক এনার্জি যদি কোনো কারণে কমে যেতে যেতে একদম শূন্যের কাছাকাছি হয় তবে বিগ ব্যাং এর উল্টো বিগ ক্রাঞ্চ হতে পারে। এমনও হতে পারে বিশ্বজগত আজীবন সম্প্রসারিত হতেই থাকবে। আবার এমনও হতে পারে ডার্ক এনার্জির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে আরেকটি নতুন বিগ ব্যাং হতে পারে। তখন আমাদের এই পরিচিত সময় শেষ হয়ে নতুন সময় শুরু হতে পারে। আসলে অনেক কিছুই হতে পারে। সেদিনই আমরা বুঝতে পারবো, যেদিন আমরা ডার্ক এনার্জির আরো বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারবো।
তাহলে সত্যি সত্যি সময়ের এই সম্মুখ অগ্রযাত্রা কবে শেষ হতে পারে? সেটা সময়ই বলে দিবে!
ফিচার ইমেজ: businessinsider.com