৫ নভেম্বর, ২০১৮। মানব সভ্যতার ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক পূর্ণ হওয়ার দিন। ৪১ বছর টু মাস ১৬ দিনের মাথায় সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাশূন্যে পা রেখেছে ভয়েজার টু। তবে, প্রায় মাসখানেক আগে পা রাখলেও সে তথ্য হাতে পৌঁছাতে এবং বেশ কিছু জিনিস পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে সময় লেগেছে। নিশ্চিত হবার পর গত ১০ ডিসেম্বর নাসা এ ব্যাপারে অফিসিয়াল ঘোষণা দেয়।
এর আগে কেবল একটি মহাকাশযানই সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পেরেছিল। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে প্রথম মহাকাশযান হিসেবে ভয়েজার ওয়ান এই মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।
ভয়েজারের যাত্রা
যাত্রার শুরুটা হয়েছিল সেই ১৯৭৭ সালের ২০ আগস্ট। প্রাথমিকভাবে ভয়েজার টু এর কাজ ছিল সৌরজগতের বাইরের দিকের গ্রহ বৃহষ্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন— এই চার গ্রহকে পর্যবেক্ষণ করা। আর পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া তথ্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা।
শুরুটা হয়েছিল বৃহষ্পতিকে দিয়ে। বৃহষ্পতি এবং এর উপগ্রহগুলোকে প্রদক্ষিণ করে তার মহাকর্ষকে কাজে লাগিয়ে নিজের গতি বাড়িয়ে নেওয়া এবং শনির দিকে ছুটে যাওয়া। আর যতটা সম্ভব সবকিছুর ছবি তুলে পাঠানো। এর আগে ভয়েজার ওয়ানও ঘুরে গিয়েছিল বৃহষ্পতিকে। এর পাঠানো ছবিগুলো কতটা নিখুঁত ছিল, সেটা যাচাই করে দেখাও ছিল এর কাজ। আরেকটা মূল্যবান উদ্দেশ্য ছিল- এটি যেহেতু কিছুটা সময় পরে গিয়েছে, তাই এই সময়ের মাঝে বৃহষ্পতির পরিমণ্ডল, আবহাওয়া ইত্যাদি কতটা পরিবর্তিত হয়েছে, তা বোঝার চেষ্টা করা।
দুটি কাজই সফলভাবে সম্পন্ন করে ভয়েজার টু পরবর্তী গন্তব্য শনিতে পৌঁছায়। এখানেও আগের মতোই কাজ ছিল। এর পরের গন্তব্য ইউরেনাস।
ভয়েজার টু এখন পর্যন্ত একমাত্র মহাকাশযান, যেটি ইউরেনাসকে প্রদক্ষিণ করেছে। খুব বেশি কিছু পাওয়া না গেলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ইউরেনাসের বুকে বয়ে চলেছে একটি ফুটন্ত পানির সমুদ্র। আরেকটি তথ্য বিজ্ঞানীদেরকে দারুণ চিন্তায় ফেলে দেয়। দেখা গেছে, মেরুর গড় তাপমাত্রা আর বিষুব অঞ্চলের গড় তাপমাত্রার পরিমাণ সমান। আরো জানা গেছে, এই গ্রহটিতে শনি গ্রহের চেয়েও শক্তিশালী একটি চুম্বকক্ষেত্র আছে। এদের পাশাপাশি ইউরেনাসের দশটি চাঁদ এবং দুটো বলয় আবিষ্কার করেছে ভয়েজার টু।
ইউরেনাসের মহাকর্ষের সাহায্য নিয়ে ভয়েজার টু ছুটে গিয়েছে এর পরবর্তী গন্তব্য নেপচুনে। এতেও ভয়েজার টু ছাড়া আর কোনো মহাকাশযান যায়নি। নেপচুনের প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটারেরও কাছ দিয়ে উড়ে গেছে ভয়েজার টু। আবিষ্কার করেছে পাঁচটি চাঁদ, চারটি বলয় এবং একটি ‘গ্রেট ডার্ক স্পট’। পাঁচ বছর পরে হাবল টেলিস্কোপের ছবি থেকে দেখা গেছে, ডার্ক স্পটটি আর নেই। এই গ্রহের একটি উপগ্রহের নাম ‘ট্রাইটন’। বইপড়ুয়াদের কাছে এই নামটি পরিচিত লাগতে পারে। কল্পবিজ্ঞান লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ছিল, ‘ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম’।
নেপচুনের মহাকর্ষের সাহায্য নিয়ে ভয়েজার টু আবারো ছুট দেয় সৌরজগতের সীমানাকে লক্ষ্য করে।
আমাদের গ্যালাক্সির যে অংশে সূর্যের অবস্থান এবং প্রভাব তার নাম হেলিওস্ফিয়ার। ভয়েজার ওয়ান এই হেলিওস্ফিয়ারের উত্তর দিকের হেমিস্ফিয়ার (northern hemisphere) ধরে ছুটে গিয়েছিল, আর ভয়েজার টু ছুট দিয়েছিল দক্ষিণ দিকের হেমিস্ফিয়ার (southern hemisphere) ধরে। আর আজকে আমরা জানি, ভয়েজার টু এই মিশনেও সফল হয়েছে। এখন এটি সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে ছুটে চলেছে আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাশূন্যে।
ভয়েজার মিশনে কর্মরত বিজ্ঞানী জাস্টিন ক্যাস্পার এ প্রসঙ্গে বলেন,
একটি মহাকাশযান যদি এমন সাফল্য পেতো তাহলে বলা যেত লাক বাই চান্স। মানে, একবার তো ভাগ্যক্রমে হয়ে যেতেই পারে! কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাকভাবে কাজ করে দ্বিতীয় আরেকটি মহাকাশযানের এমন সাফল্য অর্জনের মানে হচ্ছে, আমরা আসলেই আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাশূন্য অনুসন্ধান করার মতো যোগ্য একটি সভ্যতায় পরিণত হয়েছি।
বর্তমান অবস্থান
সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়ার তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে Plasma Science Experiment (PLS) এর মাধ্যমে। ভয়েজারের চারপাশে ঘুর্ণায়মান ক্ষুদ্র কণারা কোনদিক থেকে আসছে এবং কেমন বেগে ছুটে যাচ্ছে— এ ধরনের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা এর কাজ। এ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নভেম্বরের ৫ তারিখে ভয়েজারের চারপাশে সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা কণাদের পরিমাণ শূন্যের ঘরে নেমে গিয়েছে। সেদিন একইসাথে গ্যালাক্টিক মহাজাগতিক রশ্মির পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
আরো জানা গেছে, প্লাজমা নামের যন্ত্রটির চুম্বকক্ষেত্রও অনেক বেড়ে গিয়েছিল, এবং হিসেব অনুযায়ী এ অবস্থায় যন্ত্রটি সৌরবায়ু (সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা কণা)-র পরিমাণ মাপা বন্ধ করে দেওয়ার কথা। ঠিক এটিই হয়েছে বলে নিশ্চিত হয় নাসা। এরপর ঘোষণা দেয় অফিসিয়ালি।
গোল্ডেন রেকর্ড
ভয়েজার সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে ছুটে চলেছে, এটি নিয়ে রোমাঞ্চিত হওয়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ আছে। এটি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে গোল্ডেন রেকর্ড। জনপ্রিয় বিজ্ঞান উপস্থাপক ও মহাকাশবিদ কার্ল সেগানের নেতৃত্বে নাসার একটি দল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পাইওনিয়ার টেন, পাইওনিয়ার ইলেভেন, ভয়েজার ওয়ান এবং ভয়েজার টু তে এমন একটা জিনিস সাথে করে দিয়ে দেওয়া হবে, যাতে আনঃনাক্ষত্রিক কোনো সভ্যতার জন্য বার্তা লেখা থাকে।
সেই জিনিসের মলাট হিসেবে স্বর্ণের ফলকে খোদাই করে সৌরজগতের একটি মডেল এবং মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে আমাদের অবস্থান চিহ্নিত করা ছিল। সেই সাথে আঁকা ছিল হাইড্রোজেন পরমাণুর গঠন। এ ছাড়াও এতে ইলেকট্রোপ্লেটিংয়ের মাধ্যমে বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম-২৩৮ যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। এটি তেজস্ক্রিয় ঘড়ির মতো করে কাজ করে, ফলে এ থেকে ভয়েজার টু এর যাত্রা শুরুর সময় নির্ণয় করা যায়। আন্তঃনাক্ষত্রিক কোনো সভ্যতা যদি থাকে আর তারা যদি জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত হয় তাহলে এটি পেলে হয়তো বুঝতেও পারে পারে এর মর্ম।
আর ভেতরে ৫৫টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় অভিবাদন রেকর্ড করা ছিল। সাথে ছিল পৃথিবীর বেশ কিছু প্রাকৃতিক শব্দ, মানুষের হৃৎপিণ্ডের ঢিপ ঢিপ শব্দ ইত্যাদি। বিথোভেন, চাক বেরি সহ বেশ কয়েকজন বিখ্যাত গায়কের গানও ছিল এতে। মানুষের ডিএনএ, ভ্রুণ, বাচ্চা জন্ম নেওয়ার ছবিসহ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, খেলাধুলা, সমাজ-সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে বেশ কিছু ছবিও ছিল।
এ ব্যাপারে কার্ল সেগান বলেছিলেন-
আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাশূন্যে যদি মহাকাশযান বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত কোনো সভ্যতা থাকে, তবেই কেবল এই মহাকাশযানটির পথচলায় বাধা পড়বে এবং রেকর্ডটি বাজবে।
এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বাইরে কোন জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়নি। উন্নত সভ্যতা তো অনেক দূরের প্রশ্ন। কাজেই, এমন সম্ভাবনা কম। তবে একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। গোল্ডেন রেকর্ড ভিন্ন কোনো সভ্যতার প্রাণীদের হাতে পড়ুক বা না পড়ুক, মানব সভ্যতার চিহ্ন এবং বিভিন্ন উপরণ বুকে নিয়ে ভয়েজার টু সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তঃনাক্ষত্রিক স্থানের মাঝ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে, এই ব্যাপারটা চিন্তা করলেই রোমাঞ্চ বোধ হয়।