তামিম ইকবাল দুবাইতে যে কাজটা করলেন, তাতে ক্রিকেট ইতিহাসের অমর কিছু খেলোয়াড়ের সাথে নাম উঠে গেলো তার।
দলের জন্য এমন ক্যারিয়ার বাজি রাখার ঘটনা ক্রিকেটে রোজ রোজ দেখা যায় না। ইতিহাসে মাঝে মাঝে এমন করে চমকে ওঠেন কিছু ক্রিকেটার; তারা দেখিয়ে দিতে চান, শরীরটাই শেষ কথা নয়। তারা প্রমাণ করতে চান, সবার আগে ক্রিকেট।
সেই প্রমাণ করা লোকেদের একজন তামিম। তার আগেও পৃথিবী দেখেছে এমন কিছু অবিশ্বাস্য লড়াই। তারই কয়েকটা লড়াই ফিরে দেখা যাক আজ
বার্ট স্যাটক্লিফ (নিউজিল্যান্ড, ১৯৫৩-৫৪)
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের এই জোহানেসবার্গ টেস্টটা এমনিতেই খুব শোকের একটা আবহে অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। টেস্টের দ্বিতীয় দিনে খবর এলো- নিউজিল্যান্ডে ভয়াবহ এক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। যেখানে কিউই ক্রিকেটার বব ব্লেয়ারের প্রেমিকাও মারা গেছেন। এই পরিস্থিতিতে মন ঠান্ডা করে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের জন্য খেলাটাই ছিলো কঠিন একটা কাজ। এর মধ্যে দুই বোলার অ্যাডক ও আইরনসাইড ভয়ঙ্কর বল করছিলেন। ব্যাটসম্যানরা শরীরে আঘাত জর্জরিত ছিলেন। এরকম এক ভয়াবহ বাউন্সারে কানের পাশে আঘাত পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বার্ট স্যাটক্লিফ।
স্যাটক্লিফকে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এক্স-রে করে দেখা যায় মাথায় কোনো চিড় নেই। তবে কানের পাশটা দারুণভাবে ফুলে গেছে। চিকিৎসকরা জানান, এই আঘাত স্যাটক্লিফকে জীবনের তরে কানে ভালো শোনা থেকে বঞ্চিত করবে। তারা তাকে খেলা বন্ধ করে বিশ্রামে যেতে বলেন। কিন্তু স্যাটক্লিফ মাঠে ফিরে আসেন।
মাঠে সতীর্থদের ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখে তিনি আবার খেলতে নামার সিদ্ধান্ত নেন। মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে তিনি ব্যাটিং শুরু করেন। এরপর সেই প্রেমিকা হারানো ব্লেয়ার ও স্যাটক্লিফ জুটি বেঁধে লড়াই করেন। স্যাটক্লিফ ৮০ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচটা জিতে নিলেও এই টেস্ট স্মরণীয় হয়ে আছে দারুণ এই বীরত্বের জন্য।
কলিন কাউড্রে (ইংল্যান্ড, ১৯৬৩)
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের এই লর্ডস টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম রোমাঞ্চকর এক টেস্ট। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আগে ব্যাট করে ৩০১ রান করেছিলো। ফ্রেড ট্রুম্যান ৬ উইকেট নিয়েছিলেন। জবাবে ইংল্যান্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে ৪ রান বেশি করতে পেরেছিলো। দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করে ২২৯ রান। চতুর্থ দিন ম্যাচ একেবারে ভারসাম্যপূর্ণ ছিলো। কারণ ইংল্যান্ড ৩১ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিলো। ওয়েস হল ভয়ানক বল করছিলেন। তারই একটা বিদ্যুৎ গতির ডেলিভারি আঘাত করে কলিন কাউড্রের হাতে। কাউড্রের হাত ভেঙে যায় এবং তিনি আর ব্যাট করতে পারলেন না।
এখান থেকে ম্যাচটাকে কাছাকাছি নিয়ে যান ব্যারিংটন ও ব্রায়ান দুটি ফিফটি করে। কিন্তু শেষ সেশনে আবারও ধ্বস নামে ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ে। শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের দরকার ছিলো ৮ রান; হাতে ছিলো ২ উইকেট। ৩ বলে ৬ রান দরকার থাকতে ডেকেন শ্যাকেলটন আউট হয়ে যান। আর তখনই হাতে প্লাস্টার বাঁধা অবস্থায় ব্যাট করতে বেরিয়ে আসেন কাউড্রে। কাউড্রের এই আবার ব্যাট করার সিদ্ধান্তে নাটকীয় এই ম্যাচ ড্র হয়ে যায়।
ম্যালকম মার্শাল (ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ১৯৮৪)
ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত বীরত্ব সম্ভবত মার্শালের এই ব্যাটিং।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার ছিলেন মার্শাল। হেডিংলি টেস্টের প্রথম দিনেই সেই মার্শালের বুড়ো আঙুল যখন দুই জায়গায় ভেঙে গেলো, তখন ইংল্যান্ড মনে করেছিলো, তারা এগিয়ে গেছে। ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ২৭০ রান করেছিলো।
তৃতীয় দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ লিড নিয়ে নিলো। সমস্যা হলো নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে জোয়েল গার্নার যখন আউট হলেন, তখন ল্যারি গোমেজের রান ৯৬। সকলে ধরে নিলেন, সেঞ্চুরি থেকে ৪ রান দূরে অতৃপ্ত থাকতে হচ্ছে গোমেজকে। কিন্তু সবাইকে তাজ্জব করে দিয়ে এক হাতে ব্যাট নিয়ে নেমে এলেন মার্শাল। ইংলিশ ফিল্ডাররা হেসে ফেলেছিলেন। তাদের সেই হাসি মিলিয়ে যেতে সময় লাগলো না। তিনি নিজে চার মারলেন একটি এবং গোমেজকে সেঞ্চুরি করালেন।
এখানেই মার্শালের বীরত্ব শেষ নয়। এরপর বল হাতে ইনিংস শুরু করেছিলেন। শুধু বোলিং করার জন্য করেননি। ৭টি উইকেট তুলে নিয়েছিলেন!
অনিল কুম্বলে (ভারত, ২০০২)
কুম্বলে চিরকালই দলের প্রতি নিবেদন, দায়বদ্ধতা ও শৃঙ্খলার জন্য পরিচিত একজন ক্রিকেটার ছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অ্যান্টিগা টেস্টে মার্ভ ডিলনের এক বাউন্সার এসে লাগে তার চোয়ালে। থুতু ফেললে দেখা যায়, একগাদা রক্তের দলা বেরিয়ে এসেছে। তা-ও ব্যাটিং চালিয়ে যান তিনি। পরে বলেছেন, অবিশ্বাস্য ব্যথা করছিলো। ইনিংস শেষে পরীক্ষায় জানা যায়, চোয়ালটা তার ভেঙেই গেছে। সিরিজের বাকি অংশে তিনি আর নেই জানিয়ে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতিও পাঠানো হয়। পরদিনই তার জন্য ফ্লাইটে টিকিট বুকিং করা হয়।
ধরেই নেওয়া হয়েছিলো, এই টেস্টেও আর মাঠে নামছেন না এই স্পিনার। কিন্তু সারা মুখ ব্যান্ডেজে বেঁধে কুম্বলে বল করতে নেমে পড়েন। প্রতি ওভারে সেই ব্যান্ডেজ ঠিক করে নিতে হচ্ছিলো। শুধু বোলিং করেননি। ব্রায়ান লারার উইকেটও তুলে নিয়েছিলেন।
গ্যারি কার্স্টেন (দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০০৩-২০০৪)
লাহোর টেস্টে মোটামুটি ভালো একটা শুরু এনে দিয়েছিলেন গ্রায়েম স্মিথ ও হার্শেল গিবস। স্মিথ আউট হয়ে গেলেন। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা দৃশ্যত হারিয়ে ফেললো কার্স্টেনকে। তাকে মাঠ থেকে বের করে দিলো শোয়েব আখতারের ভয়ঙ্কর এক শর্ট বল।
রাউন্ড দ্য উইকেট বল করছিলেন শোয়েব। ভয়ঙ্কর গতির শর্ট বলটায় পুল করবেন বলে ভেবেছিলেন কার্স্টেন। কিন্তু গতির সাথে পেরে ওঠেননি। বল আগেই আঘাত হানে তার মুখে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন তিনি। পাকিস্তানী ফিল্ডাররা দ্রুত চেষ্টা করেন তাকে সুস্থ করার। মাঠ থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় পরবর্তীকালের এই ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার কোচকে। এক্স-রে জানায়, নাক ভেঙে গেছে তার।
দ্বিতীয় ইনিংসেও নিয়মিত উইকেট হারাতে থাকে দক্ষিণ আফ্রিকা। চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে বেরিয়ে আসেন কার্স্টেন। তবে বলে না দিলে তখন এই বদলে যাওয়া মুখমন্ডলের মানুষটিকে চেনা কঠিন! তীব্র লড়াই করে তিনি ৪৬ রানের এক ইনিংস খেলেছিলেন।
গ্রায়েম স্মিথ (দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০০৯)
সিরিজ জুড়ে ছিলো দারুণ উত্তপ্ত পরিস্থিতি। সিডনিতে এই চূড়ান্ত টেস্টেও লড়াইয়ের অভাব ছিলো না।
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৩৯৪ রান করেছিলো। গ্রায়েম স্মিথ দারুণ শুরু করেছিলেন। ৩০ বলে ৩০ রানের ইনিংস খেলে উইকেটে ছিলেন। তখনই মিশেল জনসনের বিদ্যুৎ গতির বল আঘাত হানে স্মিথের বাম হাতে। সাথে সাথে হাত ভেঙে যায় তার। ওই ইনিংস ওখানেই শেষ স্মিথের।
দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে শেষ ইনিংসে লক্ষ্য ছিলো ৩৭৬ রান। এই সিরিজে একবার এর চেয়ে বেশি রান তাড়া করে জিতেছে তারা। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। তাদের সেরা ব্যাটসম্যানই তো নেই। দক্ষিণ আফ্রিকানরা ড্র করার জন্য কঠোর লড়াই শুরু করলো। দিনের নয় ওভার খেলা বাকি থাকতে নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে ডেল স্টেইন আউট হলেন। অস্ট্রেলিয়নরা জয় ধরে নিয়ে উৎসব শুরু করে দিয়েছিলো। তখনই ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত নিয়ে গ্রায়েম স্মিথ মাঠে নেমে এলেন। অন্য প্রান্তে ছিলেন মাখায়া এনটিনি।
কিন্তু সব গল্পের শেষটা রূপকথার মতো হয় না। তাই দিনের ১৭ বল বাকি থাকতে স্মিথ আউট হয়ে গেলেন। রয়ে গেলো তার বীরত্বের গল্প।