আসরের প্রথম পাঁচ ম্যাচ শেষে তিন পয়েন্ট নিয়ে দশ দলের আসরে নবম স্থানে অবস্থান করে বাড়ি ফিরবে কীভাবে, সেটাই বোধহয় চিন্তা করছিল পাকিস্তান ক্রিকেট দল। হঠাৎ করে পায়ের তলে মাটি খুঁজে পেল তারা, শেষ দুই ম্যাচে জিতে শেষ চারে যাওয়ার দৌঁড়ে বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে তারা। গ্রুপপর্বে নিজেদের সপ্তম ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান। বেরসিক বৃষ্টি পাকিস্তানের সেমিফাইনালের স্বপ্নে যখন পানি ঢেলে দিচ্ছিল, তখনি সূর্য উঁকি দিয়ে পাকিস্তানের মুখে হাসি ফোটায়।
পাকিস্তান পরে ব্যাট করে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনা, এই কথা মাথায় রেখে টসে জিতে বোলিং-সহায়ক উইকেটে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিউ জিল্যান্ড। তাদের সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণিত করতে সময় নেননি আসর জুড়ে দুর্দান্ত বোলিং করতে থাকা মোহাম্মদ আমির। নিজের প্রথম বলেই মার্টিন গাপটিলকে বোল্ড করে সাজঘরে ফেরত পাঠান। এরপর কলিন মুনরো, রস টেইলর এবং টম লাথামের উইকেট তুলে নেন ম্যাচের সেরা বোলার শাহিন শাহ আফ্রিদি। প্রায় প্রতি ম্যাচেই দলের হাল ধরে ব্যাটিং করা কেন উইলিয়ামসন এদিনও জিমি নিশামকে নিয়ে চেষ্টা চালিয়েছিলেন, কিন্তু দলীয় ৮৩ রানে এবং ব্যক্তিগত ৪১ রানে শাদাব খানের শিকারে পরিণত হলে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে নিউ জিল্যান্ড।
নিউ জিল্যান্ডের দুই অলরাউন্ডার জিমি নিশাম এবং কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে দলের হাল ধরেন। প্রথমে দেখেশুনে খেলার পর শেষ দশ ওভারে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে তারা দলকে ২৩৭ রানের পুঁজি এনে দিয়েছিলেন। গ্রান্ডহোম ৬৪ রান করে রানআউট হয়ে ফিরে গেলেও শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থেকে ৯৭ রান করেছিলেন নিশাম। জবাবে ২৩৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই দুই ওপেনারের উইকেট হারালেও বাবর আজম, হারিস সোহেল এবং মোহাম্মদ হাফিজের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ের উপর ভর করে পাঁচ বল এবং ছয় উইকেট হাতে রেখে জয় তুলে নিয়েছিল পাকিস্তান। এই জয়ে পাকিস্তানের শেষ চারে খেলার সম্ভাবনা আরও জোরালো হল।
পাকিস্তান এখন পর্যন্ত একবার বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছিল। ইমরান খানের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পাকিস্তান। ঐ আসরের সাথে এইবারের আসরে বেশ কিছু অদ্ভুতুড়ে মিল রয়েছে। কালকের ম্যাচের সাথেও দেখা গিয়েছে এমন ভূতুড়ে মিল। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তান নিজেদের সপ্তম ম্যাচে পাঁচ বল হাতে রেখে জয় পেয়েছিল, কালকেও পাঁচ বল হাতে রেখে জিতল তারা।
পাকিস্তান ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে প্রথম পাঁচ ম্যাচ থেকে মাত্র তিন পয়েন্ট পেয়েছিল। এরপর টানা তিন ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালের টিকেট পেয়েছিল তারা। এইবারও প্রথম তিন ম্যাচ থেকে মাত্র তিন পয়েন্ট অর্জন করে তারা। সেমিফাইনাল খেলতে হলে শেষ চার ম্যাচের চারটিতে জয়ের পাশাপাশি অন্যান্য দলের ফলাফলের দিকেও তাকিয়ে থাকতে হবে পাকিস্তানকে। এখন পর্যন্ত দুই ম্যাচ খেলে দুইটিতে জয়লাভ করে নিজেদের কাজটা ভালোভাবে করছে তারা।
পাকিস্তানের ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে পথচলার সাথে ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের মিল চোখে পড়ার মতো। অদ্ভুতুড়ে সব মিল রেখে তারা শেষ চারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেমনটা হয়েছিল ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে। এই দুই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের যত বিস্ময়কর মিল রয়েছে তা জেনে আসা যাক।
১.
১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে নয় দল অংশগ্রহণ করেছিল। গ্রুপপর্বে রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতিতে সব দলের বিপক্ষে একটি করে ম্যাচ খেলার পর শীর্ষ চার দল সেমিফাইনাল খেলেছিল।
২০১৯ সালের বিশ্বকাপে দশ দল অংশগ্রহণ করেছে, রাউন্ড রবিন লিগ ফিরেছে এবারও। প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে একটি করে ম্যাচ খেলার পর সেরা চার দল সেমিফাইনাল খেলবে।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে কেবল এই দুই আসরেই এমন পদ্ধতিতে সেমিফাইনালের জন্য দল নির্ধারিত হয়েছে।
২.
১৯৯২ সালের বিশ্বকাপের পরিচালকবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, প্রতি ইনিংসে দুটি নতুন সাদা বলে খেলা হবে, প্রতি প্রান্তের জন্য একটি বল। ২০১৯ সালের বিশ্বকাপেও প্রতিটি দল দুটি নতুন বল পাচ্ছে নির্ধারিত ওভার শেষ করার জন্য, একটি নির্দিষ্ট প্রান্তের জন্য একটি নির্দিষ্ট বল।
৩.
১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের প্রথম সাতটি ম্যাচের ফলাফল ছিল যথাক্রমে: পরাজয়, জয়, বৃষ্টির জন্য পরিত্যক্ত, পরাজয়, পরাজয়, জয় এবং জয়।
২০১৯ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানেত প্রথম সাতটি ম্যাচের ফলাফলও হুবহু ‘৯২ এর মতো। সাতটি ম্যাচের ফলাফল যথাক্রমে: পরাজয়, জয়, বৃষ্টির জন্য পরিত্যক্ত, পরাজয়, পরাজয়, জয় এবং জয়।
পাকিস্তান ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ঐ ম্যাচে পাকিস্তান প্রথমে ব্যাট করে ২২০ রান সংগ্রহ করে। জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোন উইকেট না হারিয়েই সহজে জয় তুলে নেয়।
২০১৯ সালেও পাকিস্তান নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। এই ম্যাচেও পাকিস্তানকে সহজে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথমে ব্যাট করা পাকিস্তান মাত্র ১০৫ রান গুটিয়ে যায়। জবাবে মাত্র ১৩.৪ ওভারেই তা টপকে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
৪.
১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তান যখন মার্টিন ক্রো’র নিউ জিল্যান্ডের মুখোমুখি হয়, তখন স্বাগতিক নিউ জিল্যান্ড ছিল অপরাজিত। তারা সাতটি ম্যাচ খেলে সব ম্যাচেই জয় তুলে নিয়েছিল। তাদেরকে পাকিস্তান সহজেই সাত উইকেটে হারিয়ে সেমিফাইনালের টিকেট পেয়েছিল।
২০১৯ সালের বিশ্বকাপেও পাকিস্তান অপরাজিত নিউ জিল্যান্ডের মুখোমুখি হয়। পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে নিউ জিল্যান্ড ছয় ম্যাচ খেলে একটিতেও পরাজয়ের স্বাদ পায়নি। তবে এইবার নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের পরই পাকিস্তানের সেমিফাইনালে খেলা নিশ্চিত হয়নি। নিজেদের শেষ দুই ম্যাচে জয়ের পাশাপাশি অন্যান্য ম্যাচের দিকেও তাকিয়ে থাকতে হবে। আরও একটি অমিল হল যে, ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তান বনাম নিউ জিল্যান্ডের ম্যাচটি ছিল আসরের ৩৪তম ম্যাচ। ২০১৯ সালের ম্যাচটি আসরের ৩৩তম ম্যাচ।
৫.
এই দুই আসরের সাথে আরও বেশ কয়েকটি মিল দেখা যায়। যেমন, ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের উদীয়মান তারকা হিসাবে খেলেছিলেন ইনজামাম-উল হক। ২০১৯ সালে খেলছেন ইনজামামের ভাইপো ইমাম-উল হক।
১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ষষ্ঠ ম্যাচে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান আমির সোহেল। ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ষষ্ঠ ম্যাচে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছেন আরেক সোহেল। বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হারিস সোহেল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুর্দান্ত ব্যাটিং করার সুবাদে ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছিলেন।
১৯৯২ সালে পাকিস্তানের শিরোপা জয়ের আগের দুই আসরে যথাক্রমে ভারত(১৯৮৩) এবং অস্ট্রেলিয়া(১৯৮৭) শিরোপা ঘরে তুলেছিল।
২০১৯ সালের বিশ্বকাপের আগের দুই আসরেও ভারত(২০১১) এবং অস্ট্রেলিয়া(২০১৫) শিরোপা জিতেছে।
৬.
ক্রিকেটের বাইরের কিছু ঘটনার সাথেও এই দুই আসরের মিল রয়েছে। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট বেনজির ভুট্টোর স্বামী আসিফ আলি জারদারি জেলে ছিলেন। ২০১৯ সালেও তিনি জেলে আছেন। ১৯৯২ সালে অ্যানিমেটেড মিউজিক্যাল ফিল্ম আলাদিন মুক্তি পেয়েছিল, ২০১৯ সালে মুক্তি পেল লাইভ অ্যাকশন আলাদিন রিবুট।
অবশ্য এইসব ভুতুড়ে মিলে গা ভাসিয়ে কূলে ভিড়তে চায় না পাকিস্তান। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ এখন অতীত, ২০১৯ সালের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। পাকিস্তানের আজহার মাহমুদ এখনকার পরিস্থিতির সাথে ১৯৯৯ সালের অস্ট্রেলিয়াকে তুলনা করেছে। ঐ আসরেও অস্ট্রেলিয়া অবিশ্বাস্যভাবে ফাইনালে উঠেছিল। সেখান থেকে শিরোপা জিতেছিল তারা। পাকিস্তানের পরিস্থিতিও প্রায়, গ্রুপপর্বের চার ম্যাচ বাকি থাকতেই তাদের জন্য প্রত্যেক ম্যাচ বাঁচা-মরার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। পারবে কি পাকিস্তান শেষ হাসি হাসতে? ভূতুড়ে এই কাকতালকে পরিণতি দিতে পারবে কি সরফরাজের দল?