আর্জেন্টিনার হয়ে চতুর্থ পেনাল্টি নিতে যাচ্ছেন গঞ্জালো মন্তিয়েল। গোল হয়ে গেলে আর্জেন্টিনা জিতে যাবে, মিস করলে হয়তো বা ফলাফল অন্যরকম হত। কিন্তু মন্তিয়েল মিস করেননি, লরিসকে ভুল দিকে পাঠিয়ে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে নিলেন শেষ পেনাল্টিটি। গোল করে ঘুচালেন আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের একটি আক্ষেপ।
স্মরণকালের এক রোমাঞ্চকর ফাইনালের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এবারে বিশ্বকাপের আসর। কী ছিল না এই ফাইনালে! প্রথমে এক দলের একচ্ছত্র আধিপত্য, পেনাল্টিতে এগিয়া যাওয়া, ব্যবধান বাড়ানো, কামব্যাক, আবার এক দলের এগিয়ে যাওয়া, এরপর আবারও কামব্যাক, শেষে টাইব্রেকার। একটি থ্রিলার সিনেমার চাইতে কোনো অংশেই কম ছিল না এইবারের ফাইনালটি।
কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি। কিন্তু সব সমালোচনার জবাব দিয়ে এবারের বিশ্বকাপ স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। বিশ্বকাপের পর্দাও নেমেছে একদম নাটকীয়ভাবে। সাথে সময়ের সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসির মুকুটে জুড়ে দিয়েছে এক নতুন পালক।
খেলার শুরুর পূর্বে মাঠের বাইরের খেলায় ভালোই খেলছিলেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। তাদের খেলার বিষয়বস্ত ছিলেন প্যারিস সেন্ট জার্মেইনে খেলা দুই ক্লাব সতীর্থ মেসি ও এমবাপে। কে হাসবেন শেষ হাসি, তা নিয়েই চলেছে তর্ক-বিতর্ক। তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে ম্যাচটি নিজেই নিজের পরিচয় বের করে নিয়েছে দর্শকদের এক অভাবনীয় বিস্ময় উপহার দিয়ে। তর্কসাপেক্ষে এই ফাইনালকে অনেকেই সর্বকালের সেরা ফাইনাল দাবি করছেন। দাবি করাটা অমূলক কিছুও মনে হচ্ছে না। এই ফাইনালে তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসি তার ট্রফি ক্যাবিনেটের একমাত্র অপ্রাপ্তিকে পূর্ণতা দিয়েছেন। তো কেনই বা এই ম্যাচটি ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবে না?
তাছাড়া এই ম্যাচে ফুটবল বিশ্ব সাক্ষী হয়েছে দুই দলের দুই কোচ স্কালোনি ও দেশমের ট্যাকটিকাল মাস্টারক্লাসের। এত ফ্লেক্সিবল ওয়েতে নিজেদের দল সাজানো, একাধিক ব্যাকআপ প্ল্যান রাখা, যখন প্রয়োজন মনে হয়েছে কৌশলে পরিবর্তন আনা – সবই করেছেন তারা। তাই আমাদের একটি জমজমাট ফাইনাল উপহার দেয়ার পেছনে কোচদের ভূমিকাও কম নয়।
পরিসংখ্যানের হিসেব বাদ দেই। খেলার প্রথম ৮০ মিনিট যারা দেখেছেন তারা নিঃসন্দেহেই বলবেন যে আর্জেন্টিনার ম্যাচের যোগ্য জয়ী ছিল। প্রথমার্ধে পেনাল্টি থেকে দলকে এগিয়ে নেন মেসি, এরপর ম্যাক অ্যালিস্টারের থেকে পাওয়া বল দিয়ে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন ডি মারিয়া। ফ্রান্সের খেলায় ফিরতে যথেষ্ট সময় লেগেছে। এমনকি খেলা বুঝে উঠতেও তাদের হাফ টাইম লেগে যায়। ৭০ মিনিটের সময় তারা আর্জেন্টিনার গোলকে লক্ষ্য করে প্রথম শ্যুট নেন। এরপর ম্যাচের মোড় বলতে গেলে একাই ঘুরিয়ে দেন কিলিয়ান এমবাপে। র্যান্ডাল কোলো মুয়ানিকে বক্সে ফেলে দিয়ে ফ্রান্সকে পেনাল্টি উপহার দেয় ফ্রান্স, যা থেকে ব্যাবধান কমান এমবাপে। এক মিনিট পরেই দুর্দান্ত এক দলগত খেলা দিয়ে খেলায় সমতা নিয়ে আসেন তিনি।
নাটকের শেষ হয়নি এখানেও। খেলা অতিরিক্ত সময়ে যাওয়ার পর আর্জেন্টিনা আবারও চেষ্টা করে ম্যাচের লাগাম ধরে রাখতে। কিন্তু তারা সফল হননি। ১০৯ মিনিটে গোল করে আর্জেন্টিনাকে আবার এগিয়ে দিলেও ম্যাচ শেষ হওয়ার ৫ মিনিট পর আবারও পেনাল্টি থেকে খেলায় আনেন এমবাপে। তবে পেনাল্টি ভাগ্যে ভাগ্য খুলে যায় তাদের। কোয়ার্টার ফাইনালের পর আবারও ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। কোলো মুয়ানির শেষ মিনিটের শট ফিরিয়ে দিয়ে ম্যাচকে বাঁচিয়ে রাখেন টাইব্রেকার অব্দি। সেখানে দুর্দান্তভাবে সেভ করেন কিংসলি ক্যোমানের পেনাল্টি। এরপর মনঃস্তাস্তিক লড়াইয়ে চুয়ামেনিকে দ্বিধায় ভুগিয়ে তাকে বাধ্য করেন বাইরে পেনাল্টি মারতে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা কোনো পেনাল্টি মিস করেনি, ৪ শটের ৪ টাতেই গোল করে ১৯৮৬ সালের পর আবারও বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলে তারা।
এই খেলায় আর্জেন্টিনা মাঠে নামে তাদের অতি পরিচিত ৪-৩-৩ ফরমেশনে। তবে এই ম্যাচে তারা তাদের আক্রমণের সূচনাটি করেছিল বাম প্রান্ত দিয়ে। সেখানে থাকা ডি মারিয়া বেশিরভাগ সময় ছিলেন একদম টাচলাইন ঘেঁষে। তাকে সাপোর্ট দিতে নাম্বার ৮ রোলে খেলা ম্যাকঅ্যালিস্টার কিছুটা উপরে উঠে ফ্রান্সের রাইটব্যাক কৌন্দের সীমানায় চলে আসেন। এতে করে ম্যাকঅ্যালিস্টারকে মার্ক করতে দিয়ে বিশাল ফাঁকা যায়গা দিতে হয় ডি মারিয়াকে। মারিয়ার গতির সাথে তাল মেলাতে এদিন ওসমান দেমবেলেকেও নিচে নেমে আসতে হয় রক্ষণের কাজে। এর ফলে নিকোলাস তাহলিয়াফিকো কিছুটা উপরে উঠে এসে খেলতে পারেন। তবে তিনি বেশি উপরেও যাচ্ছিলেন না; কারণ কাউন্টার অ্যাটাকে দেমবেলের গতির কাছে তাকে হার মানতে হবে। আবার তাকে এটাও খেয়াল রাখতে হয়েছে যে ডি মারিয়া তার জন্য যে ফাঁকা জায়গা রেখেছেন, সেখানে যেন প্রবেশ করে ভীড় না বাড়িয়ে দেন। ডি মারিয়ার বল নিয়ে কাটানোর জন্য এই বিশাল স্পেসের প্রয়োজন ছিল। এইভাবে দুইজনের মাঝে পড়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন জুলস কৌন্দে।
এদিন ডানপ্রান্তে মেসির সাথে ছিলেন কেবল মলিনাই। তিনি উপরে উঠার জন্য বিশাল জায়গা পাচ্ছিলেন, কারণ এমবাপে ডিফেন্ড করার জন্য নিচের দিকে নামছিলেন না। তিনি তিনি সেখানে বারবার হেরে যান বল দখলের লড়াইয়ে। এমবাপে ও হার্নান্দেজ যথেষ্ট ভোগান তাকে। আর মাঝে ডি পল সেদিন ডাবল পিভট তৈরি করেন এনজো ফার্নান্দেজের সাথে। ম্যাকঅ্যালিস্টার উপরে উঠে আলভারেজ ও মেসির সাথে একটি নতুন অ্যাটাকিং লাইন তৈরি করেন। এই তিনজনের মিলিত কৌশলে ডি মারিয়ার কাছ থেকে ডিফেন্ডারদের দূরে রাখে। সেভাবেই খালি জায়গা পেয়ে ডি মারিয়া ঢুকে পড়েন বক্সে, সেখানে দেমবেলে তাকে ফাউল করলে পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। সেই পেনাল্টি থেকে আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেন লিওনেল মেসি।
ম্যাকঅ্যালিস্টার আগাচ্ছিলেন বাম প্রান্ত দিয়ে, আর অন্যদিকে আলভারেজ ডিফেন্ডার ড্র্যাগ করে ফ্রান্সের ডিফেন্স লাইনকে আরো ডিপে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আলভারেজের একটু নিচে থাকা মেসি এতে ভালো একটি স্পেস পান। তিনি কী করেন? নিজেই নেমে এসে বল রিসিভ করেন। এবং সাথে পাসিং অপশন হিসেবে পেয়ে যান আলভারেজ ও ম্যাকঅ্যালিস্টারকে। তবে এর চাইতে আরো গুরুত্বপূর্ণ দুই পাসিং অপশন ছিল নিচে থাকা দুই ডাবল পিভট ডি পল ও এনজো ফার্নান্দেজ। এইভাবে ৫ জন খেলোয়াড় একসাথে মিডফিল্ডে এসে এতটাই ওভারলোড করে ফেলে যে তাদের বিপক্ষে ফ্রান্সের মিডফিল্ডার পুরো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এবং এই সিস্টেমে খেলেই আর্জেন্টিনা একটা বড় সময় ফ্রান্সকে আটকে রাখে তাদের অর্ধেই। এ সময় ফ্রান্সের তেমন কোনো আক্রমণ হয়নি, এমনকি কোন অ্যাটেম্পটও ছিল না। আর এই পাঁচজনের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে বারবার ফ্রি হয়ে যাচ্ছিলেন ডি মারিয়া। তাকে আটকাতে ওসমান দেমবেলে বাধ্য হয়ে নিচে নেমে আসেন।
ফ্রান্সের ডিফেন্স আর মিডফিল্ড লাইনের মাঝে এই স্পেসে বারবার নেমে আসছিলেন মেসি, এবং কোনো না কোনোভাবে বল দেয়ার জন্য ডি মারিয়াকে খুঁজে নিয়েছিলেন। ডি মারিয়াকে বল দেয়া ছাড়াও মেসি, ম্যাকঅ্যালিস্টার ও আলভারেজ নিজেদের মাঝে যে লিংকআপ খেলছিলেন, তাতে করে বেশ কয়েকবার খেই হারিয়ে ফেলে ফরাসি খেলোয়াড়েরা। আর এভাবেই আর্জেন্টিনা আদায় করে তাদের দ্বিতীয় গোল। এই তিনজনের কম্বিনেশনে বানানো বল ফ্রান্সের জালে জড়ান ডি মারিয়া।
ফ্রান্স তাদের খেলা শুরু করেছিল চিরপরিচিত ৪-২-৩-১ এ। তবে চারজন ধরা হলেও আসলে সেখানে ছিলেন তিনজনই। কারণ থিও হার্নান্দেজ বারবার লেফটব্যাক পজিশন থেকে উপরে উঠে আসছিলেন। বামে খেলা এমবাপেও কাট-ইন করে ভেতরে ঢুকে যেতেন। ভেতরে ঢুকে তিনি বেশিরভাগ সময় অবস্থান নিতেন জিরুর আশেপাশে। উদ্দেশ্য ছিল যে জিরু যে বলগুলো হেড দিয়ে জিতবে, সেগুলোকে কাজে লাগানো। অন্যদিকে গ্রিজমান একটু ডানে চেপে সাপোর্ট দিয়েছেন জিরুকে, আর আরেক উইঙ্গার দেমবেলে আরো ডানে চেপে অবস্থান নেন অনেকটা ডি মারিয়ার মত করে। ডাবল পিভট হিসেবে ছিলেন র্যাবিও ও চুয়ামেনি। তবে প্রথমদিকে এই পিভট যথেষ্ট ভুগেছে আর্জেন্টিনার কাছে। আর্জেন্টিনার ফ্রন্ট লাইনের আশেপাশে ঘুরে অল্প কিছু বিল্ডআপ আর ডিফেন্সের সাথে অ্যাটাকের যোগসূত্র স্থাপন ছাড়া আর কোনো কিছু করা সম্ভব হয়নি তাদের।
ফ্রান্সের খেলার ধরন অনেকটা আর্জেন্টিনার মতোই ছিল। ঝামেলা ছিল শুধু এই যে তারা আর্জেন্টিনার প্রেসের সামনে টিকতে পারেনি। আবার নিজেদের খারাপ পাসিংও এর জন্য দায়ী ছিল। ফলে গোল করা বাদ দিয়ে তাদের মনোযোগ বেশি ছিল বলকে আর্জেন্টিনার পায়ে যাওয়া থেকে আটকানো। ফ্রান্স যে জিরুকে দিয়ে গোল করানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু এই ধরনের দুর্বলতার জন্য তারা জিরু অব্দি বলই নিতে পারেনি। জিরু যে বল উইন করে অন্য খেলোয়াড়দের দেবেন, তার সুযোগও ছিল না। এর ফলে এমবাপে, গ্রিজমান ও দেমবেলে এমন কোনো খালি জায়গায় বল পাচ্ছিলেন না যেখানে তারা আর্জেন্টিনার প্লেয়ারদের চাপে পড়বে না। সবকিছু মিলিয়ে ফ্রান্স প্রথমার্ধে কোনো আক্রমণেই যেতে পারেনি, ফলে তাদের অন-টার্গেটে কোনো শটই ছিল না। আর্জেন্টিনা যে কৌশলে সফল হচ্ছিল, ঠিক সেই সিস্টেমেই ফ্রান্সের অবস্থা ছিল একদম উল্টো।
ব্যর্থতা বুঝতে পেরে প্রথমার্ধের ৪০ মিনিটের মাথাতেই কৌশলে পরিবর্তন আনেন দেশম। মাঠ থেকে তুলে নেন জিরু ও দেমবেলেকে, এমবাপেকে মাঝে দিয়ে বামে নামানো হয় মার্কাস থুরাম ও ডানে র্যান্ডাল কোলো মুয়ানিকে।
দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়েরা নিচে নেমে এসে লো ব্লকে খেলা শুরু করে। পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছিল যে এখন তাদের লক্ষ্য শুধু লিড ধরে রাখা। তারা তখনই আক্রমণে যেত যখন তারা মিডফিল্ডে বল কেড়ে নিতে পারত। শুধুমাত্র ডি মারিয়াই বাম প্রান্তে নিজের জায়গা ধরে রেখেছিলেন। মিডফিল্ড থেকে বল বলুন, কিংবা ডান প্রান্ত থেকে প্রান্ত বদলকারী পাস বা থ্রু পাস – অধিকাংশের উদ্দেশ্য ছিল ডি মারিয়ার পা। আর মারিয়াকে ডিফেন্ডারমুক্ত রাখতে ড্র্যাগ করে তাদের সেন্টারে নিয়ে আসার কাজ করতেন আলভারেজ। আর তার সাপোর্টে ছিলেন ম্যাকঅ্যালিস্টার। তিনিই আলভারেজের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চবার ফ্রান্সের ডিফেন্সে ঢুকেছেন বল ছাড়াই। মিডফিল্ড থেকে তার এই মুভগুলো ছিল একদম চোখে পড়ার মতো। ডি মারিয়াকে যখন তুলে নেয়া হয়, আর্জেন্টিনার এই খেলাগুলো একদম বন্ধ হয়ে যায়। কারণ ডি মারিয়ার মতো স্কিলে খেলা আকুনিয়ার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তখন আর্জেন্টিনার দুই উইংয়ে খেলেন আকুনিয়া ও ডি পল। কিন্তু তারা না পেরেছেন ডি মারিয়ার মতো ড্রিবল করতে, না পেরেছেন গতি দিয়ে ডিফেন্স ভেঙে ঢুকে যেতে। প্রতিবার মিডফিল্ড থেকে নিয়ে আসা বল তারা ফাইনাল থার্ড পার করতে ব্যর্থ হন। এখানেই মোড় ঘুরতে শুরু করে খেলার। ফ্রান্সও ধরে ফেলে আর্জেন্টিনার দুর্বলতা। এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তারা আর্জেন্টিনার উপর চাপ প্রয়োগ শুরু করে। টিকতে না পেরে স্কালোনি তার খেলোয়াড়দের নামিয়ে আনেন আরো নিচে। তবে ফ্রান্সের দুর্দান্ত গতির সাথে কুলাতে পারেনি আর্জেন্টিনা; ৮০ ও ৮১ দুই মিনিটে দুই গোল দিয়ে খেলায় ফেরে ফ্রান্স।
আর্জেন্টিনা তাদের মিড ব্লক সিস্টেমে মিডফিল্ড ন্যারো করে ফেলায় সেখানে সুবিধা করতে পারছিলেন না ফ্রান্সের পিভটে থাকা খেলোয়াড়েরা। আর গ্রিজম্যান যতবার আর্জেন্টিনার ফ্রন্ট থ্রির পেছনে বল রিসিভ করতে যাচ্ছিলেন, আর্জেন্টিনার মিডফিল্ড থেক্র যে কোন একজন উঠে এসে তাকে বাঁধা দিচ্ছিলেন। এখন এই নিচে নেমে গ্রিজম্যানের জায়গায় অন্য কেউও যদি বল নিতে আসত আর্জেন্টিনার মিডফিল্ড একসাথে তার উপর প্রেস করে। আর পুরো মিডফিল্ড এরিয়া কভার করে ফেলে। তারা ওই জায়গায় ভিড় করে সেই নির্দিষ্ট খেলোয়াড়কে বাকিদের থেকে একদম আলাদা করে ফেলতেন। তাতে করে বল পাস দেয়ার জন্য উপযুক্ত অপশন না পেয়ে কিছু সময় হাঁসফাঁস করে বলের দখল হারান ওই খেলোয়াড়। ফ্রান্স এজন্য তাদের আক্রমণকে মিডফিল্ড বাদ দিয়ে উইংয়ে শিফট করে। তাদের টিমের স্পিডি উইঙ্গার থাকায় এই কৌশলটিই ছিল তাদের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী। কিন্তু আবারো, উইংয়ে বল নেয়ার পর দুইজন খেলোয়াড়ের মধ্যে যে লিংক আপ প্রয়োজন ছিল, তা হচ্ছিল না। কারণ আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডাররা আরো আগ্রাসী ভাবে উইং এরিয়া কভার করতে আসে। তারা ফুলব্যাকের ভেতরের দিকে অবস্থান নিয়ে ফ্রান্সের উইঙ্গারদের কাট ইন করে ভেতরা ঢুকা থেকে আটকান। জিরু উঠে যাওয়ার পর এমনিতেই তাদের এরিয়াল থ্রেট কমে গিয়েছিল, কারণ কোলো মুয়ানির উচ্চতা ৬’২” হলেও হেডে কোনভাবেই তিনি জিরুর সমক্ষ নন। এইভাবে কৌশল পরিবর্তন করেও ফ্রান্স আক্রমণে সুবিধা করতে পারে নি আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের দুর্দান্ত ওয়ার্করেটের জন্য।
ফ্রান্সের স্কোয়াডের দিকে তাকালে দেখবেন যে তাদের সামর্থ্য রয়েছে দুটো আলাদা খেলায় দুটো স্কোয়াড নামানোর। গ্রুপপর্বের শেষ খেলায় এভাবে হারলেও তাদের কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন থাকার কথা নয়। বিশেষ করে একঝাঁক প্রচণ্ড পটেনশিয়াল তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে স্কোয়াড অনেকটাই স্থিত ছিল অন্যান্য যেকোনো দলের চাইতে। তাই তাদের হাতে অপশনও ছিল যেকোনো মুহূর্তে খেলোয়াড় পরিবর্তন করে কৌশল পরিবর্তন করা। দেশম করলেনও তাই; বদলি হিসেবে নামান আরেক স্পিডস্টার কিংসলে ক্যোমানকে। ক্যোমান নামার পূর্বে এমবাপে আবারও সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ড পজিশন থেকে বামে চেপে যান। আর ক্যোমান নামার পর ফ্রান্স শুরু করে ৪-২-৪ ফরমেশনে খেলার।
খেলার এই পর্যায়ে এসেই তারা আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডারদের প্রেশারে ফেলতে পারে। এবার ফ্রান্সের খেলোয়াড়দের গতিশীল আক্রমণ, ডিফেন্স ভেদ করে ঢুকে যাওয়া এসব করে আর্জেন্টিনার ডি-বক্সে আস্তে আস্তে আক্রমণ শুরু করে। উইংয়ে বল বিল্ডআপ করে তা মাঝে থাকা দুইজনের দিকে পাঠিয়ে ফ্রান্স প্রথমবারের মতো আর্জেন্টিনার ডিফেন্সে সফল আক্রমণ চালায়। ফলাফল পেতেও দেরি হয়নি, ৮০ মিনিটে পেনাল্টি থেকে ১ম গোল ও ৮১ মিনিটে ক্যোমান উইংয়ে মেসির কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে লং বল দেন আর্জেন্টিনার বক্সের সামনে। সেখানে ওয়ান-টু-ওয়ান খেলে এক দুর্দান্ত ভলিতে এমবাপে আর্জেন্টিনার জালে বল জড়ান। তবে এমবাপে সুবিধা করতে পারছিলেন না যতক্ষন থিও হার্নান্দেজ মাঠে ছিলেন। কারণ তার আক্রমণাত্মক মনোভাবের জন্য তিনি যখন উপরে উঠে আসতেন, তখন মেসির জন্য বিশাল একটা ফাঁকা জায়গা রেখে আসতেন। এই সমস্যার সমাধানে দেশম নামান ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গাকে।
অতিরিক্ত সময়ে আর্জেন্টিনার হয়ে মাঠে নামেন পারেদেস। ডি মারিয়া উঠে যাওয়ার পর একজন ক্রিয়েটিভ খেলোয়াড়ের অভাব ভালোভাবেই বুঝছিল আর্জেন্টিনা। পারেদেস অবস্থান নেন ডিফেন্স লাইনের একটু সামনে, সিঙ্গেল পিভট হিসেবে খেলা এনজো ফার্নান্দেজের একটু পিছনে। ফ্রান্সের ফরোয়ার্ড লাইনের আশেপাশে থেকে তিনি বিল্ডআপের কাজ করছিলেন। পুরো ম্যাচে আর্জেন্টিনা মাঠের মাঝখান দিয়ে আক্রমণে উঠতে পারছিল না। কিন্তু এবার মেসি, ম্যাকঅ্যালিস্টার ও লাউতারো মার্টিনেজ মিলে আক্রমণগুলোকে উইং থেকে অনেকটা মাঝে নিয়ে আসেন। আর্জেন্টিনার ৩ নাম্বার গোলটাও আসে এই সেন্ট্রাল বিল্ডআপের মাধ্যমে। মার্টিনেজের নেয়া জোরালো শট ঠেকিয়ে দিয়ে মাটিতে পড়ে যান লরিস। ফিরতি বলে গোল করেন মেসি। ফ্রান্স এই অতিরিক্ত সময়ে নিজেদের আক্রমণাত্মক খেলার শেপটা ধরে রাখে। কিন্তু বিপরীতে আর্জেন্টিনা নিজেদের ফ্রন্টলাইনকে আরো সংকীর্ণ করে কিছুটা নিচে নামিয়ে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে আসে। এতে করে ফ্রান্সের দুই লাইনের মাঝে যে বড় গ্যাপ ছিল, তার সদ্ব্যবহারের চেষ্টা চালায়।
আর ফ্রান্সের আক্রমণভাগের ৪ জন আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের তাদের যার যার স্থানে ফিক্সড রাখার চেষ্টা করেন। তারা আর্জেন্টিনার ডিফেন্সের সামনে অবস্থান নিয়ে ডিফেন্সকে বাকি খেলোয়াড়দের থেকে আইসোলেটেড করে ফেলে। এরপর তারা কিছু কুইক অ্যাটাক চালিয়ে যায় আর্জেন্টিনার উপর দিয়ে। উইং দিয়ে বল নিয়ে উঠে যাওয়া, কিংবা লাইন-ব্রেকিং থ্রু পাস ছিল তাদের মূল অস্ত্র। আর কোলো মুয়ানিকে দিয়ে হেডে বল রিসিভ করানোর জন্য লং বলে খেলা চালিয়ে যায়। আর্জেন্টিনার ডাবল পিভটের কোনো কিছুই করার ছিল না এতে।
আর্জেন্টিনা নিজেদের ফরমেশন আরো আক্রমনাত্মক করে ফেলায় খেলার মোড় বারবার পরিবর্তন হচ্ছিল। ফ্রান্স কিছুটা সেফ খেলতে নিজেদের ফরমেশন ৪-২-৪ থেকে ৪-৪-২ এ নিয়ে আসে। তবে তাদের আক্রমণের ঘাটতি হয়নি; এজন্যই ৩-২ গোলে পিছিয়ে পড়েও কিছু সময় পর একটি পেনাল্টি আদায় করে নেয় তারা। পেনাল্টি থেকে নিজের হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন এমবাপে। কোলো মুয়ানিকে দিয়ে কিন্তু লং বলে আক্রমণ চলছিলই। ১২০+৩ মিনিটের সময় কোলো মুয়ানি সুযোগ পেয়েছিলেন স্কোরকে ৪-৩ করার। কিন্তু মার্টিনেজকে একা পেয়েও তাকে পরাস্ত করতে পারেননি তিনি। তবে এই সেভে মুয়ানির মিসের চাইতে মার্টিনেজের সেভটাই ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে শেষ ২০ মিনিটে যা মিস করেছে আর্জেন্টিনা, তার ৮০% একাই করেছেন লাউতারো মার্টিনেজ। নয়তো খেলাটি টাইব্রেকারেও যায় না।
এরপর শুরু হয় পেনাল্টি। দুই দলই তাদের প্রথম শ্যুটে গোল করে। মেসি-এমবাপে দুইজনই সফল ছিলেন৷ কিন্তু ফ্রান্সের দ্বিতীয় পেনাল্টি মিস করে বসেন কিংসলি ক্যোমান। এমিলিয়ানো মার্টিনেজের মাইন্ডগেমের কথা সবারই জানা। ক্যোমানের ক্ষেত্রে খুব একটা প্রভাব দেখা না গেলেও সেই প্রভাবে পেনাল্টি একদম বাইরে মেরে বসেন চুয়ামেনি। আর আর্জেন্টিনা ৪টির ৪টিতেই গোল করে নিজেদের নিয়ে যায় জয়ের বন্দরে।
এবারের বিশ্বকাপটি আর্জেন্টিনার জন্য ছিল মেসিময়। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের গ্রুপপর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে গোল করার রেকর্ড করেছেন তিনি। মেসি আর্জেন্টিনাকে নিয়ে একটি বিশ্বকাপ জিতে গেলেন, এই এক ট্রফিতেই সমকালীন অন্য ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’দের সাথে নিজের ব্যবধান বাড়িয়ে নিলেন। সর্বকালের সেরাদের তালিকাতেও বোধহয় নিজের স্থানটা পাকাপোক্ত করলেন আরো একটু।
তবে কৃতিত্ব মেসির একার নয়। কৃতিত্ব পাবেন টুর্নামেন্টের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড় এনজো ফার্নান্দেজ, কৃতিত্ব পাবেন ‘গোল্ডেন গ্লাভস’ বিজয়ী এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণের বিজয় ছিল এটি।
৩৬ বছর পূর্বে আর্জেন্টিনা শেষ বিশ্বকাপ জিতেছিল তাদের এক মহানায়ক ডিয়েগো ম্যারাডোনার হাত ধরে। ২০২০ সালে এই কিংবদন্তী পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। তাকে ছাড়া এবারই ছিল প্রথম বিশ্বকাপ। প্রয়াত ডিয়েগোর জন্য আর্জেন্টিনার এই বিশ্বকাপ এক উপহার। বেঁচে থাকলে হয়তো বা গ্যালারিতেই বসেই দেখতে পেতেন তার উত্তরসূরী মেসি শিরোপা তুলে ধরা।