আমাদের দেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রয়েছে কৃষির। কিন্তু কৃষিকাজের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদন কিংবা পশুপালনে আমাদের কৃষকদেরকে বড় ধরনের কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হলো মূলধনের। এবং যদি তারা মূলধন জোগাড় করতে পারেও, বিনিময়ে তাদেরকে দিতে হয় চড়া মূল্য।
এভাবেই বাংলাদেশের কৃষকদের সমস্যার চিত্র তুলে ধরছিলেন আই-ফার্মার এশিয়ার প্রধান নির্বাহী মো. ফাহাদ ইফাজ।
কৃষকদের এ সমস্যা কিন্তু একেবারে নতুন কিছু নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই অঞ্চলের কৃষকরা এমন অবস্থার সাথে পরিচিত চিরকাল। কৃষিকাজের জন্য মূলত দুটি জিনিসের দরকার হয়- একটি হলো জমি বা গবাদি পশু, অপরটি হলো চাষাবাদ বা পশুপালনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন। কিন্তু আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশের কৃষকরা ভুগে এসেছেন এই দুইয়ের সঠিক ভারসাম্যের অভাবে। কারো হয়তো জমি বা গবাদি পশু আছে কিন্তু নগদ মূলধন নেই। আবার কারো চাষাবাদ বা পশুপালনের জন্য নগদ মূলধন আছে, কিন্তু চাষের জমি বা গবাদি পশু নেই।
অতীতে অন্তত চাষাবাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৃষকেরা একটি সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন। সেই সমাধানের নাম বর্গাচাষ। ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ মতে, কোনো ব্যক্তি যখন কোনো জমির মূল মালিকদের নিকট হতে কোনো নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঐ জমি হতে ফসলের ভাগ দেওয়ার শর্তে জমি চাষাবাদ করেন, তখন এ ধরনের চাষাবাদকে বলে বর্গাচাষ।
ইতিহাসের সেই বর্গাচাষের ব্যবস্থা বিলুপ্ত হতে চললেও, কৃষক ও খামারিদের জন্য কৃষিকাজকে নতুন আঙ্গিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করে তোলার প্রয়াসে, অনেকটা বর্গা ব্যবস্থার অনুকরণেই নতুন একটি প্রযুক্তি নির্ভর প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়েছে আই-ফার্মার। একটি দারুণ পরিকল্পনার মাধ্যমে এখন বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাংলাদেশে চাষাবাদ ও পশুপালনে স্পন্সরশিপের সুযোগ সৃষ্টি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সহজ কথায় বলতে গেলে, আই-ফার্মারের মূল লক্ষ্য হলো একটি গোটা কৃষি সরবরাহ চক্র গড়ে তোলা। তারা কৃষিব্যবসায় আগ্রহী শহরের পৃষ্ঠপোষকদের গবাদি পশুপালনে স্পন্সরশিপের সুযোগ করে দিয়ে থাকে, যার মাধ্যমে কৃষক পায় সুদবিহীন মূলধন অর্জনের সুযোগ। এর মাধ্যমের একইসাথে শহরের পৃষ্ঠপোষকরা পাচ্ছেন একটি ব্যতিক্রমধর্মী আয়ের উৎস, আবার কৃষকও হচ্ছেন ঋণের বোঝা মুক্ত।
ধরা যাক, আপনি আপনার অর্থ আই-ফার্মারের সহায়তায় কোনো গবাদিপশুর খামারের কাজে লাগাতে চান। এক্ষেত্রে আপনাকে পার হতে হবে নিম্নোক্ত ধাপগুলো:
খামার বাছাই
প্রথম ধাপ হলো কতগুলো পশুর পেছনে অর্থ স্পন্সর করবেন সে সিদ্ধান্ত নেওয়া। আই-ফার্মারের ওয়েবসাইটের নমুনায় সরবরাহকৃত খামারগুলোর মধ্য থেকে যেকোনো একটি আপনাকে বেছে নিতে হবে, এবং সেই খামারের নির্দিষ্ট সংখ্যক পশুর পেছনে স্পন্সরশিপের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মূল্য পরিশোধ
দ্বিতীয় ধাপে আই-ফার্মারের সুরক্ষিত অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম অথবা ব্যাংক চেকের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সংখ্যক পশুর জন্য অর্থ পরিশোধ করতে হবে। অর্থপ্রাপ্তির পর আই-ফার্মার নিশ্চিত করবে যেন বাজার থেকে সর্বোৎকৃষ্ট মানের পশু নিয়ে আসা হয়। এরপর তারা কয়েকজন খামারিকে বাছাই করবে, যারা ওই পশুগুলোকে পালনের দায়িত্বে থাকবেন।
মালিকানার সনদপত্র
প্রতিটি পশুরই একটি স্বতন্ত্র নম্বর থাকবে এবং আই-ফার্মার আপনাকে আপনার ক্রয়কৃত পশুগুলোর রশিদ এবং ‘মালিকানার সনদপত্র’ প্রদান করবে। এছাড়া আপনাকে একটি অনলাইন ড্যাশবোর্ডের প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে, যেখান থেকে আপনি আপনার পশুর স্বাস্থ্য, বৃদ্ধি ও অন্যান্য বিষয়ের হালনাগাদ তথ্য জেনে নিতে পারবেন।
পশুপালন
পরবর্তী ১ বছর আই-ফার্মারের নিয়োগপ্রাপ্ত খামারিরা আপনার মালিকানাধীন পশুটিকে যত্ন সহকারে লালন-পালন করবেন। আপনার পশুর গুণগতমান ঠিক থাকছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে আই-ফার্মারের প্রতিনিধিরাও ঐ খামার নিয়মিত পরিদর্শন করবেন।
বিক্রি ও লভ্যাংশ
এভাবে প্রথম চক্রের সমাপ্তি ঘটলে, আই-ফার্মার কর্তৃপক্ষ আপনার হয়ে আপনার পশুগুলোকে বিক্রি করে দেবে এবং লভ্যাংশ আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেবে।
আই-ফার্মারের এই উদ্ভাবনী উদ্যোগ সকল শ্রেণী-পেশার স্পন্সর বা পৃষ্ঠপোষকদের জন্যই বাড়তি আয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সক্ষম। তবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে অবশ্যই শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা তাদের সঞ্চিত অর্থ লাভজনক ও নিশ্চিন্ত থাকা যায় এমন কোনো খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। আর এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থনৈতিক সচ্ছলতা মানে হলো সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসা।
এদিকে ভুলে গেলে চলবে না গ্রামীণ দরিদ্র কৃষকদের কথাও। তাদের জীবনেও কিন্তু নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে আই-ফার্মার। এই প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করে জীবন পাল্টে গেছে, এমন একজন হলেন লালমনিরহাটের এক প্রত্যন্ত গ্রামের গবাদি পশুর খামারি মিনু। এর আগে তার কাছে পর্যাপ্ত মূলধন ছিল না। তাই মোটা অংকের টাকা ঋণ নিয়ে তাকে পশুপালন করতে হতো। সারা বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও তিনি কোনো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দেখা পেতেন না, কেননা আয়কৃত অর্থের অধিকাংশই চলে যেত মুনাফাসহ ঋণের টাকা পরিশোধে।
কিন্তু আই-ফার্মারের সাথে যুক্ত হওয়ার পর বদলে গেছে মিনুর সংগ্রামী জীবন। এখন তাকে আর সার্বক্ষণিক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে না, বরং আই-ফার্মারের পৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে পাওয়া মূলধন নিয়ে তিনি বেশ ভালোভাবেই পশুপালন করতে পারছেন, এবং অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা আসায় পরিবারের ভরণপোষণেও আর কোনো সমস্যা হচ্ছে না তার।
সব মিলিয়ে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিকাজের সাথে আধুনিক প্রযুক্তির মেলবন্ধনের মাধ্যমে দুর্দান্ত এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে আই-ফার্মার। কে জানে, ছোট্ট এই উদ্যোগই যখন ডালপালা মেলে মহীরুহে পরিণত হবে, তখন হয়তো বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রেও ঘটবে নবজাগরণের সূচনা। আমাদের কৃষকদের মুখে যখন হাসি ফুটবে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী ভাবনাহীন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারবে, তখন আর কে ঠেকাবে বাংলাদেশের অগ্রগতি!