বর্তমান বিশ্বে শুধুমাত্র মারণাস্ত্র থাকলেই পরাশক্তি হওয়া যায় না। পরাশক্তি হওয়ার জন্য শক্তিশালী অর্থনীতি ও সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি উন্নত আইটি সেক্টরও প্রয়োজন। আইটি খাতে যে দেশটি যত উন্নত, তাদের হাতের মুঠোতেই থাকবে বিশ্বে। যার বড় উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা শুধুমাত্র শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেনি। পাশাপাশি প্রযুক্তি খাতকে নিয়ে গেছে কল্পনারও বাইরে। এখন তারা এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। এই তো কিছুদিন আগেই চীনকে শায়েস্তা করার জন্য আমেরিকান কোম্পানি গুগল চীনা টেক জায়ান্ট হুয়াওয়ের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে। এতে করে বিশ্বজুড়ে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কেননা এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকরীভাবে প্রয়োগ হলে হুয়াওয়ের বড় ক্ষতি হবে।
আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুগলের মতো কোম্পানি রয়েছে বলেই চীনের মতো পরাশক্তিকে চোখ রাঙাতে পারছে। কারণ গুগল সমস্ত পৃথিবীকে এমনভাবে ছেয়ে ফেলেছে যে একজন মানুষের পক্ষ গুগলের কোনো সেবা কিংবা পণ্য ছাড়া একটি দিন অতিবাহিত করা খুবই কঠিন। প্রযুক্তিতে মার্কিনীদের এই আধিপত্য কমানোর জন্য তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা অনেক আগে থেকে চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এর মধ্যে রাশিয়া অন্যতম। সৌভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে আধিপত্য, তার প্রভাব কমাতে আইটি সেক্টরকে যে শক্তশালী করতে হবে সেটা ভ্লাদিমির পুতিন ভালোভাবেই জানেন। আর এজন্য রুশরা চেষ্টা করছেন মার্কিন টেক জায়ান্টগুলোর আদলে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে, যাতে তারা তাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোতে মার্কিন প্রযুক্তির আগ্রাসনে ছেদ টানতে পারে। এজন্য তারা তৈরি করেছে গুগল, অর্থাৎ রাশিয়ান গুগল, যার নাম ইয়ানডেক্স।
ইয়ানডেক্সের কী নেই! স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, অনলাইন ট্রান্সলেটিং, অনলাইন মার্কেটপ্লেস, ডিকশনারি এবং সর্বশেষ স্মার্ট স্পিকার। গুগলের বাইরে আর কোনো কোম্পানির এত সব প্রযুক্তি রয়েছে ভাবাই মুশকিল। এ কারণে ইয়ানডেক্সের কথা শুনে অবাক না হয়ে উপায় নেই। বিশ্বে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন রয়েছে। তবে একক আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছে গুগল। গুগলের পাশাপাশি মাইক্রোসফটের বিং ও চীনের বাইদু বেশ জনপ্রিয়। এর আগে রাজত্ব করেছে ইয়াহু। তবে গুগলের প্রতিদ্বন্দ্বী তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ইয়ানডেক্স। সিলিকন ভ্যালির গুগলের মতো রাশিয়ান গুগল ইয়ানডেক্সেরও যাত্রা শুরু নব্বই দশকের শেষভাগে। শুরুতে এটি ইয়ানডেক্স ডট আরইউ (Yandex.ru) নামে একটি হোমপেজ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মাধ্যমে রাশিয়ার টেক জায়ান্টে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু ইয়ানডেক্সের সম্পর্কে কয়জন মানুষ জানেন? খুব বেশি সংখ্যক মানুষ জানার কথা নয়। তবে এই না জানার পেছনেও কারণ রয়েছে। ইয়ানডেক্স এখনই বিশ্ব বাজারে গুগলের সাথে লড়াইয়ে নামতে রাজি নয়। তারা চাচ্ছে সবার আগে নিজ দেশে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে। গুগলের সাথে নিজের প্রতিষ্ঠানকে তুলনা করা হয় সেটা শুনে নিশ্চয়ই ভালো লাগার কথা ইয়ানডেক্সের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান আরকাডি ভলজ। কিন্তু তিনি ইয়ানডেক্সকে গুগলের চেয়েও এগিয়ে রাখতে চান। আরকাডি ভলজ বলেন,
পশ্চিমারা আমাদের রাশিয়ার গুগল বলে থাকে। কিন্তু আমরা এর চেয়েও অনেক এগিয়ে। আমরা রাশিয়ার উবার, আবার আমরাই রাশিয়ার স্পোর্টিফাই। এবং আমরা রাশিয়ার আরো অনেক কিছু।
বর্তমান সময়ে চার গিগাবাইট মোমোরির একটি ইউএসবি ড্রাইভের দাম আর কতই হবে! বড়জোর কয়েক ডলার। কিন্তু ১৯৯৭ সালে ইয়ানডেক্স যখন সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে যাত্রা শুরু করে তখন চার গিগাবাইট মেমোরির একটি হার্ডডিস্কের দাম ছিল কয়েক হাজার ডলার। এর মানে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ লগ্নি করেই ইয়ানডেক্সের মাঠে নামতে হয়েছে। তবে এর প্রতিদানও তারা পেয়েছে। শুরুতে এটি টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে আইটি জায়ান্টে রূপ নেয়। আর এই পরিবর্তনের পর ২০১১ সালে ১.৩ বিলিয়ন ডলার ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং (আইপিও) সংগ্রহ করে। অর্থের পরিমাণ গুগলের চেয়ে নেহাৎ কম নয়। একই সময়ে গুগল আইপিও সংগ্রহ করেছিল ১.৭ বিলিয়ন ডলার।
ইয়ানডেক্স রাশিয়ান কোম্পানি হলেও এর অনেক বড় বড় খেলোয়াড়ই অন্য দেশের। যাদের মধ্যে অনেকে আবার গুগল ও মাইক্রোসফটের রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট সামলেছেন। ইয়ানডেক্স নিজেদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী গুগলকেই মনে করছে। আর সেজন্য তারা নিজেদের সেভাবেই প্রস্তুত করছে। তবে এখনো তারা বিশ্ববাজারে গুগলকে টেক্কা দিতে রাজি নয়। এই বিষয়ে আইটি খাতে বিনিয়োগকারী ওলগা মাশলিকোভা বলেন,
ইয়ানডেক্স বিশ্ব বাজারে গুগলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করাকেই বেছে নিয়েছে। তারা রাশিয়াতে থাকা সুযোগগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। তবে ইয়ানডেক্স একটি পাবলিক কোম্পানি। তাকে নিজের মূল্য বাড়াতে হবে। এজন্য হয় তাদের ব্যবসাকে অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে, নয়তো নতুন নতুন পণ্য বা সেবা উদ্ভাবন করতে হবে।
মাশলিকোভার কথামতোই ইয়ানডেক্স নতুন নতুন সেবা চালু করছে। ২০১৭ সালে তারা মেশিন লার্নিং লাইব্রেরি চালু করছে। তারা চেষ্টা করছে একে ক্লাউড সার্ভিস হিসেবে প্রদান করতে, যাতে অন্যান্য কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য বা সেবার উন্নতি ঘটাতে পারে। ইয়ানডেক্সে মেশিন লার্নিংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মিখাইল বিলেঙ্কো। তিনি এর আগে মাইক্রোসফটে মেশিন লার্নিং নিয়ে কাজ করেছেন। বর্তমানে বিলেঙ্কো ইয়ানডেক্সের মেশিন লার্নিং বিভাগের প্রধান। তার অধীনে কাজ করছেন ডেভিড ট্যালবট, যিনি এর আগে গুগলে ল্যাঙ্গুয়েজ রিসার্চার হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি ইয়ানডেক্সের ট্রান্সলেট সার্ভিসের প্রধান।
ইয়ানডেক্স ইতোমধ্যে রাশিয়ার প্রযুক্তি বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থীদের নজর কেড়েছে। তারা এখন ইয়ানডেক্সে কাজ করার জন্য মুখিয়ে থাকে। পরবর্তীতে যারা ইয়ানডেক্সের হয়ে কাজ করবেন, তাদের ইয়ানডেঅক্সাইড (ইয়ানডেক্সে যারা কাজ করেন তারা নিজেদের এই নাম দিয়েছেন) হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ইয়ানডেক্স নিজেও আইটিকে রাশিয়ার শহর থেকে গ্রামে পৌঁছে দিচ্ছে। তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজে ছোট ছোট বাচ্চাদের প্রোগ্রামিং শেখাচ্ছে। এছাড়া ইয়ানডেক্স স্কুল অব ডেটা অ্যানালাইসিস ২০০৭ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে কোর্স করার সুযোগ দিচ্ছে।
ইয়ানডেক্স শুধু তরুণ ডেভেলপার ও অ্যানালিস্টদের দক্ষ করে তুলছে না। বরং তারা দেশের বাকি জনগোষ্ঠীকেও তাদের সাথে সম্পৃক্ত করছে। ইয়ানডেক্সের ‘তোলোকা’ প্লাটফর্মে চাইলে যে কেউ কোম্পানির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতিতে সাহায্য করে অর্থ আয় করতে পারেন। সেখানে শতাধিক পরীক্ষা রয়েছে। এগুলোতে শুধুমাত্র চোখ, কান ও মাথা খাটিয়ে অর্থ আয়ের সুযোগ রয়েছে। এজন্য কোনো ডিগ্রির প্রয়োজন নেই। তবে সাধারণ মানুষকে কোম্পানির সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য ইয়ানডেক্স আরো বেশ কিছু সার্ভিস চালু করেছে। তারা নারোডসায়া কার্টা নামক একটি প্রকল্প চালু করেছে। এটি মূলত তাদের ম্যাপ এডিটর (তাদের আগে থেকেই গুগলের মতো অ্যাপ রয়েছে)। এর সাহায্যে যেকোনো ব্যক্তি নিজ এলাকাকে ইয়ানডেক্সের ম্যাপে অন্তুর্ভুক্ত করতে পারবে।
ইয়ানডেক্সের উদ্ভাবন এখানেই শেষ নয়। তারা চেষ্টা করছে তাদের প্রযুক্তিকে পুরোপুরি মানুষের জীবনযাত্রার সাথে জুড়ে দিতে। ইয়ানডেক্স রাশিয়াতে স্বয়ংক্রিয় পিৎজা অর্ডার চালু করেছে। কারো যদি পিৎজা খেতে মন চায়, তাহলে পিৎজার দোকানে ফোন করে অর্ডার করতে হবে না। এর পরিবর্তে তাদের শুধু’ ইয়ানডেক্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট ‘এলিসাকে বলতে হবে। এরপর পাপা জন সেই অর্ডারটি নিশ্চিত করে তার কাছে পিৎজা পাঠিয়ে দেবে।
ইয়ানডেক্স শুধুমাত্র এআই-এর মতো জটিল বিষয় নিয়েই কাজ করছে না। পাশাপাশি তারা মানুষকে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করছে। ইয়ানডেক্স তাদের ম্যাপ ব্যবহারকারীদের ইমোজি ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। তারা চাইলে মস্কোর সবখানে ‘মলের’ ইমোজি দিয়ে ভরিয়ে ফেলতে পারেন। এছাড়া ইয়ানডেক্সের অটোপোয়েট রয়েছে। সেখানে বিখ্যাত কবিদের মতো করেই কবিতা লেখা যায়। এ রকম আরো অনেক সেবা চালু করেছে তারা। এবং ধীরে ধীরে রুশদের নাড়িনক্ষত্র সম্পর্কে অবগত হচ্ছে। কেননা বর্তমানে আমাদের সম্পর্কে বন্ধুদের চেয়ে বেশি জানে নিজের মুঠোফোন।
ইয়ানডেক্স রাশিয়াতে অভূতপূর্ব সাফল্য পেলেও এখনো তারা বৈশ্বিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। যদিও তারা লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়াতে তাদের ট্যাক্সি সার্ভিস চালু করেছে। পাশাপাশি যেসব দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল সেখানে জোরালো প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে ইয়ানডেক্সের তুরস্কের বাজারে প্রবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে মনে করছে, তুরস্কের মাধ্যমে তারা ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ইয়ানডেক্স সেটি অস্বীকার করেছে। ইয়ানডেক্স প্রধান আরকাদি ভলজ বলেছেন,
আমার কোম্পানি এখনই রাশিয়ার বাইরে কোনো সার্চ ইঞ্জিনের সাথে প্রতিযোগিতা করবে না। তবে একই সময়ে তারা নতুন নতুন সেবা উদ্ভাবন করারও বন্ধ করবে না।