সব মানুষের সমান মর্যাদা- এমন একটি পৃথিবীর স্বপ্ন আজও বাস্তবে পরিণত হয়নি। আমাদের দুর্ভাগ্য, এখনও নারী, পুরুষ আর তৃতীয় লিঙ্গের মাঝে আমরা সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যেই টিকিয়ে রেখেছি প্রকট বৈষম্য। যুগ যুগ ধরে চলে আসা নিপীড়নের সমাপ্তি এখনও টানতে পারিনি আমরা। পত্রিকা খুললেই দেখতে পাওয়া যায় যৌতুক, ধর্ষণ কিংবা যৌন নিপীড়নের খবর, বাড়ছে আত্মহত্যার হারও। এখনও আমাদের দেশে শহর হোক কিংবা গ্রামে, কাছের রাস্তা হোক কিংবা দূরপাল্লার যাত্রায়, মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি শতভাগ। চলন্ত বাসে ধর্ষণ, রাস্তা-ঘাটে, চলতি পথে ইভ টিজিং কিংবা আরও বিভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানি- এসব অমানবিক আচরণ থেকে এখনও নিস্তার মেলেনি এই দেশের নারীদের। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সত্যিই দরকার দেশের মানুষ এবং প্রশাসনিক দায়িত্বরতদের এগিয়ে আসা, দরকার একটি নিপীড়নবিহীন সমাজ বিনির্মাণ।
কিন্তু যতদিন পর্যন্ত আমরা নারীদের জন্য একটি নিরাপদ সড়ক ও যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারছি, ততদিন পর্যন্ত তো তারা আর ঘরে বসে থাকতে পারেন না, তারা তো কাজ-কর্ম বন্ধ করে দিতে পারেন না- এবং এভাবে ঘরে বসে থাকাটা কোনো কার্যকর সমাধানই নয়। তাহলে উপায়? উপায় অবশ্যই নারীদের যাতায়াতের জন্য এমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া, যাতে তারা নিয়মিত একাকী যেসব যাতায়াত করে থাকেন, সেগুলো যেন অন্তত নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ হয়। সরকারি উদ্যোগে যদিও নারীদের জন্য আলাদা বাস ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তবে তা সংখ্যায় খুবই নগণ্য, এবং এর ব্যপ্তিও একেবারে সীমিত। সেকারণেই প্রয়োজন সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা, প্রয়োজন সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগের সমাহার। আনন্দের কথা হলো, তেমনই একটি কাজে হাত দিয়েছেন ক’জন সাহসী উদ্যোক্তা, এবং খুব অল্প সময়ের মাঝেই তারা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, সত্যিই তারা দারুণ একটি যাতায়াত ব্যবস্থা তৈরি করতে চলেছেন।
দেশের মানুষ, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মানুষ এখন উবার কিংবা পাঠাওয়ের মতো অনেক অ্যাপলিকেশনের কারণে অ্যাপভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে ভালোভাবেই পরিচিত। এই একই রকম পদ্ধতি ব্যবহার করেই দেশে নারীদের যাতায়াত ব্যবস্থার সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছে ‘শাটল‘ (Shuttle) নামের প্রতিষ্ঠানটি। পূর্ব-নির্ধারিত পিক-আপ পয়েন্ট থেকে সর্বোচ্চ ১০ জন নারী যাত্রীকে গাড়িতে নিয়ে তাদেরকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমেই চলছে শাটলের কার্যক্রম। এর তিনটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো-
-
এটি কেবলই নারীদের জন্য।
-
এখানে আপনি সারাদিন যেকোনো সময় রাইড বুক করতে পারবেন অ্যাপের মাধ্যমেই।
-
শতভাগ নিরাপদ ট্রিপ নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি গাড়িতে থাকবে একজন দক্ষ ট্রিপ ম্যানেজার।
২০১৮ সালের জুলাইতে পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু করে শাটল। শুরুতে রাজধানীর কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে এর কাজ শুরু হয়। এরপর শাটলের তরুণ উদ্যোক্তারা যখন দেখেন যে, তারা দারুণ সাড়া পেতে শুরু করেছেন, তখন তারা একে নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা করেন এবং ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকেন নিজেদের কার্যক্রম। এই অল্প সময়ের মধ্যেই ৩,০০০ জনেরও বেশি সন্তুষ্ট গ্রাহক আছেন শাটলের। এরই মধ্যে সফলভাবে তারা দিয়ে ফেলেছেন ৫০ হাজারের বেশি ট্রিপ! এই মুহূর্তে শাটল চলছে ঢাকার ভেতরে ৭টি রুটে, দ্রুতই তারা কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন ঢাকার আরও অনেকগুলো জায়গায়।
শাটলের ট্রিপগুলো প্রতিদিন যায় নির্দিষ্ট রুট দিয়ে। থাকে নির্দিষ্ট পিক-আপ ও ড্রপ-অফ পয়েন্ট। আর কখন সেই পয়েন্টগুলোতে হাজির হবে গাড়ি, সেটিও আগে থেকে ইউজারদের জানানো থাকে।
যে তিনটি সুবিধা নিশ্চিত করতে মাঠে নেমেছে শাটল সেগুলো হলো-
-
আরামদায়ক ভ্রমণ
-
নিরাপদ ব্যবস্থা
-
ঝামেলামুক্ত যাতায়াত
যাত্রাপথের সময়টুকু যাতে আনন্দদায়ক হয়, সেজন্য শাটল সবরকম প্রস্তুতি নিয়েই কাজে নেমেছে। শাটলের মাইক্রোবাসগুলো আধুনিক, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এবং সিটগুলোও দারুণ আরামদায়ক।
আর নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি তারা দেখছে সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে। প্রতিটি ট্রিপেই সামনের সিটে থাকেন একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ট্রিপ ম্যানেজার। তিনিই পুরো ট্রিপ জুড়ে গাড়ির দায়িত্বে থাকেন, যাত্রীদের যেকোনো সমস্যা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজটির সামাল দেন তিনি। আর ড্রাইভার হিসেবে যারা আছেন, তারাও যে অত্যন্ত অভিজ্ঞ, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
চলুন জেনে আসা যাক, শাটল ব্যবহার করা কয়েকজন সন্তুষ্ট ইউজারের বক্তব্য। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী নিশাত সামা বলেন, “আজ প্রথম শাটল রাইড নিলাম, মোহাম্মদপুর থেকে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে। আমি সত্যিই তাদের সার্ভিসের ভক্ত হয়ে গিয়েছি। আমার ধারণা, তারা এখন যেভাবে শিডিউল আর সময়টা মেইনটেইন করছে, সেটা যদি ধরে রাখতে পারে, তাহলে শাটলের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। অবশ্যই সামনে আরও শাটল রাইড নেব আমি। শাটল টিমের জন্য শুভ কামনা।”
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাফিয়া রহমান জানান, “২০১৮ সালের সেরা ব্যাপারগুলোর একটি হলো শাটল।”
ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির আরেকজন ছাত্রী লিডিয়া ওয়াহাব তিথি বলেন, “জীবনটা এত সহজ করে দেবার জন্য ধন্যবাদ, শাটল! এ যেন ছদ্মবেশে আসা কোনো ফেরেশতা!”
সত্যিই, আমাদের শহরগুলো নারীর জন্য এখনও যে পরিমাণ অনিরাপদ, তাতে এমন কোনো যাতায়াত ব্যবস্থাকে এখানকার নারীরা আশীর্বাদ হিসেবেই দেখবেন, তা সহজেই অনুমেয়।
শাটলের উদ্দেশ্য হলো, দেশের একটি মেয়েও যেন একদিনও রাস্তাঘাটে যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে নিরাপত্তার অভাব বোধ না করে। নারীদের জন্য একটি নিরাপদ সমাজ তৈরি করার যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তারা কাজে নেমেছে, সেটা আসলেই সাধুবাদ পাওয়ার মতোই।
শাটলের বিষয়ে যেকোনো তথ্য জানবার জন্য ফোন দিতে পারেন সরাসরি 01885888868- এই নাম্বারে। এখানে ফোন দিয়ে বুক করতে পারবেন আপনার রাইডটিও। যদি আপনি একজন নারী হয়ে থাকেন যিনি খুঁজছিলেন এমনই একটা কিছু, তাহলে হয়তো আপনিও হয়ে যেতে পারেন শাটলের সন্তুষ্ট গ্রাহকদের একজন! আর যাত্রাপথে নিয়মিত যেতে যেতে বানিয়ে ফেলতে পারেন নতুন বন্ধুও!
ঘুরে আসুন শাটলের অফিশিয়াল ওয়েবপেজ থেকে। যুক্ত হতে পারেন তাদের ফেসবুক পেজেও। আর শাটলের ফেসবুক কমিউনিটি গ্রুপে জয়েন করতে চাইলে ঘুরে আসুন শাটল গ্রুপে। ভ্রমণ হোক নিরাপদ আর আনন্দময়!