কলকারখানা, নির্মাণাধীন ভবন কিংবা সংস্কারাধীন সড়কে আমরা প্রায়ই একটি বিশেষ ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার দেখে থাকি, যেটা দিয়ে খুব সহজেই ভারী জিনিসপত্র বা কাঁচামাল উঠিয়ে এক স্থান থেকে কাছাকাছি অন্য কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। অতি প্রয়োজনীয় এই যন্ত্রটির নাম ফর্কলিফট। অনেকের কাছে এটি লিফট ট্রাক, জিটনি, ফর্ক ট্রাক কিংবা হোয়েস্ট নামেও পরিচিত।
সাধারণ অর্থে ফর্ক বলতে আমরা কী বুঝে থাকি? কাঁটা চামচ। কাঁটা চামচ দিয়ে আমরা প্লেটের খাবার মুখ পর্যন্ত তুলে আনার কাজটাই করি। এই চামচে করে খাবার খুব বেশি দূরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বটে, কিন্তু কেবল ঐ খাবারটুকু তোলার জন্যই এর সুবিধাটা অতুলনীয়। ফর্কলিফটের কাজও অনেকটা খাবার টেবিলে ব্যবহৃত এই কাঁটা চামচের মতোই। এর সাহায্যে কোনো ভারী জিনিস অনেক দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু শিল্প-কারখানা কিংবা অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক সময় ভারী জিনিসপত্র মাত্র কয়েকশো মিটার দূরত্ব পর্যন্তও স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়। আর সেই স্থানান্তরের কাজটি অনায়াসে করা সম্ভব হয় এই ফর্কলিফটের কল্যাণেই।
মানুষের ফর্কলিফট ব্যবহারের ইতিহাস কিন্তু খুব নতুন নয়। আজকে আমরা যে আধুনিক ফর্কলিফট দেখি, তার ধারণা প্রথম এসেছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। এর আগ পর্যন্ত মানুষ নিত্যপ্রয়োজনে হাতে পরিচালিত বিভিন্ন উত্তোলক যন্ত্র ব্যবহার করত, যার মাধ্যমে অনেক কষ্টে ভারী যন্ত্রপাতি বা উৎপাদনের কাঁচামাল উপরে তোলা ও স্থানান্তর করা যেত।
কিন্তু এই যে উত্তোলক যন্ত্রগুলো হাতে ব্যবহৃত হতো, সেটা দেখেই উদ্ভাবনী চরিত্রের মানুষেরা চিন্তাভাবনা করতে শুরু করে যে, কোনোভাবে যন্ত্রগুলোকে যদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত করা যায়, তাহলে শারীরিক কষ্ট আর পরিশ্রম অনেকটাই লাঘব করা সম্ভব হবে।
১৯০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রেইলরোড তাদের অ্যাল্টুনা ট্রেইন স্টেশনে প্রথম ব্যবহার শুরু করে ব্যাটারি পরিচালিত একধরনের প্ল্যাটফর্ম ট্রাক, যা দিয়ে যাত্রীদের ভারী বোঝা ও মালামাল ওঠানো-নামানো এবং সরানো যেত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফর্কলিফটের ধারণাটি আরও উন্নত হয়। সেসময় থেকেই যুক্তরাজ্যে ইপসুইচের র্যানসম, সিম ও জেফরিরা বিভিন্ন ধরনের হাত দিয়ে পরিচালিত নড়ানো-সরানোর যন্ত্রের উন্নতি ঘটাতে শুরু করে। এর নেপথ্যের কারণ ছিল পর্যাপ্ত জনবলের অভাব। ভারী কাজগুলো ইতিপূর্বে মানুষ নিজেরাই করলেও, বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কম মানুষ দিয়ে বেশি কাজ করানোর চ্যালেঞ্জ সামনে আসে। সেসময় উদ্ভাবকেরা বিকল্প কিন্তু আরও সুবিধাজনক কোনো স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র নির্মাণের ব্যাপারে গুরুত্ব সহকারে কাজ করতে থাকেন।
১৯১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্ক কোম্পানি তাদের কারখানায় স্বয়ংক্রিয় ট্রাক্টর ও লিফট ট্রাক্টর প্রস্তুত করতে শুরু করে। এরপর ১৯১৯ সালে টো-মটর কোম্পানি এবং ১৯২০ সালে ইয়েল অ্যান্ড টাউনি ম্যানুফ্যাকচারিং যুক্তরাষ্ট্রের লিফট ট্রাকের বাজারে প্রবেশ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলেও, ফর্কলিফটের ক্রম-উন্নয়ন এবং ব্যবহারের বিস্তৃতি পুরো ১৯২০ ও ১৯৩০ এর দশক জুড়েও অব্যাহত থাকে। প্রথমে হাইড্রোলিক পরিচালিত ফর্কলিফট, এরপর বিদ্যুৎ পরিচালিত ফর্কলিফট এবং ১৯৩০ এর দশকের শেষ পর্যায়ে প্যালেটের ব্যবহার ফর্কলিফট ট্রাকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে দেখা যায়, এবার বিভিন্ন কাজে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের চেয়েও অনেক বেশি করে ফর্কলিফট ট্রাকের প্রয়োজন পড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও, বিভিন্ন ওয়্যারহাউজে মালামাল সংরক্ষণের জন্য উন্নততর ফর্কলিফটের চাহিদা সৃষ্টি হয়। তখন কলকারখানাগুলোর উৎপাদন বাড়ছিল, সেইসাথে জায়গা বাঁচানোর জন্য ওয়্যারহাউজগুলোর উচ্চতাও বৃদ্ধি করা হচ্ছিল। ফলে মানুষের এমন ফর্কলিফটের প্রয়োজন পড়ে, যা দিয়ে আরও ভারী বোঝা বহন করা যাবে, এবং আরও বেশি উচ্চতায় ওঠানো যাবে। সেই প্রয়োজন মেটাতেই নতুন নতুন মডেলের ফর্কলিফটের আবির্ভাব ঘটতে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ১৯৫৪ সালের কথা। তখন ল্যানসিং বাগন্যাল নামক একটি ব্রিটিশ কোম্পানি প্রথম ‘ন্যারো আইল ইলেকট্রিক রিচ ট্রাক’ প্রস্তুত করে। এর ফলে ওয়্যারহাউজের নকশায় আমূল পরিবর্তন আসে। মধ্যস্থিত আইলগুলোর (করিডোর) দূরত্ব আরো কমতে থাকে, অর্থাৎ সংকুচিত হয়ে যায়। সেইসাথে উল্লম্ব উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিকভাবে তাদের ধারণক্ষমতা অনেক বেশি বেড়ে যায়।
কিন্তু ফর্কলিফটের বহনযোগ্যতা ও উত্তোলনের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে, এর অপারেটর বা চালকের নিরাপত্তা একটি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মালামাল উত্তোলন করতে গিয়ে অপারেটরের জীবন যেন শঙ্কার মুখে পড়ে না যায়, তা নিশ্চিত করতে ফর্কলিফটের সাথে বিভিন্ন সেফটি ফিচার যেমন লোড ব্যাকরেস্ট, অপারেটর কেজ ইত্যাদি যুক্ত করা হতে থাকে।
১৯৮০’র দশকের শেষ ভাগে এসে নতুন ধরনের ফর্কলিফটের নকশায় এরগোনমিক নকশার সংযুক্তি ঘটতে থাকে, যার ফলে অপারেটরের স্বাচ্ছন্দ্য ও উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনই দুর্ঘটনা ও হতাহতের আশঙ্কাও হ্রাস পায় উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৯০ এর দশকে ব্যবহারের পরিধি বাড়ার কারণে ফর্কলিফটের পারফর্মেন্সে কিছুটা ভাটা পড়তে শুরু করে, তখন বিভিন্ন দেশে ফর্কলিফট ব্যবহারবিধির নির্দিষ্ট মানদণ্ড তৈরি করা হয়।
নতুন শতকে এসি পাওয়ার, সেই সাথে ফুয়েল সেল প্রযুক্তির মাধ্যমে ফর্কলিফটের আরও উন্নতি ঘটে, এবং সেই উন্নয়ন চলমান রয়েছে এখনও পর্যন্ত। এখন মূলত ইঞ্জিন ও বিদ্যুৎ পরিচালিত ফর্কলিফট সবচেয়ে বেশি প্রচলিত।
ফর্কলিফট যে ভারী মালামাল বহন, উত্তোলন ও স্থানান্তর করে, তা তো আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি। কিন্তু এ কাজটি সে কীভাবে করে? সেজন্য ফর্কলিফটের রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু মেকানিজম। যেমন:
ট্রাক ফ্রেম: এটি একটি ফর্কলিফটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা যন্ত্রটির মূল ভিত্তি। হুইল, কাউন্টার-ওয়েট, মাস্ট ইত্যাদি জরুরি উপাদান ট্রাক ফ্রেমের অন্তর্ভুক্ত।
কাউন্টার-ওয়েট: এটি হলো লোহার একটি ওজন ব্যবস্থা যা ফর্কলিফটের সামনের দিকে সংযুক্ত থাকে। এর কাজ হলো ফর্কলিফটের উত্তোলিত বোঝার ওজন নিয়ন্ত্রণ করা। বৈদ্যুতিক ফর্কলিফটে লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি দিয়ে কাউন্টার-ওয়েট চালানো হয়।
পাওয়ার সোর্স: ফর্কলিফটের শক্তির উৎস হিসেবে থাকে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ কমবাস্টন ইঞ্জিন। এলপিজি, সিএনজি, ডিজেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয় এই ইঞ্জিনের জ্বালানি হিসেবে। বৈদ্যুতিক ফর্কলিফট শক্তি পায় ফুয়েল সেল বা লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি থেকে।
ক্যারেজ: এটিকে বিবেচনা করা হয় ফর্কলিফটের দ্বিতীয় ভিত্তি হিসেবে। মাস্ট রেইলের সাথে এটি জুড়ে দেওয়া হয়, যাতে করে সহজেই এটিকেই ওঠানো বা নামানো যায়।
মাস্ট: এটি ফর্কলিফটের উল্লম্ব অংশ যা কোনো জিনিসকে উপরে ওঠানোর সময় নিচ থেকে এবং নিচে নামানোর সময় উপর থেকে সেই জিনিসের উপর চাপ প্রয়োগ করে। মাস্টে থাকে ইন্টারলকিং রেইল, যার মাধ্যমে ফর্কলিফটের আনুভূমিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা যায়। ক্যারেজের মতোই, মাস্টও রোলার দিয়ে সজ্জিত থাকতে পারে।
ফর্কলিফটের হাইড্রোলিক সাধারণত নিয়ন্ত্রিত হয় লিভার দ্বারা হাইড্রোলিক ভালভকে নাড়াচাড়ার মাধ্যমে, কিংবা বৈদ্যুতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত অ্যাকচুয়েটরের মাধ্যমে, ছোট ছোট আঙুল সদৃশ লিভার ব্যবহার করে। এই অ্যাকচুয়েটর ফর্কলিফট ডিজাইনারদেরকে এরগোনমিক নকশা তৈরিতে বেশি সহায়তা করে।
বিভিন্ন বৈচিত্র্য ও ধারণক্ষমতার ফর্কলিফট পাওয়া যায় পৃথিবীজুড়ে। সাধারণত ওয়্যারহাউজে ব্যবহৃত ফর্কলিফটের ধারণক্ষমতা হয়ে থাকে এক থেকে পাঁচ টনের মধ্যে। তবে বন্দরে শিপিং কন্টেইনার উত্তোলনের জন্য এমনকি ৫০ টন ধারণক্ষমতার ফর্কলিফটও ব্যবহৃত হয়।
ফর্কলিফটের সামনের দিকে থাকে ফর্ক, যেটি দিয়ে মালামাল উত্তোলন করা হয়। এটিকে অনেকে ব্লেডও বলে থাকে। একজন অপারেটর এই ফর্কটি ওঠানো-নামানো ছাড়াও প্রয়োজনে ডানে-বামে বা সামনে-পিছনে হেলাতে বা কাত করতেও পারে। তবে এক্ষেত্রে অপারেটরকে নিজের কাজে খুবই দক্ষ হতে হয়, কেননা ফর্কটি নাড়াচাড়ার সময় যেকোনো ভুল হলেই দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।
বিশ্বব্যাপী অসংখ্যা ফর্কলিফট প্রস্তুতকারক রয়েছে। কিন্তু শীর্ষস্থানটি দখল করে নিয়েছে টয়োটা ম্যাটেরিয়াল হ্যান্ডলিং কোম্পানি। জাপানে সেই ১৯৫৬ সাল থেকেই ফর্কলিফট নিয়ে কাজ করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তারা প্রথম ফর্কলিফট ডিলারশিপ শুরু করে। এবং ওই বছরই তারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম ফর্কলিফট বাজারজাত করে।
২০০০ সালে টয়োটা যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এসি পাওয়ার্ড প্রযুক্তি নিয়ে আসে, এবং গ্রাহকদের মাঝে সেটি এতই জনপ্রিয়তা পায় যে, দুই বছরের মধ্যেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক বিক্রিত ফর্কলিফট কোম্পানিতে পরিণত হয়। তারপর থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় কখনোই তারা শীর্ষস্থান হারায়নি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রিত প্রতি পাঁচটি ফর্কলিফটের মধ্যে একটিই টয়োটা নির্মিত।
বাংলাদেশের বাজারেও তারা আছে ফর্কলিফট প্রস্তুতকারকদের শীর্ষে। এমনকি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত সরঞ্জামের তালিকায়ও রয়েছে টয়োটা ফর্কলিফটের নাম। দেশেই এখন পাওয়া যাচ্ছে টয়োটার ইঞ্জিন পাওয়ার্ড ফর্কলিফট, ইলেকট্রিক পাওয়ার্ড ফর্কলিফট, রিচ ট্রাক, টো ট্রাক, হ্যান্ড প্যালেটস এবং অন্যান্য বিভিন্ন খুচরা সরঞ্জাম।
বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে টয়োটা ফর্কলিফটের এই শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে প্রধান কারণ হলো এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র ‘সিস্টেম অফ অ্যাকটিভ স্ট্যাবিলিটি’ অসুবিধা দিচ্ছে টয়োটাই। এছাড়া তারা অন্য আর সবার চেয়ে এগিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে সেরা মান নিশ্চিত করার কারণেই। পিয়ারলেস রিসার্চ গ্রুপের এক গবেষণার ফল অনুযায়ী, গুণগত মান, দীর্ঘস্থায়িত্ব, বিশ্বাসযোগ্যতা, মূল্যমান, স্বল্প মূল্য – বিবেচ্য সকল ক্ষেত্রেই টয়োটার অবস্থান এক নম্বরে।
তাছাড়া টয়োটা কেবল একটি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানই নয়, তারা স্বঘোষিত ‘ফুল লাইন সাপ্লাইয়ার’-ও বটে। অর্থাৎ তারা শুধু ফর্কলিফটই নির্মাণ করে না, পাশাপাশি নির্মাণ করে অবকাঠামো ও শিল্পক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অধিকাংশ আধুনিক যন্ত্রপাতিই, যেমন: ন্যারো আইল সলিউশন, ওয়াকি স্টকার, অটোমেটেড গাইডেড ভেহিকলস (এজিভি) ইত্যাদি। গাড়ির বাজারে যেমন আস্থার আলোচনায় টয়োটার নাম উচ্চারিত হয় সবার আগে, তেমনি ফর্কলিফটের মতো বিশেষায়িত যন্ত্রের ক্ষেত্রেও টয়োটার উপরই নির্ভর করা যায় চোখ বুজে।