বাবু মারমা। নিজের শরীরকে নানা কসরতে বাঁকিয়ে ভিন্নরকম এক খেলা খেলছে সে। খেলারত অবস্থায় এভাবে দেখে অবাক হয়ে যায় তার আশেপাশের মৌন পাহাড়। খুব বেশিদিন হয়নি বাবু মারমা নিজের মাঝে কনটোরশন নামক এ প্রতিভার খোঁজ পেয়েছে। খুব কম সময়ের মধ্যেই নিজেকে একজন কনটোরশনিস্ট হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছে।
কনটোরশন শব্দটা অনেকের কাছে নতুন। এটি হলো এমন এক শারীরিক প্রদর্শনী, যেখানে কনটোরশনিস্ট নিজের শরীরকে বিভিন্নভাবে বাকিয়ে আকুঞ্চন করেন। এটি সম্ভব হয় ব্যক্তির শারীরিক নমনীয়তার মাধ্যমে। কনটোরশনিস্টদের শারীরিক নমনীয়তা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকে। এ শারীরিক নমনীয়তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জন্মগত হয়ে থাকে। তবে একজন সাধারণ মানুষও চাইলে কনটোরশন করতে পারে। তার জন্য তাকে অনেক বেশি পরিশ্রমী ও নিয়মিত হতে হবে।
বাংলাদেশে বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। প্রতিভাও দেখা যায় না খুব একটা। তবে কয়েক বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাবু মারমা নিজের এই প্রতিভা দিয়ে সবার মন কাড়ছে। তার শারীরিক কসরত সবাইকে মুগ্ধ করছে। বাবু মারমার জন্ম বাংলাদেশের প্রকৃতির স্বর্গভূমি বান্দরবান জেলার বাঘমারা গ্রামে। পাহাড়ও প্রকৃতির মাঝে বেড়ে উঠা ছেলেটির জন্ম ২০০৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ছোটবেলায় হয়তো কল্পনাও করেনি একসময় নিজের প্রতিভা দিয়ে সকলের মন জয় করবে।
তার ভালো লাগার বিষয়গুলো হলো, নাচ, গান, ছবি আঁকা ইত্যাদি। নিজের ভালো লাগাতেই সে এগুলো করতো। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ, গান, ছবি আঁকায় পেতো পুরস্কার। আর পাঁচটা সাধারণ ছেলেদের মতো লাফালাফি ঝাপাঝাপিতে জড়াতো না, ছেলেদের খেলায় তার আগ্রহ কম। সে শুধু পড়ে থাকতো তার ভালো লাগার বিষয়গুলো নিয়ে। সে কারণে সমবয়সী ও প্রতিবেশীদের কাছে হেনস্তার শিকারও হতে হতো তাকে।
বেশিরভাগ সময় বাড়িতে থাকার কারণে তাকে ‘হিজরা’, ‘হাফ লেডিস’ ইত্যাদি বলে বিদ্রূপ করতো অনেকে। কিন্তু এসব তাকে থামাতে পারেনি। তার মা ও দিদি সবসময় উৎসাহ দিতেন তাকে।
কনটোরশনের সাথে তার পথ চলা খুব বেশি দিনের না। ২০১৮ সালে কোনো একদিন ভূতের ছবি দেখার সময় সে এই বিষয়টি আবিষ্কার করে। ছবির একটি দৃশ্যে একটি মেয়ে তার শরীরকে বিভিন্ন ভাবে ভেঙ্গে ফেলে। দৃশ্য দেখে সে অবাক হয়ে যায়। শরীরকে এমন করে কীভাবে ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব! কৌতূহল থেকে সে এ বিষয়টি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে এবং ভেতরে ভেতরে এটা আয়ত্ত করার তাড়না অনুভব করে। একপর্যায়ে ইউটিউবে কানাডিয়ান কনটোরশনিস্ট আনা মেকনালটি’র (Anna McNulty) খোঁজ পায়। আনা একজন প্রফেশনাল কনটোরশনিস্ট। তার চ্যানেলে ধাপে ধাপে কনটোরশন করার নিয়ম দেওয়া ছিল। সেখান থেকে এগুলো নিয়মিত অনুশীলন করতে থাকে বাবু মারমা।
কোনো প্রফেশনাল ট্রেইনার ছাড়াই ইউটিউবের ভরসায় সে কনটোরশনিস্ট হবার পথে এগিয়ে যেতে থাকে। বান্দরবানের মতো প্রত্যন্ত যায়গায় প্রফেশনাল ট্রেইনার বা ট্রেনিং সেন্টার পাওয়া অসম্ভব, যেখানে দেশের বড় নগরগুলোতেই এর দেখা পাওয়া যায় না প্রায়। তার আশেপাশে চর্চা করার তেমন ভালো জায়গা ছিল না। স্নান করতে গিয়ে নদীর তীরে বালুর চরে অনুশীলন করতো।
মারাত্মক সব কৌশল দেখে লোকজনের চোখ কপালে উঠতো। বলতো এই ছেলেটা এভাবেই পাগলামি করতে গিয়ে মারা পড়বে। লোকেদের ভয় পাওয়া স্বাভাবিক ছিল। কারণ এ ধরনের কৌশল আয়ত্ত করা সহজ কথা নয়। একটু হেরফের হলে শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ লক লেগে শরীরে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আর ট্রেইনার ছাড়া এ ধরনের কিছু করার চেষ্টা করা পাগলামিই বটে।
কনটোরশন নিজের আয়ত্তে আনার পরে তা নিয়মিত অনুশীলন মাধ্যমে আরো পরিপক্ব করার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। তবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও তার তেমন কেউ পরিচিত ছিল না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকার কারণে তার এই প্রতিভাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার তেমন কোনো উপায়ও ছিল না। তবে তার পরিচিতি ছড়াতে শুরু করে তার দিদির ফোন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি ও ভিডিও আপলোড দেয়ার পর থেকে। দিদির সে ফোনেরও যায় যায় অবস্থা ছিল। এই ফোন দিয়েই কোনোরকমে ভিডিও ধারণ করে তা আপলোড করতে থাকেন।
নিয়মিত অনুশীলন করার মাধ্যমে সে নিজের উন্নতি করতে থাকে। তার বিশ্বাস ছিল, যদি ভালো কিছু করতে পারে তবে অবশ্যই মানুষ তাকে দেখবে, জানবে ও ভালোবাসবে। এখন বাবু মারমা পরিচিত মহল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভালোবাসার নাম।
এখন পর্যন্ত কনটোরশন দিয়ে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ তার হয়নি। তবে গোলাম রাব্বানী ও তুষার নামে দুজন সুহৃদের প্রয়াসে তার প্রতিভা আরো অনেকের কাছে পরিচিতি পায়। সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির রিয়েলিটি শো ‘জি পিএইচ ইস্পাত অনন্য প্রতিভা’-তে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পায় বাবু মারমা। রিয়েলিটি শোতে তার প্রতিভা দিয়ে বিচারকদের মন জয় করে জায়গা করে নেয় গ্র্যান্ড ফিনালের ১৮ জনের মধ্যে।
বাবু মারমার মায়ের একান্ত ইচ্ছে ছিল, সে তার প্রতিভা দিয়ে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করবে। সে নিজের দক্ষতা দিয়ে বাংলাদেশকে তুলে ধরবে সেই লক্ষ ধরে সেও পরিশ্রম করে চলছে। মা বেঁচে নেই তবে মায়ের ইচ্ছাকে লালন করে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা সুবিধাবঞ্চিত এই পরিশ্রমী ছেলেটি যদি উপযুক্ত সহযোগিতা পায় তবে তার দ্বারা অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব।