টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি। ক্রিকেটের তিন সংস্করণ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন এই তিন সংস্করণই স্বীকৃত। এর বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সিক্স-এ-সাইড টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয় ঘটা করে। সম্প্রতি টি-১০, এমনকি ১০০ বলের টুর্নামেন্ট আয়োজনের খবরও আছে ক্রিকেট দুনিয়ায়।
‘দ্য হান্ড্রেড’ নামে ১০০ বলের টুর্নামেন্ট মাঠে গড়াতে পারে ২০২০ সালের জুলাইয়ে, যার আয়োজক ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড। এদিকে, ২০১৭ সাল থেকেই আরব আমিরাতের মরুর বুকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে টি-১০ ক্রিকেট লিগ। আইসিসির স্বীকৃত ১০ ওভারের ম্যাচের এই লিগের দু’টি আসর ইতঃমধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী ১৫-২৪ নভেম্বর আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত বসবে টি-১০ লিগের তৃতীয় আসর।
এই প্রথম টি-১০ লিগে খেলবে বাংলাদেশের কোনো দল। ‘বাংলা টাইগার্স’ নামে একটি দল আগের দুই আসরেও অংশ নিয়েছিল এই লিগে। তবে আসন্ন তৃতীয় আসরে বাংলা টাইগার্স দলটির মালিকানা থাকছে বাংলাদেশিদের হাতেই। আয়োজকদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ইয়াসিন চৌধুরী ও বিসিবির সাবেক পরিচালক সিরাজউদ্দিন আলমগীর মিলে দলটির স্বত্ব নিয়েছেন।
তারা এই দলে রাখতে চান বাংলাদেশিদের আধিক্য। আয়োজকদের অনুমতি নিয়ে বিদেশি কোচ বাদ দিয়ে বাংলাদেশি কোচ, সিংহভাগ বাংলাদেশি ক্রিকেটার নিয়ে দল গঠন করতে চান তারা। এরই মধ্যে জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার আফতাব আহমেদকে কোচ, নাজিমউদ্দিনকে সহকারী কোচ, এবং নাফিস ইকবালকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে বাংলা টাইগার্স।
আকর্ষনীয় এই টি-১০ লিগে যুক্ত হওয়া, বাংলা টাইগার্স দলটির স্বত্ব নেয়া থেকে শুরু করে সার্বিক বিষয়ে সবিস্তারে কথা বলেছেন দলটির মালিকানার অংশীদার সিরাজউদ্দিন আলমগীর।
বাংলা টাইগার্স দলটা আপনারা নিয়েছেন। আপনার পার্টনার ইয়াসিন চৌধুরী। ক্রিকেটের সঙ্গে উনার সম্পৃক্ততা এবং তার সম্পর্কে জানতে চাই।
ইয়াসিন চৌধুরী অনেক বছর ধরেই ক্রিকেটের সাথে সম্পৃক্ত। ঢাকায় না, কিন্তু চট্টগ্রামে তার দু’টি দল আছে। দুটি দল চালায়। ক্রিকেটের খুব অনুরাগী। এখানে ঘরোয়া ক্রিকেটের সঙ্গে সে সম্পৃক্ত। আমরা যখন পিসিএল করেছিলাম, তখন মোহামেডান দলটা সেই চালিয়েছিল। এখানে কর্পোরেট লিগ হয়, সেখানে যুক্ত থাকে। ক্রিকেটের পেছনে তার বিনিয়োগ অনেক।
উনি এফএমসি গ্রুপের চেয়ারম্যান। ওরা মূলত শিপ বানায়। আরও কিছু ব্যবসা আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া ছাত্র। ক্রিকেটের পাগল। দুবাইয়ে ওনার অফিস আছে।
টি-১০ লিগে কীভাবে যুক্ত হলেন?
এই টুর্নামেন্ট যখন প্রথম ওরা করতেছিল, প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলাম। টুর্নামেন্টের আইডিয়া থেকে শুরু করে প্লেয়িং কন্ডিশন, সব কিছু নিয়েই আমার সাথে আলোচনা হয়েছে। বিভিন্নভাবে আমাকে যুক্ত করার চেষ্টাও করেছিল ওরা। আমি যেহেতু নন-রেসিডেন্ট ইউএই’তে, এভাবে কাজ করার সুযোগ নেই।
তখন ওরা প্রস্তাব করে যে, ভারত থেকে অনেকে দল নিচ্ছে, বাংলাদেশ থেকেও আমাকে বলে একটা দল গড়তে। ওরা পার্টনার ব্যবস্থা করে দিবে বলেছে। ওখানে ‘বাংলা টাইগার্স’ নামে একটা দল আগেই ছিল। ২-১ বছর পর এখন আবার দল গড়তে বলেছে। তারা বলছে, সবকিছু কনসিডার করেই দিবে। অনেক কিছুতে আমাকে ছাড় দিয়েছে ওরা। তারপর ইয়াসিনকে বললে সে-ও রাজি হয়। তারপরই দল নেয়া। ইয়াসিনের দুবাইয়ে নিজস্ব কোম্পানি আছে, অফিস আছে, মানে একটা সেটআপ আছে। তখন তাকে বলেছি, সে-ও রাজি হয়। এভাবেই টি-১০ এর সাথে যুক্ত হয়েছি।
এই লিগটা এখন পরিচালনা করছে কারা?
এটা সম্পূর্ণ আবুধাবি সরকারই আয়োজক। প্রথম দুই বছর এটা বেসরকারিভাবে হয়েছে। কিন্তু এই বছর আবুধাবি সরকারই এটার পুরো দায়িত্ব নিয়েছে। এখন সরকারই চালাচ্ছে।
আপনারা ইতঃমধ্যে আফতাব আহমেদকে কোচ করেছেন, নাফিস ইকবালকে ম্যানেজারের দায়িত্ব দিয়েছেন…
এখানে অপশন ছিল যে, বিদেশি কোচ নেয়া। আমরা তাদেরকে (আয়োজন) প্রথম থেকেই বলছি যে, আমরা ওই রকম অনেক পয়সা দিয়ে দল করতে পারব না। আমাদের দলে বাংলাদেশি ফ্লেভার থাকবে। বাংলাদেশি জনবলই আমরা বেশি ব্যবহার করব। এসব জায়গায় ওরা আমাদেরকে ছাড় দিয়েছে। এই স্বাধীনতা দিয়েছে যে, কোচ-ম্যানেজার আমরা আমাদের মতো করে নিতে পারব। আমরা কোচ হিসেবে আফতাবকে নিয়েছি। ভালো কাজ করছে এখন, আমরা তাকে সুযোগ দিলাম। সবচেয়ে বড় জিনিস, সে ভালো কাজ করতেছে।
তারপর নাফিসের (নাফিস ইকবাল) তো একটা বড় অভিজ্ঞতা আছে। কয়েক বছর ধরে বিপিএলে একটা দলের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছে। ‘এ’ দলেও ছিল। অভিজ্ঞতা আছে। ওই পর্যায়ে তো একজন অভিজ্ঞ ছেলে লাগবে।
সব বিবেচনা করে ওদের দু’জনকে, সঙ্গে নাজিমকেও (নাজিমউদ্দিন) আমরা সহকারী কোচ হিসেবে রাখছি। সে-ও কোচিংয়ে কাজ শুরু করেছে। তাদের অভিজ্ঞতা আছে, এখন এটা যদি কাজে লাগাতে পারে। আয়োজকরাও এটাকে ভালো বলেছে। কারণ, এরা সবাই বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার।
এই দলে বাংলাদেশের ক্রিকেটার কেমন থাকবে?
এখানে নিয়ম ছিল ড্রাফট থেকে সব প্লেয়ার নেয়ার কথা। ড্রাফটে টপ ক্লাস সব ক্রিকেটার থাকবে। আইপিএলের পর বিশ্বের অন্যতম বড় বাজেটের টুর্নামেন্ট এটি। এখানে বিশ্বের বড় বড় তারকা ক্রিকেটাররা খেলবে। ড্রাফট লিস্ট দেখলেই বুঝবেন। নিয়ম হচ্ছে ড্রাফট থেকে প্লেয়ার নেয়ার।
আমরা তাদেরকে বলেছি, আমরা বেশিরভাগ বাংলাদেশি প্লেয়ার খেলাব, যদি তারা খেলার মতো অবস্থায় থাকে। আয়োজকরা এটাও মেনে নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আমাদেরকে ছাড় দিছে আরকি। এখন আমি যদি ড্রাফট থেকে নিতে যাই, অনেক টাকার দরকার। প্রতিটি ক্যাটাগরিতে প্লেয়ারদের মূল্য অনেক। আমরা বেশিরভাগ ক্রিকেটারই বাংলাদেশ থেকে নিব। আমরা ৯ জন বাংলাদেশি ও আর ৫ জন ড্রাফট থেকে নিব।
বাংলাদেশি ক্রিকেটার কারো সাথে কথা হয়েছে কি না?
কথা হচ্ছে, এখানে অনেকগুলো বিষয়ও আছে। বোর্ডের অনুমতি দেয়ার বিষয় আছে। আবার সমস্যা হয়ে গেছে, ওই সময়ে আমাদের দল থাকবে ভারত সফরে। আমরা তাই কিছু তরুণ প্লেয়ারের কথা চিন্তা করছি। সিনিয়র যদি ভালো কাউকে পাই। দু’জন ইমার্জিং প্লেয়ারও রাখতে চাই। কিছু প্লেয়ারের সাথে কথা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত হয়নি। আগামী ১৬ অক্টোবর ড্রাফট আছে। ড্রাফটের পরই খেলোয়াড় তালিকা চূড়ান্ত হয়ে যাবে। আফতাব-নাফিসরা এসব নিয়ে কাজ করছে এখন। ড্রাফট আবুধাবিতে হবে। এবার ওরা এই টুর্নামেন্টটা বড় আকারে করার চেষ্টা করতেছে। আবুধাবিকে তুলে ধরার জন্য চেষ্টা করছে। তাই ওদের সরকারও বিনিয়োগ করছে বড় অঙ্কের।
এক মৌসুম দল গড়তে কেমন খরচ লাগতে পারে?
এখানে রেভিনিউ শেয়ারিং আছে। তারপরও যোগ-বিয়োগ করলে আমার মনে হয়, ৭-৮ কোটি টাকা অন্তত খরচ হবে। আর যারা পূর্ণ শক্তির ওই রকম দল গড়বে, তাদের অনেক বেশি হবে আমাদের চেয়ে। ওখানে অবশ্য সবাই বিলিয়নিয়ার। যারা দলের মালিক, তারা বড় বড় গ্রুপের মালিক। ওদের স্পন্সরও আছে। ভারতীয় ক্রিকেটাররা খেলবে। আমাদের জন্য প্রথম বছরটা একটু কষ্টকর হবে, কারণ আমাদের সময় কম। আর ভারতীয় ক্রিকেটারদের জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে ওরা, প্রত্যেক দলে একজন করে ভারতীয় ক্রিকেটার রাখতেই হবে। এটা ভারতীয় মার্কেট ধরার জন্য। তাই বিসিসিআইও টুর্নামেন্টটাকে সাপোর্ট করতেছে।
টি-১০’র চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত আফতাব
খেলোয়াড়ি জীবনে ছিলেন মারকুটে ব্যাটসম্যান। কোচিং ক্যারিয়ারে অবশ্য এমন তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে যেতে চান না আফতাব আহমেদ, বরং বিচক্ষণতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে চাইছেন তিনি। কোচ হিসেবে আফতাবের উত্তরণ হচ্ছে প্রতি মৌসুমেই। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে গত মৌসুমে লিজেন্ডস অফ রূপগঞ্জের কোচ ছিলেন। এবার জাতীয় ক্রিকেট লিগে চট্টগ্রাম বিভাগের হেড কোচ তিনি। টি-১০ লিগে বাংলা টাইগার্সেরও হেড কোচের দায়িত্ব পেয়েছেন আফতাব।
এই লিগে কোচের দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত জাতীয় দলের সাবেক এই ক্রিকেটার। আফতাব বলেছেন,
‘এটা অবশ্যই বড় ব্যাপার। অনেক উত্তেজিত আমি। আমি যেহেতু কোচিংয়ে এসেছি, এটা আমার জন্যে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এফএমসির যে ইয়াসিন চৌধুরী আছেন, ওনাকে আমি ধন্যবাদ জানাই যে এত বড় একটা সুযোগ আমাদের দেয়ার জন্যে। ওনার আসলে চিন্তাই ছিল যে, বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের উঠিয়ে আনবে, এবং কোচদেরও উঠিয়ে আনবে। যা কিছুই হোক, এই মন-মানসিকতা কয়জনের থাকে! আমি বিশেষভাবে ওনাকে ধন্যবাদ জানাই আমাদের উঠিয়ে নিতে ওনার চিন্তাধারার জন্য। এটা আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। আমি চেষ্টা করব ভালো কিছু করার।’
বাংলা টাইগার্সে আট বিদেশি, সাত দেশী ক্রিকেটার
বাংলাদেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি বাংলা টাইগার্সের আইকন ক্রিকেটার হিসেবে আছেন শ্রীলঙ্কার থিসারা পেরেরা। প্লেয়ার্স ড্রাফট শেষে আট বিদেশি ও সাত দেশীয় ক্রিকেটার নিয়ে দল গঠন করেছে বাংলা টাইগার্স।
বিদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার জেমস ফকনার, আফগানিস্তানের কায়েস আহমেদ, দক্ষিণ আফ্রিকার রাইলি রুশোদের দলে টেনেছে বাংলা টাইগার্স। এছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকান কলিন ইনগ্রাম, রবি ফ্রাইলিঙ্ক ও ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যান আন্দ্রে ফ্লেচারের সাথে আগেই চুক্তি করেছিল বাংলা টাইগার্স। ড্রাফট থেকে যুক্ত হলেন রাইলি রুশো, কায়েস আহমেদ, জেমস ফকনার ও চিরাগ সুরি।
দেশীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে সুযোগ পেয়েছেন এনামুল হক বিজয়, আবু হায়দার রনি, জুনায়েদ সিদ্দিকী, আরাফাত সানিরা। ড্রাফটে দেশীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে এনামুল হক বিজয়, ফরহাদ রেজা ‘সি’ ক্যাটাগরিতে, ইয়াসির আলী, অফ স্পিনার মেহেদি হাসান ইমার্জিং ‘ক্যাটাগরিতে’ থাকাটা আগেই নিশ্চিত ছিল। ড্রাফট থেকে নেওয়া হয় আবু হায়দার রনি, জুনায়েদ সিদ্দিকী ও আরাফাত সানিকে।
যদিও এই সাত দেশীয় ক্রিকেটারেরই টি-১০ লিগে খেলা অনিশ্চিত। কারণ, বিসিবি ইঙ্গিত দিয়েছে, জাতীয় ক্রিকেট লিগ চলাকালীন এই লিগে খেলার ছাড়পত্র দেয়া হবে না বিজয়-জুনায়েদদের।
বাংলা টাইগার্সের স্কোয়াড
থিসারা পেরেরা, রাইলি রুশো, আন্দ্রে ফ্লেচার, রবি ফ্রাইলিঙ্ক, জেমস ফকনার, কায়েস আহমেদ, কলিন ইনগ্রাম, চিরাগ সুরি, এনামুল হক বিজয়, ফরহাদ রেজা, আবু হায়দার রনি, জুনায়েদ সিদ্দিকী, আরাফাত সানি, ইয়াসির আলী রাব্বি ও মেহেদি হাসান।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘খেলাধুলা’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/