মনে করুন, আজ থেকে ২০ বছর পর, ২০৪১ সালে এক মারণঘাতি হিটওয়েভ আঘাত হেনেছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। তখন কী হবে দেশটির অবস্থা? এবং কেনই বা চেন্নাই ও হায়দরাবাদ, এই দুই শহরের পরিস্থিতি হবে সম্পূর্ণ বিপরীত? সেই ভবিষ্যৎ বাস্তবতাকে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কল্পনার তুলিতে আঁকবার চেষ্টা করেছে বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ‘দ্য ইকোনমিস্ট’।
‘আ টেল অভ টু সিটিজ’ শীর্ষক সেই লেখাটির পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হচ্ছে রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।
জুন ২০৪১
ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লির পিচের রাস্তাগুলো সব গলতে আরম্ভ করেছে। দেশের ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম হিটওয়েভ যখন তৃতীয় সপ্তাহে প্রবেশ করেছে, তখন শহরের তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১২০.৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট)।
দক্ষিণের দাবদাহের মাত্রা অবশ্য আরো বেশি। সেখানে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। অন্ধ্র প্রদেশের শহর মারকাপুরে গত ২৩ জুন তাপমাত্রা ছিল রেকর্ড-ভাঙা ৫২.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তবে সঙ্কটের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে চেন্নাই। সেখানকার হাসপাতালগুলো ভরে উঠেছে গরমজনিত নানা রোগে আক্রান্ত মানুষে। জওহরলাল নেহেরু হাসপাতালের বাইরের চিত্রটা সবচেয়ে হৃদয়বিদারক। লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায়ই সূর্যের প্রখর উত্তাপে মৃত্যু হয়েছে ১১ জন মানুষের।
চেন্নাইতে সবচেয়ে বড় ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে যে জিনিসটি, তা হলো বাতাসের আর্দ্রতা। বাতাসের উষ্ণতা ও আর্দ্রতার সম্মিলিত মাত্রা পৌঁছে গেছে ‘ওয়েট-বাল্ব টেম্পারেচারে’, অর্থাৎ সর্বনিম্ন যে তাপমাত্রায় কোনো জিনিস শীতল হয় তার পৃষ্ঠের বাষ্পীভবনের মাধ্যমে।
শুষ্ক বায়ুতে, এমনকি ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তথা মানবদেহের চেয়ে বেশি তাপমাত্রায়ও, মানুষ শরীর ঠান্ডা করার জন্য ঘেমে থাকে। কিন্তু ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার অধিক ওয়েট-বাল্ব টেম্পারেচারে, “অধিকাংশ কায়িক শ্রমই অনিরাপদ হয়ে ওঠে,” বলছেন টেনেসির ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির একজন অ্যাটমোস্ফিয়ার ফিজিসিস্ট, মুতাসিম আশফাক।
৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অধিক ওয়েট-বাম্ব টেম্পারেচারে খুব কম মানুষই টিকে থাকতে পারে। বিগত দশকে, চেন্নাইয়ের ওয়েট-বাল্ব টেম্পারেচার নিয়মিতই ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠেছে। তবে গত এক সপ্তাহ যাবত, ওয়েট-বাল্ব টেম্পারেচার ঘন ঘনই পেরিয়ে যাচ্ছে চূড়ান্ত বিপদসীমা, ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
শুরুর দিকে, মৃতের পরিমাণ সীমাবদ্ধ ছিল একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে। কেবল যারা গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ কোনোভাবেই এড়াতে পারত না, বিশেষত শহরের গৃহহীন জনগোষ্ঠী যারা, তারাই মারা পড়ছিল। কিন্তু এয়ার কন্ডিশনিংয়ের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকার ফলে, তা একপর্যায়ে শহরের মোট বিদ্যুতের জোগানকে ছাড়িয়ে যায়। এর ফলে গোটা শহর বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। ফলে যাদের বাসায় বা অফিসে জেনারেটর নেই, তারাও দাবদাহের শিকার হতে শুরু করে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, হিটওয়েভ শুরুর পর থেকে চেন্নাইতে গরমজনিত রোগে মারা গেছে ১৭,৬৪২ জন। এ সংখ্যাটি দেশের মোট মৃতের সংখ্যার (৫২,৩৪৮) এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। এই সকল পরিসংখ্যানই বেশ বিস্ময়কর। তবে আপনাদের বিস্ময়ের মাত্রা আরো ছাড়িয়ে যাবে তখন, যখন জানতে পারবেন নিকটস্থ হায়দরাবাদ শহরের ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতার কথা।
চেন্নাই ও হায়দরাবাদ, এই দুই শহর ও তাদের আশেপাশের এলাকার তাপমাত্রাই প্রায় একই রকম। এদিকে উভয় শহরেরই জনসংখ্যা ১০ মিলিয়নের মতো। অথচ হায়দরাবাদে এখন পর্যন্ত নিবন্ধিত মৃতের সংখ্যা মাত্র ২৬, যা দক্ষিণ ভারতের অন্য যেকোনো শহরের চেয়ে ঢের কম।
দুই শহরের মধ্যকার এই তফাতের চিত্র চোখ এড়ায়নি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও। যেমন চেন্নাইয়ের মেয়র রামানাথ শ্রীনিবাসন এ সপ্তাহে বলেছেন, “হায়দরাবাদ যা-ই করছে, তা-ই কাজে লাগছে।”
বস্তুত, হায়দরাবাদ হলো হিটওয়েভ প্রশমনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা বড় শহরগুলোর একটি। এবং এক্ষেত্রে আমরা শুধু ভারতের কথাই বলছি না, পুরো বিশ্বই এখানে বিবেচ্য।
তাই স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, হায়দরাবাদ আসলে তাদের গৃহীত পদক্ষেপের কোন জায়গাতে ভিন্নতা এনেছে?
ভারতের বর্তমান হিটওয়েভটি মূলত বেশ কয়েকটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার সম্মিলিত রূপ।
পাকিস্তান থেকে প্রবাহিত অস্বাভাবিক রকমের শক্তিশালী উত্তর-পশ্চিমা বায়ুর ফলে বঙ্গোপসাগরের আর্দ্র বায়ু উপমহাদেশের মূলভূমিতে প্রবেশ করতে পারছে না। এর ফলে, এ অঞ্চলের চিরাচরিত প্রাক-মৌসুমী বৃষ্টিপাত এবার আর তেমন একটা জুত করে উঠতে পারেনি। তাই দক্ষিণ ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলই থেকে গেছে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি শুষ্ক এবং তাপদগ্ধ।
এর পাশাপাশি আবার চলমান শুষ্ক মৌসুমের অভূতপূর্ব ব্যাপ্তিও (বর্ষা সাধারণত শুরু হয় জুন মাসের গোড়ার দিকে) ব্যাপারটিকে আরো জটিল করে তুলেছে। একটি শক্তিশালী এল নিনো (বায়ুমণ্ডলীয় এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের সমুদ্রগুলোর মাঝে একটি পর্যাবৃত্ত পরিবর্তন) ইফেক্ট তাপমাত্রাকে আরো ঊর্ধ্বমুখী করে তুলেছে।
প্রায় একই রকম একটি ঘটনার অবতারণা হয়েছিল ২৬ বছর আগে, যদিও সেবারের মাত্রাটা ছিল কম সাংঘাতিক। তখন থেকেই হায়দরাবাদ শুরু করে দেয় তাপমাত্রা কমানোর পেছনে নিজেদের উপর্যুপরি প্রচেষ্টা।
২০১৫ সালে এ শহর ও তেলেঙ্গানা রাজ্যে তাপমাত্রা ভয়াবহ রকমের বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মৃত্যু হয় অন্তত ৫৮৫ জন মানুষের। সেটিই ছিল হায়দরাবাদের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। দুর্ভাগ্য থেকে ঠেকে শেখা হায়দরাবাদ তখন থেকে পরিণত হয় শহুরে তাপমাত্রা প্রশমনের নিত্যনতুন কৌশল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার প্রাণকেন্দ্রে।
সাধারণত সিংহভাগ হিটওয়েভেই, সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা পরিলক্ষিত হয় বড় শহর, ছোট শহর, শহরতলী তথা শহুরে এলাকায়। এ ধরনের তাপমাত্রা হ্রাসের সহজতম পদ্ধতিগুলোর একটি হলো শহরপৃষ্ঠের প্রতিফলন ক্ষমতা বা ‘আলবিডো’ (albedo) বৃদ্ধি করা, বিশেষত বড় বড় দালানের ছাদে। একটি শহর থেকে যত বেশি সূর্যরশ্মির বিকিরণকে প্রতিফলনের মাধ্যমে সরিয়ে দেয়া যাবে, ওই শহরে তাপ উৎপাদনের জন্য তত কম সূর্যরশ্মির বিকিরণ অবশিষ্ট থাকবে। এই বিষয় নিশ্চিত করার জন্য ২০১৭ সালে হায়দরাবাদ সরকার শহরের একটি স্বল্প আয়ের এলাকায় ‘শীতল ছাদ’ প্রকল্প পরীক্ষা করে দেখে।
এর মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যায়, তা ছিল চোখ কপালে তোলার মতো। যেসব বাড়ির ছাদে একটি সস্তা, সাদা রঙের পলিথিনের কোটিং করা ছিল, সেসব বাড়ির অন্দরের তাপমাত্রা, পলিথিনের ছাদবিহীন বাড়িগুলোর চেয়ে, গড়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস শীতল ছিল।
এমন সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে, ২০১৯ সালে তেলেঙ্গানা সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় গোটা রাজ্যব্যাপী শীতল ছাদ প্রকল্প বাস্তবায়নের। তারা বাণিজ্যিক ও সরকারি ভবনগুলোতে, পাশাপাশি সরকার প্রদত্ত কম দামি বাড়িগুলোতে, শীতল ছাদের ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করে। ২০১৭ সাল নাগাদ হায়দরাবাদের ৮,০০০-এরও বেশি দালানে শীতল ছাদ লাগানো সম্পন্ন হয়।
ইউনিভার্সিটি অভ হায়দরাবাদের এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, এই সকল উদ্যোগ সম্মিলিতভাবে শহরের আউটডোর তাপমাত্রাকে ২০২০-র দশকের শুরুর দিকের তুলনায় অন্তত ০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। শুনতে হয়তো এই সংখ্যাটি খুব আহামরি কিছু মনে হচ্ছে না, কিন্তু এই সামান্য একটি পরিবর্তনই কিন্তু অনেক বড় ধরনের পার্থক্য গড়ে দিতে পারে, যার বাস্তব উদাহরণ আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি চেন্নাইতে।
২০৩০-র শুরুর দিক পর্যন্ত চেন্নাইতে ভয়াবহ কোনো হিটওয়েভ দেখা যায়নি, কেননা শহরটির অবস্থান সমুদ্রের বেশ কাছাকাছি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শহরটিতে হিটওয়েভ কেবল নিয়মিত বিরতিতেই দেখা যাচ্ছে না, পাশাপাশি সেই হিটওয়েভের তীব্রতাও অনেক বেশি বেড়ে গেছে। আর এর কারণ তো আমাদের সকলেরই অনুমেয়, জলবায়ু পরিবর্তন।
চলমান হিটওয়েভ আমাদেরকে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ভবিষ্যতে আরো কী কী ঘটতে পারে, কিংবা ঘটতে চলেছে। যদিও বর্তমান বিশ্ব ২০৬২ সালের ভেতর নেট-জিরো কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে সঠিক পথেই এগোচ্ছে, তারপরও অতীতে যত কার্বন নিঃসরিত হয়েছে সেগুলোর প্রভাব আরো কয়েক দশক ধরে টের পাওয়া যাবে। প্রাণঘাতী হিটওয়েভের পরিমাণও আরো বৃদ্ধি পাবে, এবং তারা আরো ঘন ঘন দেখা দিতে থাকতে। আগামী শতক পর্যন্ত এই হিটওয়েভ ধাওয়া করবে আমাদের।
বিজ্ঞানীরা এসব ব্যাপারে অনেক আগে থেকেই অবগত ছিলেন। সেই ২০২০-র দশকের শুরুর দিকেই বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা জারি করেছিলেন যে ২১০০ সালের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া এবং চীনের কিছু অঞ্চলে ভয়াবহ উচ্চ তাপমাত্রা খুব স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হবে। অথচ তারপরও, হিটওয়েভের ফলে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির কথা শুনলে এখনও বিস্মিত হওয়ার ভান করেন অনেকে নীতিনির্ধারক।
তাপমাত্রা প্রশমনের জন্য হায়দরাবাদ যে ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে, সেরকম আর খুব কম শহরকেই নিতে দেখা গেছে। আর তার পরিণাম বা ফলাফলও এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সৌভাগ্যের কথা এই যে, বিলম্বে হলেও যেকোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। হয়তো বিশ বছর আগেই যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো গৃহীত হতো, তা হতো সর্বোৎকৃষ্ট। তবে তখন তা না হলেও, দ্বিতীয় সর্বোৎকৃষ্ট সময় এখনই!