হতাশা দিয়ে শুরু করলেও বার্সেলোনা মৌসুম শেষ করল দ্বিমুকুট জিতে

চলতি মৌসুমে বার্সেলোনার শুরুর সময়টা একবার ভাবুন তো! প্রাক-মৌসুমে মোটামুটি উতরে যাবার মতো পারফর্মেন্সের পর বার্সেলোনার চোখের সামনে যেন বিদ্যুৎ গতিতে অন্ধকার নেমে এলো। নেইমারের চলে যাওয়া, লুইস এনরিকের পদত্যাগের পর নতুন কোচ আর্নেস্তো ভালভার্দে এবং আগস্টে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের কাছে সুপার কোপায় উভয় লেগে লজ্জাজনক হার। আগের বছরেও বার্সেলোনার সময়টা ভালো কাটেনি। নতুন মৌসুমে নতুন আশা নিয়ে শুরু করতে গিয়ে প্রথমে এমন হোঁচট খাওয়াতে অনেকে ভেবেছিলো, বার্সেলোনার এবার বিশেষ কিছু জিততে পারবে না। কিন্তু লা লিগা শুরু হবার পর থেকে বার্সেলোনা ফিরে আসতে লাগলো তাদের আসল চেহারায়। যদিও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ ফসকে গেছে, তবে লা লিগা ও কোপা ডেল রে জিতে মনে রাখার মতো একটি মৌসুম পার করছে কাতালানরা। সবথেকে অবাক করার মতো বিষয় হলো, বিপর্যস্তভাবে শুরু করলেও আর্নেস্তো ভালভার্দের দলটি পুরো মৌসুমে হেরেছে মাত্র দুটো ম্যাচ। আর লা লিগাতে তো এখন পর্যন্ত অপরাজিত।

এবারের কোপা ডেল রে ছিলো বার্সেলোনা ৩০ তম কোপা দেল রে শিরোপা; Source: Getty Images

বার্সেলোনার ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনের অবদান অবশ্যই এ মৌসুমে অ্যাটলেটিকো বিলবাও থেকে আসা কোচ আর্নেস্তো ভালভার্দের। ট্রেনিং গ্রাউন্ড থেকে মাঠের ডাগআউট, সবখানে তিনি খেলোয়াড়দের জুগিয়েছেন আত্মবিশ্বাস। বার্সেলোনার স্বাভাবিক খেলার ফর্মেশন ৪-৩-৩। প্রাক -মৌসুমে ভালভার্দে ব্যবহার করেছিলেন উক্ত ফর্মেশনই। কিন্তু নেইমার পিএসজিতে পাড়ি জমালে আর্নেস্তো ভালভার্দেকে ফিরে যেতে হয় তার পুরনো স্টাইলে, যে ফর্মেশন ব্যবহার তিনি অ্যাটলেটিকো বিলবাও এ সাফল্য পেয়েছিলেন। এমএসএন জুটি ভেঙে যাবার পর বার্সেলোনা প্রথমবারের মতো নিয়মিত ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলতে বাধ্য হন। স্ট্রাইকার পজিশনে দুজন। মেসি এবং সুয়ারেজ। আর মধ্যমাঠে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হতে থাকলো খেলোয়াড়। কখনো আন্দ্রে গোমেজ, কখনো ডেনিস সুয়ারেজ অথবা অ্যালেক্স ভিদাল।

আর্নেস্তো ভালভার্দে; Source: Thefalse9

৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলে আগের মৌসুমের থেকে চলতি মৌসুমে বার্সেলোনার মধ্যমাঠ হয়েছে আরো দৃঢ়, রক্ষণ হয়েছে আরো শক্তিশালী। আর্নেস্তো ভালভার্দে বরাবর শক্তপোক্ত রক্ষণ নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন। তাই বার্সেলোনাতে এসে তিনি সবথেকে বেশি কাজ করেছেন রক্ষণ নিয়ে। তার কষ্ট কিন্তু বিফলে যায়নি। তুলনামূলকভাবে এ মৌসুমে বার্সেলোনার গোল হজম করার পরিমাণ কম। এ পর্যন্ত বার্সেলোনা হেরেছে মাত্র দুটো ম্যাচ। অথচ লুইস এনরিকের আমলে প্রতিপক্ষে মাঠে গেলে বার্সেলোনাকে প্রতিনিয়ত গোল হজম করতে হতো। এমনকি অনেক সময় রিয়াল সোসিয়েদাদ, সেল্টা ভিগো বা মালাগার মতো দলের মাঠে গিয়ে হেরে এসেছে বার্সেলোনা। তাই ভালভার্দের ছোঁয়ায় বার্সেলোনার রক্ষণে যে ভালোরকম উন্নতি হয়েছে সেটা স্পষ্ট। বার্সেলোনার মতো দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পেয়ে প্রথম মৌসুমে আর্নেস্তো ভালভার্দে বিশেষ কোনো ভুল করেননি। তবে হয়তো একটি মাত্র ভুল তিনি অজান্তে করে ফেলেছিলেন, যার খেসারত দিতে হয়েছে রোমার কাছে লজ্জাজনকভাবে হেরে চ্যাম্পিয়নস লিগ হারিয়ে।

লিওনেল মেসি বার্সেলোনার কাছে সবসময় ভরসা নাম। সে ভরসার সিক্ত হয়ে এবারো বার্সেলোনা সামনে এগিয়েছে মেসির উপর ভর করে। ১০১৭-২০১৮ মৌসুমে লিওনেল মেসিই বার্সেলোনার যে সেরা খেলোয়াড়, সিজন শেষে তা প্রমাণিত। বার্সেলোনা কয়েক বছর ধরে নেইমারকে বাম পাশে, সুয়ারেজকে স্ট্রাইকার ও মেসিকে ডান পাশে রেখে খেলতে অভ্যস্ত। নেইমার চলে যাবার পর সে সুরটা এবার কেটে যায়। হুট করে নতুন পদ্ধতিতে মানিয়ে নিতে বেশ অসুবিধা হয়েছিলো লুইস সুয়ারেজের। ইনজুরি থেকে ফিরে এসে তিনি লম্বা সময় ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। সে সময় বার্সেলোনার ত্রাণকর্তা হিসেবে আরো একবার আবির্ভাব হয়েছিলো লিওনেল মেসি নামক এক জাদুকরের। প্রথমদিকে তিনি একাই টেনেছেন দলকে। কখনো স্ট্রাইকার বনে গেছেন, কখনো খেলেছেন নিখাদ মিডফিল্ডার হয়ে। কখনো গোল করেছেন, আবার গোল বানিয়ে দিয়েছেন।

বার্সেলোনার সবসময়ের ত্রাণকর্তা মেসি; Source: Returns

বার্সেলোনা লিগে এ পর্যন্ত অপরাজিত। বার্সেলোনার এ অপরাজিত রেকর্ড থাকতো না, যদি না বিপদের সময় মেসি তাদের বিপক্ষ দলের প্রাচীর ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে না দিতেন। মৌসুমের প্রথমে আলাভেসের সাথে করেছিলেন জোড়া গোল, এসপানিওলের সাথে করলেন হ্যাটট্রিক, এইবারের জালে করলেন চার গোলের সুপার হ্যাটট্রিক। এই আলাভেস ও এসপানিওল গত মৌসুমে বার্সেলোনাকে লিগে হোঁচট খাইয়েছিলো। মেসি এবার আর সে সুযোগ দিলেন না। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ভ্যালেন্সিয়ার কাছে গত নভেম্বরের প্রায় হেরে যাচ্ছিলো কাতালানরা যদি না জর্ডি আলবাকে দিয়ে সমতাসূচক গোল না করাতেন মেসি।

অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ বাধা বার্সেলোনা পর করেছে মেসির জাদুকরী ফ্রি-কিকের উপর ভর করে। আর সেভিয়ার বিপক্ষে ফিরে আসার ম্যাচ তো এখনো জীবন্ত। মেসি ইনজুরির কারণে ছিলেন না শুরুর একাদশে। বাধ্য হয়ে দ্বিতীয়ার্ধে যখন নামলেন সেভিয়া তখন ২-০ গোলে এগিয়ে। ম্যাচের শেষভাগে দুই মিনিটের মধ্যে জোড়া গোল করে সকল পরিসংখ্যান ওলট পালট করে বার্সেলোনাকে এনে দিলেন সমতা। কয়েকদিন আগের দেপোতির্ভোর সাথের ম্যাচের কথাই ধরুন। দেপোর্তিভো লা করুনার বার্সেলোনার সাথে ২-২ গোলে সমতা আনলে শেষে মুহূর্তে মেসি হ্যাটট্রিক করে এনে দেন কাঙ্ক্ষিত জয়।

৩২ গোলে মেসি পিচিচি ট্রফির দৌড়ে বর্তমানে সবথেকে উপরে আছেন; Source: Getty Images

একজন উইংগার হয়েও মেসির বিচরণ মাঝমাঠে। লুইস এনরিকের আমলেও মেসিকে মিডফিল্ডার রূপে দেখা গেলেও আর্নেস্তো ভালভার্দের বার্সায় বেশিরভাগ সময়ে মেসিকে দেখা গেছে মধ্যমাঠে। এবার খুব বেশি গোল বা অ্যাসিস্ট তিনি করেননি। ৩২ গোল ও ১২ অ্যাসিস্ট থেকে অনেক বেশি গোল, অ্যাসিস্ট করেছেন বিগত বছরগুলোতে। কিন্তু গত কয়েক বছরের মধ্যে এটি ছিলো বার্সেলোনার জন্য সর্বোচ্চ কঠিন সময়, একইসাথে মেসির জন্য। কিন্তু একজন লিওনেল মেসির দৌলতে বার্সেলোনা অন্ধকার মুহূর্ত থেকে বের হয়ে এসে জিতলো ডোমেস্টিক ডাবল। সিজনের শুরুতে কেউ কি ভেবেছিলো বার্সেলোনা এতটা দূর পর্যন্ত আসতে পারবে?

কাতালানদের সাফল্যগাঁথায় লিওনেল মেসির পরে যার নাম আসবে তিনি জার্মান গোলকিপার মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগান। ক্লাদিও ব্রাভোকে যেতে দিয়ে তাকে প্রথম পছন্দের গোলকিপার বানানোর সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিলো, নতুনভাবে এ বছর তিনি তা আবার প্রমাণ করলেন। শূন্যে ভাসা বল ধরতে তার সমস্যা ছিলো, সমস্যা ছিলো ডাইভেও। সব দোষত্রুটি সমাধান করে এ মৌসুমে তার পারফর্মেন্স ছিলো দেখার মতো। শরীরের ফ্লেক্সিবিলিটি ও দূরপাল্লা শটে স্টেগান দারুণ উন্নতি করেছেন। আশ্চর্য সব শট ঠেকিয়ে প্রতিপক্ষকে হতাশ করেছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগ ও লা লিগা মিলিয়ে ৪৩ ম্যাচে ২৭ ম্যাচেই গোল হতে দেননি বার্সেলোনার জালে। বার্সেলোনার হয়ে দারুণ এক সিজন কাটানোর পাশাপাশি লিগে ৩৪ ম্যাচে অপরাজিত থাকার পেছনে স্টেগানের ভূমিকা মেসির থেকে কোনো অংশে কম নয়।

মার্ক আন্দ্রে টার স্টেগান, বার্সেলোনার জার্মান প্রাচীর; Source: Daily Mail

বার্সেলোনার ডোমেস্টিক ডাবল জেতার অবদান বর্তায় আরো দুজনের কাঁধে। একজন ২২ বছরের পুরনো সৈনিক আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা অন্যজন এ সিজনে গুয়াংজু এভারগ্রান্দে থেকে বার্সেলোনাতে আসা পাউলিনহো। টটেনহাম ফ্লপ পাউলিনহোর বার্সেলোনাতে আসা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো, তেমনি ছিলো হাস্যকর। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগে ফ্লপ তকমা কাঁধে নিয়ে চীনে গিয়ে পাউলিনহো যে ভালোমত উন্নতি করেছেন তার প্রমাণ যেন বার্সেলোনাতে এসে দিলেন। লা লিগাতে প্রায় প্রতিটা ম্যাচে মাঠে নেমেছেন তিনি। করেছেন ৮ গোল ও ২ অ্যাসিস্ট। বদলি খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নেমে এটা কিন্তু খারাপ পারফর্মেন্স নয়।

আর অপরাজিত থাকার পেছনে পাউলিনহোর করা ৮ গোলের বিশেষ মর্যাদা আছে। শারীরিক শক্তির সুবাদে গোল করে অনেক ম্যাচে বার্সেলোনাকে পয়েন্ট হারানোর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তিনি। এ সিজনের হিটম্যাপ দেখলে বোঝা যাচ্ছে ভালভার্দের দেওয়া ফ্রি রোলের ফলে পাউলিনহোর বিচরণ ছিলো পুরো মাঠ জুড়ে। অর্ধ সিজন পার হবার পর ধারাবাহিক ভালো পারফর্মেন্স পাউলিনহোর দ্বারা হয়নি, কিন্তু এবারের লা লিগাতে বার্সেলোনার সাফল্যের পিছনে পাউলিনহোর অবদান কোনো অংশে কম নয়।

প্রশ্নবিদ্ধ দল বদলের পর পাউনিলহো একদম হতাশ করেননি; Source: Eurosports

২২ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে চলতি মৌসুম শেষে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা বিদায় নেবেন বার্সেলোনা থেকে। কিন্তু বার্সেলোনার ক্যারিয়ারে শেষ বছরটিও যেভাবে রাঙিয়ে গেলেন, তা কি ভোলা সম্ভব? সব মিলিয়ে ইনিয়েস্তা গোল করেছেন মোটে ২টি, অ্যাসিস্টও খুব বেশি নয়, মাত্র ৩টি। কিন্তু শুধু গোল, অ্যাসিস্টের সংখ্যা দিয়ে ইনিয়েস্তাকে বিশ্লেষণ করা মারাত্মক ভুল হবে। বিগত দশটা সিজনের মতো এ সিজনেও বার্সেলোনার মধ্যমাঠের বাম পাশ ঝলমলে করে রাঙিয়ে গেলেন। ক্যারিয়ারের শেষসময়ও তার পাসিং অ্যাবিলিটি, সাকসেসফুল ড্রিবলিং এর রেটিং চোখ কপালে তুলে দেবার মতো। বাম পাশ থেকে আক্রমণের শুরুটা সবসময় তার করে দেওয়া। তবে সব ছাপিয়ে আসল কথা হলো, মাঠের পারফর্মেন্স না লক্ষ্য করে অক্ষরের সাহায্যে ইনিয়েস্তার মতো খেলোয়াড়ের অবদান উল্লেখ করা যায় না।

চলতি মৌসুম শেষেই শেষ হচ্ছে বার্সেলোনায় ইনিয়েস্তা অধ্যায়; Source: Getty Images

দেপোর্ভিতোকে ২-৪ গোলে হারিয়ে ৪ ম্যাচ বাকি রেখে লা লিগা নিশ্চিত করেছে বার্সেলোনা। গত ১০ বছরে এটি বার্সার সপ্তম লিগ জয় এবং অষ্টম ডাবল। লিগে টানা ৪১ ম্যাচ অপরাজিত বার্সেলোনা, হাতছানি দিয়ে ডাকছে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হবার রেকর্ড। তবে ডোমেস্টিক ডাবল জেতার আনন্দ থাকলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কষ্ট কাতালানদের ভোগাবে। ২০১৫ সালে সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা ছুঁতে পেরেছিলো তারা। পরবর্তী তিনটা বছর কেটে গেলেও সেমিফাইনাল পার করা হয়নি একবারও। এবারও হেসেখেলে জেতা ম্যাচ বার্সেলোনা হেরেছে অবহেলার ছলে। আসন্ন মৌসুম নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে গেলেও এসে যাচ্ছে নতুন চিন্তা। লা মাসিয়া থেকে বের হওয়া সেরা তিনটি রত্নের যে আর মাত্র একটু রত্ন বাকি থাকবে আগামী বছর থেকে। আগেভাগে ফিলিপে কৌতিনহো এনে রাখায় কিছুটা ঝক্কি হয়ত কম পোহাতে হবে। কিন্তু ইনিয়েস্তার শূন্যতা পূরণ করা যে অসম্ভব। হয়তো, আগামী মৌসুম থেকে বার্সেলোনার খেলার ধরনেও আসবে আমূল পরিবর্তন।

Related Articles

Exit mobile version