রাশিয়াতে অনুষ্ঠিত ২০১৮ ফিফা বিশ্বকাপের ফেভারিট দল আর্জেন্টিনা তাদের তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে আগামীকাল, বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায়। ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে মস্কোর স্পারতাক স্টেডিয়ামে।
বিভিন্ন ইনজুরির কারণে ও মাঠের বাইরে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ প্রস্তুতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। বিশ্বকাপের আগে আর্জেন্টিনা মাত্র একটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে পেরেছে, যেখানে অন্য সব দল কমপক্ষে দুটি করে ম্যাচ খেলেছে। দুর্বল হাইতির সাথে সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনা ৪-০ গোলে জয় পেলেও খুব বেশি দিন আগের কথা নয় নাইজেরিয়ার সাথে আর্জেন্টিনার ৪-২ গোলে হার ও স্পেনের বিপক্ষে লজ্জাজনক ৬-১ গোলে পরাজয়ের স্মৃতি। শেষ ৯ ম্যাচে আর্জেন্টিনা জিততে সক্ষম হয়েছে শুধুমাত্র ৪টি ম্যাচে।
বিশ্বকাপ উপলক্ষে আর্জেন্টিনার ক্যাম্পে অনুষ্ঠিত আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের ট্রেনিং পর্যালোচনা করে বেশিরভাগ মিডিয়া ধারণা করছে আর্জেন্টিনা আইসল্যান্ডের সাথে ৪-২-৩-১ ফর্মেশন খেলবে।
আর্জেন্টিনা দলের মূল গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরো চোটের কারণে ছিটকে পড়েছেন। তার বদলে আর্জেন্টিনার বেশিরভাগ ফ্যান নাম্বার ওয়ান হিসেবে রিভারপ্লেটের ফ্র্যাঙ্কো আরমানিকে এই বিশ্বকাপে দেখতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে কোনো ম্যাচ না খেলা আরমানির উপর ভরসা না করতে পেরে অভিজ্ঞ সৈনিক চেলসির উইয়ি ক্যাবায়েরোর প্রতিই আস্থা রাখতে যাচ্ছেন কোচ হোর্হে সাম্পাওলি।
ফর্মে থাকা দুই সেন্টারব্যাক নিকোলাস ওটামেন্ডি ও ফেদেরিকো ফাজিও মূল সেন্টারব্যাক জুটি হিসেবে খেলবেন বলে ধারণা করেছিলেন সবাই। তবে আপাতত ফাজিওর বদলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মার্কোস রোহোর আইসল্যান্ডের বিপক্ষে খেলার সম্ভাবনা বেশি। এই মৌসুমে ক্লাবের হয়ে তার বেশি ভালো সময় না কাটলেও রোহো ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে লেফট ব্যাক হিসেবে খেলে অসাধারণ পারফর্মেন্স দেখিয়েছিলেন। ওদিকে রাইটব্যাক পজিশনে গ্যাব্রিয়েল মের্কাদো খেলবেন বলে প্রথমে মনে হলেও আইসল্যান্ডের বিপক্ষে খেলার জন্য এখন সাম্পাওলির পছন্দ এদুয়ার্দো সালভিও। যদিও সালভিও নিজ ক্লাব বেনফিকাতে রাইট উইঙ্গার হিসেবে খেলেন, আক্রমণভাগের একজন খেলোয়াড় আর্জেন্টিনা দলের জার্সি গায়ে রক্ষণে কিভাবে খেলতে পারেন দেখার বিষয় এখন সেটাই। সালভিওর উল্টোদিকে লেফটব্যাক হিসেবে আয়াক্সের লেফটব্যাক নিকোলাস তাগ্লিয়াফিকোর জায়গা সম্পূর্ণ নিশ্চিত।
৪-২-৩-১ ফর্মেশনে দুজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে খেলবেন হাভিয়ের ম্যাশচেরানোর ও লুকাস বিলিয়া। বলতে দ্বিধা নেই, সাম্পাওলির পছন্দের এই সেন্ট্রাল মিডফিল্ড অনেকটাই ‘সেফটি ফার্স্ট’ বা রক্ষণাত্মক মানসিকতার। তবে আর্জেন্টিনা দলে একপাশে ফুলব্যাক হিসেবে খেলবেন একজন উইঙ্গার, অন্যপাশের আয়াক্স অ্যামস্টারডাম দলের তাগ্লিয়াফিকো একজন আক্রমণাত্মক ফুলব্যাক হিসেবেই পরিচিত। এই দুই ফুলব্যাককে কভার দেবার জন্য মূলত সাম্পাওলি এরকম দুজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার বেছে নিয়েছেন যারা ফুলব্যাক দুজন উপরে উঠে গেলে রক্ষণের কাজ করতে পারবেন। ম্যাশচেরানোর কাজ থাকবে ডিফেন্স আগলে রাখা, অর্থাৎ দুই মিডফিল্ডারের মধ্যে তার ভূমিকাটা হবে অধিক রক্ষণাত্মক। ওদিকে বিলিয়া সামনে ফাঁকা জায়গা পেলে উঠে আসবেন এবং মিডফিল্ড থেকে আক্রমণ শুরু করার কাজটা করবেন। সেভিয়ার এভার বানেগা বুধবার ইনজুরি থেকে ফিরে এসে ট্রেনিং শুরু করেছেন। কিন্তু তার ও পিএসজি দলের জিওভানি লো সেলসো– সাম্পাওলির দলের এই দুই ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডারের বেঞ্চে বসে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
ওয়েস্টহ্যাম দলের ম্যানুয়েল লানজিনির ইনজুরিতে দলে এখন তার জায়গায় ডান উইংয়ে স্থান পাবেন আর্জেন্টিনার ক্লাব ইন্দিপেন্দিয়েন্তের ফুটবলার ম্যাক্সিমিলিয়ানো মেজা। দলে কোনো ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডারের অনুপস্থিতিতে তার উপর বিশাল দায়িত্ব থাকবে মিডফিল্ডের সাথে আক্রমণের একটি যোগসূত্র স্থাপন করা। মাঝে মাঝে তাকে ডান উইং থেকে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডেও আসতে দেখা যাবে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে খেলোয়াড় বাড়িয়ে মিডফিল্ড নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। অন্য উইংয়ে খেলবেন পিএসজির ডি মারিয়া। মেজার তুলনায় তিনি আরও বিস্তৃত পরিসরে খেলবেন, অর্থাৎ তাকে একজন প্রথাগত উইঙ্গার হিসেবেই দেখা যাবে। ম্যাচের শেষের দিকে তাদের বদলে সাব হিসেবে বোকা জুনিয়র্সের ক্রিস্টিয়ান পাভন নামবেন, যিনি তার গতি দিয়ে আইসল্যান্ডের ক্লান্ত ফুলব্যাকদের নাস্তানাবুদ করতে পারেন।
দলের মূল চালিকাশক্তি মেসি থাকবেন সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে। তবে এক্ষেত্রে সাম্পাওলি মেসিকে দিয়েছেন ‘ফ্রি রোল’ অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোনো পজিশনের দায়িত্ব তার উপরে নেই। তার যেখানে ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা তিনি তার মতো খেলতে পারবেন। তবে দলে ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডারের অনুপস্থিতিতে প্রায় তাকে নিচে নেমে আসতে দেখা যাবে।
গঞ্জালো হিগুয়েইন বিরাট সময় ধরে একমাত্র স্ট্রাইকার হিসেবে আর্জেন্টিনার মূল দলে খেলে আসলেও এবার হিগুয়েইনের জায়গায় মূল স্ট্রাইকার হিসেবে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে দেখা যাবার সম্ভাবনা বেশি ম্যানচেস্টার সিটির স্ট্রাইকার সার্জিও অ্যাগুয়েরোর। জুভেন্টাসের পাওলো ডিবালাকে মাঠে দেখার সম্ভাবনা খুবই কম।
এবার আসা যাক আইসল্যান্ডের ব্যাপারে। গত ইউরোতে প্রথমবারের মতো খেলতে এসেই সবাইকে চমকে দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গিয়েছিল মাত্র ৩ লাখ ৩৭ হাজার জনসংখ্যার আইসল্যান্ড। এবারই তারা প্রথমবারের মতো খেলতে আসছে ফুটবল বিশ্বকাপে। গত ইউরোতে তারা হারিয়েছিল ছেষট্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে। এবারের বিশ্বকাপে তাদের লক্ষ্য আরেক সাবেক চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে হারানোর। বাছাইপর্বে আইসল্যান্ডের পারফর্মেন্স বেশ ভালো হলেও তাদের বর্তমান ফর্ম খুব একটা ভালো নয়। শেষ ৮টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র ২টিতে তারা জিতেছে। শেষ ৪টি ম্যাচে আইসল্যান্ডের রক্ষণভাগ ১১টি গোল খেয়েছে। অন্যদিকে ঘানা ও নরওয়ের সাথের দুই ম্যাচেই শুরুতে এগিয়ে থাকার পরেও শেষপর্যন্ত তারা ম্যাচ হেরেছে।
আইসল্যান্ড কোচ হেইমির হালগ্রিমসন, যিনি ব্যক্তিগত জীবনে একজন ডেন্টিস্ট, তিনি দলকে মূলত ৪-৪-১-১/৪-৫-১ ফর্মেশনে খেলাতে পছন্দ করেন। গোলবারের নিচে হ্যানসের পর হ্যালডরসনের জায়গা একরকম নিশ্চিত, যিনি প্রায় ৬ বছর ধরে আইসল্যান্ডের মূল গোলরক্ষক। সেন্টারব্যাক জুটি হিসেবে খেলছেন দুই ভালো বন্ধু রোস্তভের র্যাগনার সিগুর্ডসন ও অ্যাবার্ডিনের কার্ল আরনাসনের। এই র্যাগনার সিগুর্ডসনই সেই মানুষ যার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা গোল আইসল্যান্ডবাসীর জন্য এনে দিয়েছিল এক অবিস্মরণীয় জয়। রাইটব্যাক হিসেবে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে খেলছেন ভ্যালুর দলের বিরকির মার স্যেভারসন। লেফটব্যাক হিসেবে ব্রিস্টল সিটির হোরডুর বোর্গভিন ম্যাগনাসানের খেলার সম্ভাবনাই বেশি।
দলে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে আছেন কার্ডিফ সিটির অ্যারন গুনারসন ও উদিনেসের এমিল হালফ্রেডসন। অধিনায়ক অ্যারন গুনারসন থাকবেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে, অন্যদিকে সামনে পাস দেবার দায়িত্বে থাকবেন হালফ্রেডসন। তাদের সামনে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে থাকবেন আইসল্যান্ড দলের তারকা খেলোয়াড় এভারটনের গিলফি সিগুর্ডসন। তবে এভারটনের হয়ে এই মৌসুম বেশি ভালো কাটেনি তার। লিগে ২৭ ম্যাচ খেলে করেছেন মাত্র ৪টি গোল ও ৩টি অ্যাসিস্ট। তার উপর আরেকটি বিশাল সমস্যা, তিনি মাত্র ইনজুরি থেকে ফিরেছেন।
অ্যাস্টন ভিলার বিরকির বিয়োর্নাসন ও বার্নলির উইঙ্গার ইয়োহান বার্গ গুডমুন্ডসন খেলছেন দুই ওয়াইড মিডফিল্ডার হিসেবে। দুজনেই আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দায়িত্বে থাকবেন আর্জেন্টিনার দুই ফুলব্যাককে মার্ক করে রাখার। সামনে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলবেন অগসবুর্গের অ্যালফ্রেড ফিনবগাসন। ২০১৭-১৮ মৌসুমে তিনি জার্মানির ফুটবল লিগ বুন্দেসলিগার সেরা দশ গোলদাতার মধ্যে একজন ছিলেন। মোটামুটি অ্যারন গুনারসন, গিলফি সিগুর্ডসন, ইয়োহানবার্গ গুডমুন্ডসন ও অ্যালফ্রেড ফিনবগাসনই আইসল্যান্ডের মূল খেলোয়াড়। তাই আর্জেন্টিনার প্রধান দায়িত্ব হবে এদেরকে আটকানো।
জনপ্রিয় ফুটবল ওয়েবসাইট Whoscored.com এর মতে এই ম্যাচ আর্জেন্টিনা ও আইসল্যান্ডের লাইন-আপ-
কাগজে-কলমে আইসল্যান্ড দলের আর্জেন্টিনার সামনে দাঁড়াতে পারার কথা না। যদিও আর্জেন্টিনার বর্তমান ফর্ম অত ভালো না, গত তিন বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বে আর্জেন্টিনার রেকর্ড বেশ অসাধারণ। এই তিন বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের মোট ৯ ম্যাচের ৮টিতেই আর্জেন্টিনা জয়লাভ করেছে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা দলের মতো এত ভালো খেলোয়াড় না থাকলেও আইসল্যান্ড দল একটি ব্যাপারে আর্জেন্টিনা থেকে এগিয়ে, উচ্চতা। আইসল্যান্ড দল এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে লম্বা দল, তাদের গড় উচ্চতা ১.৮৫ মিটার (৬ ফুটেরও বেশি)। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা দল এই বিশ্বকাপের অন্যতম খাটো দল, তাদের গড় উচ্চতা ১.৭৯ মিটার (৫ ফুট ১০ ইঞ্চি)। এই বাড়তি ৬ সেন্টিমিটারের সুবিধা নেওয়াই হবে আইসল্যান্ড দলের মূল লক্ষ্য। সাথে তাদের জয়ের জন্য যে কাজ করতে হবে সবার আগে তা হলো লিওনেল মেসিকে আটকানো।